Image by Shashidhar Hegde from Pixabay

গীতায় " ধর্ম " এই শব্দ বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে ! বর্তমানে " হিন্দুধর্ম "
" ইসলামধর্ম " " বৌদ্ধধর্ম " ইত্যাদি যে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক অর্থে " ধর্ম" এই শব্দটির অপব্যবহার হচ্ছে , গীতায় সেই অর্থে ধর্ম শব্দ ব্যবহার করা হয়নি , বা সেই অর্থে ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন পড়েনি ! গীতার সময় অর্থাৎ কুরুক্ষেত্রের " ধর্মযুদ্ধ " সময়ে সেই অর্থে " ধর্ম " শব্দ ব্যবহার হওয়ার কোনো কারণ ও অবস্থা ছিল না ! তখন ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় ছিলোনা ! সাম্প্রদায়িক হিসাবে " ধর্ম " শব্দটি ব্যবহারও হয়নি ! গীতায় সাধারণ , ব্যাপক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে " ধর্ম " শব্দটি , তা গীতার অভন্তরীন ভাবধারা হতে নিঃসন্দেহে ও নিশ্চিতরূপে পরিস্ফূট হয়েছে ! অধুনা ঐ " ধর্ম " শব্দ দিয়ে যা বোঝায় আর গীতায় তা যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে , দুটিতে আকাশপাতাল পার্থক্য ! আধুনিক গৃহীত ভাব নিয়ে " ধর্ম " শব্দ ব্যবহার করলে গীতার কোনো অর্থই হয় না , গীতার সকল ভাবকে ধূলিসাৎ করা হয় মাত্র ! এ রকম সংকীর্ণ অর্থদ্বারা গীতার উচ্চ শিক্ষা তত্ত্ব ও আদর্শতো হৃদয়ঙ্গম হবেই না , - পক্ষান্তরে তার বিপরীত ও বিরুদ্ধ ভাব ও মন্মার্থ প্রকাশিত হবার অবকাশও আশংকা আছে ! বস্তুতঃ তার বিপরীত কদর্থ যে হচ্ছে না , তা নয় ! সেই জন্য গীতায় " ধর্ম " কি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক মনে করলাম , এবং তাই এই নিবন্ধ ! গীতায় " ধর্ম " শব্দ অতি ব্যাপক !

ধর্ম শব্দের সাধারণ অর্থ - স্বভাব , প্রকৃতি , গুন্ , মূল উপাদান ; যেমন তরলতাই জলের ধর্ম , দাহিকাশক্তি আগুনের ধর্ম , এই ধর্ম বাদ দিলে ঐ ঐ জিনিসের কিছুই থাকে না , তারাই ঐ জিনিসের মূল অস্তিত্ব , এরাই মূল উপাদান এবং প্রকৃতিদত্ততাকে স্বভাব ! যা থাকলে একটা বস্তু তদ্পদবাচ্য হয় , যা না থাকলে তাকে আর সেই বস্তু বলা চলে না - তাই বস্তুর ধর্ম ! ধর্মই ঐ বস্তিটির প্রাণ অথবা মর্ম্মস্থল ; এবং বস্তুটির ধর্মই তাকে ধারণ করে রেখেছে ! এই সংজ্ঞা অনুসারে যারদ্বারা মানুষের মনুষ্যত্ব ,- যা থাকতে মানুষ মনুষ্য পদবাচ্য হয়েছে তাই তার ধর্ম ! অর্থাৎ মনুষ্যত্ব বলতে যা বুঝি তাই তার ধর্ম ! এই মনুষ্যত্বত্বরূপ মানবের যে ধর্ম তা সাধারণত গীতায় বিশেষভাবে ৩য় অধ্যায়ের ৩৫ শ্লোকে ,  ১৮ অধ্যায়ের ৪৩ শ্লোকে ও ৪র্থ অধ্যায়ের ৭/৮ শ্লোকে ঐ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে !

