কিসু চিনতে করোনা না গো। ম্যানেজার বাবু তো আজ দেখা করতে কয়েছেন। দেখি গিয়ে কি হয়? না হলে আর কি করা যাবে।
লোকাল ট্রেনের জানালার ঠিক ধারে আমি বসে। আমার ঠিক পাশেই সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক আর এক মাঝবয়সী মহিলা বসে। বয়স্ক লোকটার উস্কোখুস্কো কাঁচা পাঁকা চুল। লম্বাটে মুখের উপর অনেকদিনের না কাঁটা দাড়ি । চোখ দুটো অসম্ভব উদাসীন। পরনে একটা লুঙ্গি আর একখানা মলিন ফতুয়া। পায়ে হাওয়াই চটি। মহিলার পরনে এক মলিন শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। গায়ের রং তামাটে। অবিন্যস্ত কোমর অবধি লম্বা চুল। সুগভীর দুটো চোখ। কিন্তু দুটোই বড়ো উদাসীন দেখাচ্ছে। দুজনেরই তাই।। তবে দুজনের মুখে চোখে এক অনাবিল গ্রাম্য সরলতা।ধাত্রী গ্রাম ষ্টেশন থেকে ওরা ওঠে। আর তখন থেকেই তাদের কথপোকথনে মোটামুটি এই টুকু বুঝতে পেরেছি ব্যাংক সংক্রান্ত কোনো একটা ঝামেলার মধ্যে আছেন তারা। জিজ্ঞেস করাতে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি যা বললেন সেটা সংক্ষিপ্ত করলে হয় -
ওনার নাম সম্ভু ওরাও। ওনাদের বাড়ি ধাত্রীগ্রাম স্টেশনে থেকে একটু দূরে। ভদ্রলোক পেশায় ভান চালক। এক ছেলে মিস্ত্রির কাজ করে। ওই ভদ্রমহিলা তার ছেলের বউ। নাম মনিহারি। এক সরকারি ব্যাংকে বাবা আর ছেলে মিলে কিছু টাকা রেখেছিল। অঙ্কটা ওদের কাছে অনেক। প্রায় এক লাখ দুই হাজার টাকা। দুজনেরই কষ্টার্জিত। তাও প্রায় বহু বছর জমিয়ে রাখা টাকাটা সেভিংস একাউন্টে। কিছু মাস আগে ব্যাংকের থেকে তারা একটা ফোন পায়। যেটাতে তাকে যথারীতি বলা হয় তার ব্যাংকের কোনো লেনদেন না থাকায় তার বাংক একাউন্ট deactivate হয়ে যাবে। এক্টিভ রাখার জন্যে তাদের কাছে একটা ওটিপি যাবে। সেটা বলে দিলেই হয়ে যাবে। তারা ভয়ে কথামতো কাজ করে, এবং তার কিছু পরেই তাদের একাউন্ট থেকে যথারীতি দুবারে প্রায় পুরো অঙ্কটাই বেরিয়ে যায়। ব্যাংকের দ্বারস্থ হলে ব্যাংক প্রথমে পাত্তা দিতে চায়না। তারপর বলে যেহেতু এদের দোষে ব্যাপারটা ঘটেছে তাই তারা কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছেনা। বুঝলাম মান্ধাতার আমলের স্ক্যাম করার পদ্ধতি। ডিজিটাল অ্যারেস্ট এর যুগে এটা ব্যাক ডেটেড। তাও গ্রাম্য সরল মানুষ, যেভাবে কোপ মারা যায়। এই নিয়ে এই কয়েক মাসে বহুবার যাতায়াত করেছেন ব্যাংকে । ম্যানেজার বাবু নাকি এখনো বলে যাচ্ছেন দেখছে।
তোমরা আবার এসেছো? বলে তো দিলাম যে আমরা দেখছি।
শম্ভু বাবু আর তার ছেলের বউ এই কথা শুনে একটু মনে হলো দমে গেলো। একটু ভয় এবং সংকোচ মেশানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি ওনার করুন চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা এক ইশারা করে সম্ভুবাবু কে থামিয়ে ওই ভদ্রলোকের উদ্যেশ্যে বললাম
এবার আমিও এসেছি ওনাদের সাথে ব্যাপারটি বুঝতে।
তুমি কে?আমি ওনাদের পরিচিত। ওনারাই আমাকে ওনাদের ব্যাংক সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলার অধিকার দিয়েছে।
বাবা। তাই নাকি? তাহলে তো সবই শুনেছ। দোষ টা তো ওদের। আমরা কি করতে পারি। তাও তদন্ত করে দেখছি। কিছু হলেই জানাবো।
লোকটা যখন আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলছিলেন, তখন ওনার চাহনিতে ছিলো এক রকমের তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা। যেনো উনি সর্বজ্ঞানী বিধাতা। আর আমরা তুচ্ছ কিট। অবশ্য এই অবজ্ঞার দৃষ্টি আমার কাছে গা সওয়া। প্রায়শই আমাকে এই চোখে দেখে লোকজন। শীর্ণকায় ছোটখাটো চেহারা আমার। তোবরানো চোয়াল। অবিন্যস্ত চুল। পরনে ধূসর এক ডেনিম ব্লু জিনস এর উপরে একটা হালকা ফেড হয়ে যাওয়া কালো গেঞ্জি। পায়ে ক্রোক্স। পিঠে একটা ব্যাগ আছে বটে তবে কাধের এক দিকে ঝুলন্ত, তার কারণ আর এক দিকের স্ট্র্যাপ ছেড়া। জীবনে কোনোদিনই সেই টল ডার্ক এন্ড হ্যান্ডসাম হতে পারলাম না। অবশ্য দুঃখ নেই তাতে।
আচ্ছা। খবর টা পাওয়ার পরে আপনারা কি করলেন? উনি তো ঘটনা ঘটে যাওয়ার তিনদিনের মধ্যে আপনাকে খবরটা দেন। তার নথি ও আছে ওনার কাছে। আপনাদের কি পদক্ষেপ ছিলো?
ওনার ওই অবজ্ঞার দৃষ্টি কে পাত্তা না দিয়ে, ওনার দিকে এক কঠিন ভঙ্গিতে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলাম। প্লোকটি এবার একটু বিস্ময় মেশানো চোখে আমার দিকে তাকালেন। মাথায় পরিপাটি করে আঁচড়ানো সাদা কালো চুল। মসৃণ করে কমানো দাঁড়ি। পরনে ধোপদুরস্ত জামা কাপড়। এক ছিমছাম সরকারি কর্মচারী। ওনার চাহনি দেখে মনে হলো আমার মতন ব্যক্তিত্ব আবার এই রকম প্রশ্ন করতে পারে নাকি?
কি করবো? দোষটা তো ওনাদেরই।
না দোষটা শুরু থেকেই আপনাদের। তার আগে বলুন তো ওনাকে আপনাদের ব্যাংকের নামে ফোন করে প্রতারণা করা হলো কেনো?
সেটা আমরা কি করে বলবো?
সেটা আপনারাই বলবেন। তার কারণ যেহেতু আপনাদের ব্যাংকের নাম করে ফোন এসেছিল, তার মানে আপনাদের থেকেই কোনোভাবে কাস্টমার দের গোপন নথি বা ডাটা বাইরে বেরোচ্ছে?
কি ভাবে?
সেটা আপনাদের তদন্ত করা উচিত। আর যেহেতু কাস্টমার আপনাকে প্রতারিত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে জানিয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী, আপনার প্রথমে ওনাদের একাউন্ট টা ব্লক করা উচিত ছিল ভবিষ্যতে এই সমস্ত ব্যাপার গুলো এড়ানোর জন্যে। দ্বিতীয়ত আপনাদের ছয় ঘণ্টার মধ্যে ব্যাপারটা আর বি আই কে জানানো উচিত ছিল যেহেতু অঙ্কটা এক লাখের উপরে। তৃতীয়ত, আপনারা যদি জানিয়েও থাকেন তাহলে তার কোনো রেফারেন্স আইডি বা অন্য কোনো নথি, যাতে প্রমাণিত হয় খবর টা জানানো হয়েছে, সেই নথি কাস্টমার কে দেওয়া উচিত ছিল। সেই গুলো কি আপনারা করেছেন?
দেখুন দাদা, এরকম অনেক অভিযোগ আমাদের এখানে আসে। সব কিছু কি এত দেখা যায় নাকি বলুন?
আপনি একটা কাগজ পেন দিন বা আপনার সিস্টেম এ নোটপ্যাড খুলুন। আপনাকে আমি আমার ব্যক্তিগত ইমেইল আইডি দিচ্ছি। আপনি এখন যা বলেছেন, আপনার ব্যাংক এর ইমেইল আইডি থেকে আমাকে ইমেইল করে পাঠান। তাহলে আর আপনাকে কিছু করতে হবেনা । আমরা এবার বুঝে নিচ্ছি।
কথোপকথন ব্যাংকের ভেতরে হচ্ছে, আর ধীরে ধীরে একটু উত্তপ্ত ও হচ্ছিল। তাই আশেপাশে এবার লোক জড়ো হয়ে গেছে কিছু। লোকটা আমার এই কথায় এবার মনে হলো একটু বকফুট এ চলে গেলেন
আপনাকে ইমেইল করতে যাবো কেনো?