৪র্থ অধ্যায়ের ৭/৮ শ্লোকে ভগবান বলছেন যখন যখন অধর্ম্মের অভ্যুথান তখন ধর্ম্ম সংস্থাপনের জন্য ও ধর্মাত্মা ব্যক্তিগণের রক্ষার জন্যে তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হন ! মানুষের মধ্যে যখন পশুবলি প্রবল , মানুষের মানবতাকে খর্ব্ব , পঙ্গু , ক্ষীণ করে দেয় মানুষের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করে দেয় , তখনই তার ধর্ম নাশ হয় ! পশুবলে প্রদীপ্ত হয়ে এবং অনধিকারে লুব্ধ হয়ে মানুষ এরকম অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে বিশৃঙ্খলা , অত্যাচার , অশান্তি , অজ্ঞান , মোহান্ধতা বিস্তার লাভ করে , এবং মানুষ ধ্বংসের মুখে পতিত হয় ! ( যা বর্তমানে আমেরিকা , ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে ছড়াচ্ছে ) এরকম হলেই মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের অর্থাৎ মানবধর্মের অভাব হয়েছে বুঝতে হবে ! এরকম অবস্থায় মানুষ প্রকৃত মনুষত্বহারা অর্থাৎ ধর্মহীন হয়ে যায় এবং আদর্শচ্যুত হয়ে পশুর মতো ব্যবহার করতে থাকে !

এখন বোঝার চেষ্টা করা যাক , যাকে মানুষের ধর্ম বলা হলো সেই মনুষ্যত্ব কি নিয়ে ? কি নষ্ট হলে মানুষের ধর্ম বা মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় ? ' মনুষ্যত্ব ' বলতে কি বোঝায় ? এই প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনা ও অবতারণা না করে সহজ ও সংক্ষেপে আমার একটা ব্যাখ্যা ! মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্যটা কি সেটা জানা আবশ্যক ! মানুষের মধ্যে এমন কতগুলি গুন্ বা শক্তির প্রকাশ দেখা যায় যার প্রকাশ অন্য প্রাণীতে নেই , যেমন জ্ঞান , বুদ্ধি , বিবেক ,চিন্তাশক্তি , ইচ্ছাশক্তি , সঙ্কল্পকরা ও সেই সংকল্প দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইচ্ছাকে ও সংকল্পকে কার্য্যে রূপ দেওয়া , আত্ম-উপলব্ধি , জিভহিতচিন্তা , আত্মসংযম , আনন্দনুভূতি , ঈশ্বর ও পরিনামচিন্তা ইত্যাদি ! অন্য প্রাণী হতে এই যে মানবের পার্থক্য যা মানুষের আছে কিন্তু অন্য প্রাণীতে প্রকাশিত নেই তাই মানবের মানবত্ব , এই চেতনাপূর্ণ আত্মিক প্রচেষ্টা বা স্বত্বিক প্রকাশ যা অন্য প্রাণীতে নেই তাই মানুষের মনুষত্ব - মানবের ধর্ম ! যে সকল গুন্ স্বভাব প্রচেষ্টাদি অন্য প্রাণীতে নেই মানুষে আছে - ঐ গুলি যদি মানুষের মধ্যে না থাকতো তা হলে মানুষ ইতর প্রাণিমধ্যেই গণ্য হতো , ঐ সকল গুন্ থাকতেই তার মনুষ্যত্ব প্রকটিত হয়েছে !

অতএব ইহা সকলকে স্বীকার করতেই হবে যে গীতার শিক্ষা ও ধর্মোপদেশ সমগ্র মানবজাতির প্রতি প্রযোজ্য এবং মানুষ মাত্রেরই কল্যাণপ্রদ ও সুখশান্তিবিধায়ক ! 

এই মহান শিক্ষা ব্যক্তি বা জাতি বা সম্প্রদায়বিশেষের ধর্ম নয় , ' গীতা ' ব্যষ্টি ও সমষ্টি ভাবে সমগ্র মানবজাতির ধর্ম্মপদেশ !!!!

.    .    .

Discus