তার কারণ ব্যাংক হিসেবে এটা আপনার দায়িত্ব আর গ্রাহক হিসেবে এটা আমার অধিকার। আমি আপনার কাছে থেকে আপনি যা বলছেন তার একটা লিখিত নথি চাইতেই পারি। আর সেটা যদি চাই, সেটা দেওয়ার দায়িত্ব ও আপনার। আর আপনি যেটা বলছেন যে এত কিছু সব সময় দেখা যায় না। দেখতে হবে। তার কারণ এটাই আপনাদের কর্ম, আপনাদের জব। আর এর জন্যই আপনারা মাইনে পান। এক গরীব অশিক্ষিত মানুষ তার কষ্টের টাকা আপনার যাচ্ছে গচ্ছিত রাখছে তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। সেই টাকাটা কিভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়, আর শুধু টাকা না, সেই মানুষটার যাবতীয় ইনফর্মেশন সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব আপনাদের মানে ব্যাংক এর, আর এই কথাটা নিশ্চয় আপনাকে আলাদা করে বলতে হবে না। মানলাম এতো কিছু মেনে নেওয়া সম্ভব না, কিন্তু আপনি তো একটু ভালো ভাবে কথা বলতে পারেন তো, ভালো ভাবে বোঝাতে পারেন তো, যাতে যে মানুষটার একটা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, সেই মানুষটা একটু আশ্বস্ত হয়?
নিজের কথা শেষ হওয়াতে বুঝলাম ব্যাংকের ভেতরটা একদম চুপ হয়ে গেছে। মোটামুটি কর্মী থেকে শুরু করে গ্রাহক, সবাই এর নজর আমার দিকে। ব্যাংকের ম্যানেজার ও দাড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন এতক্ষণ, এবার উনি এগিয়ে এসে আমাকে তার পরিচয় দিয়ে নিজের চেম্বার এ ডাকলেন। আমি ইশারায় শম্ভু বাবুদের ও আসতে বললাম। দেখলাম ওনাদের সেই সঙ্কোচ, সেই ভয় ব্যাপারটা একদম মিলিয়ে গেছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে এক আত্মবিশ্বাস। ম্যানেজার বাবু ওনাদের সমস্ত অভিযোগ নথিভুক্ত করলেন আর তিনি সেই ইমেইল এর কপি একটা আমার ইমেইল আই ডি তে ও পাঠিয়ে দিলেন। এরপর উনি আমাকে আচমকা একটা প্রশ্ন করলেন,
কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি কি ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরে চাকরি করেন?
না। আমি তথ্য প্রযুক্তি তে আছি। সরকারি চাকরি পাওয়ার ভাগ্য এবং সামর্থ্য, দুটোই আমার ছিল না।
ওনার ঘর থেকে আমরা যখন বেরোচ্ছি, তখন মোটামুটি সবাই এর দৃষ্টি আমাদের দিকে। আর বেশিরভাগ দৃষ্টিতেই এক হালকা প্রশস্তি। যেনো বোঝাতে চাইছে “আমাদের সাথেও এতদিন এরা এরকমই করেছে। কিছু বলতে পারছিলাম না। আজকে আপনি একটু সাহস যোগালেন”।
এই বাবু। আমাকে একটু জল দিয়ে যা তো। আমি এখানে বসছি কিছুক্ষন।
মনিহারি, মানে শম্ভু বাবুর ছেলের বউ একটা চেয়ার এ বসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক বাংক এর কর্মচারীর উদ্যেশ্যে এই আবদার টা করলো। তার কণ্ঠে এখন এক সাহস আর চোখে এক গভীর আত্মবিশ্বাস। যেনো বলতে চাইছে “ আমার টাকা আমি বিশ্বাস করে তোমাকে রাখতে দিয়েছি। তুমি সেই বিশ্বাস রাখতে পারনি। তাহলে প্রশ্নের মুখে পড়া উচিৎ তোমার । আমি কেনো প্রশ্নের মুখে পড়বো?” জানিনা কার মনে কতটা সাহস জোগাতে পেরেছি, তবে আমার এই নবপরিচিত এক সরল গ্রাম্য পরিবার, যারা এই সব ব্যাংক এ ঢুকতে সঙ্কোচ করে, ভয় পায়। আর তাই তারা অবৈধ সব ভুয়ো কোম্পানি ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়, তাদের মনে একটু সাহস জোগাতে পারলাম । আর আমিও নিজের এই পারফরমেন্স এ যারপরনাই আহ্লাদিত।বাবু। তুকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুই কবে গেরামে আসবি বল। তুকে নিজের হাতে মাংসের ঝোল করে খাওয়াবো।
ঘটনাটা একটু ভুলেই গেছিলাম। আজ মনিহারি ফোন করে । তাদের সেই টাকার অনেক টা উদ্ধার হয়েছে জানালো। তার সাথে নেমন্তন্ন করেও দিলো তাদের গেরামে যাওয়ার জন্যে। দেখি এর মধ্যে একদিন ঘুরে আসবো এক সরল প্যাঁচ ঘোঁচ হীন পরিবেশে।