অরণ্য
ভাসছে চারটে কাগজের নৌকা
ছোট ছোট কাদামাখা হাত-
ছেলেবেলা হাতড়ায় সুগন্ধি লেবুপাতা!
ব্লেডে হাত রাখি এখন,
নেকড়ে শেয়ালে টেনে নিয়ে যায়
রাতের কাঁচা নাড়ি। অরণ্য জেগে ওঠে।
প্রতিটা মুখ দৈত্যের মতো লাগে।
পিশাচের পদাঘাত,
সাপের নিঃশ্বাস আর জিভে বিষ নিয়ে
মাকে ধর্ষণ করে সে স্তনে মুখ লুকিয়ে কাঁদে।
এ জঙ্গলে মৃত্যু আসে না সহজে।
ক্ষত বিক্ষত হই রোজ।
লেবুপাতার গন্ধ আসে, ফিকে!
দেখি, থরে থরে কাগজের নৌকা,
হাসি হাসি মুখে মা'রা বানিয়ে দেন,
আর ছোট ছোট দুটো হাত
ভাসিয়ে চলে বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়…
সবই এক স্বপ্নের ঘোর! সবই আজ কল্পনা!
সে ছবি ম্লান হয়েছে কবেই!
হিংস্র জঙ্গল-
রেহাই নেই কোথাও!
এরপর যুদ্ধ বাঁধলে ধ্বংস হয় অরণ্যও।
থাকে শুধু রাষ্ট্রের রক্তাক্ত মুখে সর্বভুক হাসি!
গির্জায় মাথায় একা চাঁদ
শীতল গ্রহাণুপুঞ্জের আলো
গির্জার গাছটা কালো হয়ে আসে।
চারদিকে ঘননীল।
আমাকে ঈশ্বর ভেবে,
পায়ে পায়ে ঘাসেরা বিছায় শোক।
যে তীক্ষ্ণতা বিঁধেছে নরম পাতায়,
চুপিসারে মাথানত করে,
ধোঁয়াটে কোলাহল কুয়াশায়-
বহু বহু দূরে কবরের শীর্ষ প্রস্তর থেকে
দেখা যায় না তো আর কিছুই!
এ চাঁদের মুখ নেই কোনও।
তীব্র ফ্যাকাশে, সাদা আঙুল যেন
প্রতিটা অপরাধের পর সমুদ্রের মতো ঘন হয়ে আসে।
তারপর, শান্ত পারাবার...
হতাশায় হাঁ করে থাকি।
প্রতি রবিবার আকাশে উঁকি মারে-
গির্জায় আটবার ঘন্টাধ্বনি হলে উঠে আসে ঠিক
পরিচয় খুঁজে নিতে।
চেয়ে আছে চারধারে গাছ ঠিক ওই গির্জার মতো,
চাঁদ কি ওর মা?
ও তো মেরী নয়,
মায়ায় করুণ
ওর নীল কাপতান থেকে শুধু অসংখ্য
বাদুড় আর পেঁচাদের ঝাঁক–
তবুও বিশ্বাসে আমার আজও এক নমনীয় ভোর
মোমবাতির কোমল শীতলতা
রাখা এই নরম দুটো চোখে!
দীর্ঘ পথ আমি হেঁটে যাই, প্রস্ফুটিত মেঘে
রহস্য নীলিমায় নক্ষত্ররাজি
গির্জার ভেতর কোনও ধ্যানমগ্ন ঋষি,
অস্ফুট কঠোর পবিত্র সে রূপ–
চাঁদ, দেখে না আর কিছু!
মৃত মলিন নিঃস্ব সে শরীর,
আর গির্জার প্রাঙ্গনে সে গাছ,
কালো হতে হতে,
মিশে যায় স্তব্ধতার নিবিড় অন্ধকারে!
বিসর্জন
নিশ্চুপ চোখের মতই কিছু আঘাত
স্থির হয়ে আছে।
আশ্চর্য এক সন্ধ্যা ফুটে থাকা ফুলের মতো,
কী জানি হঠাৎ ভেসে যায়
বিবাহের মৃত আষাঢ়ে।
বন্ধ ব্যাগের ভেতর থেকে ভিজে জামাকাপড়ের
গন্ধ। সময় হয়না খুলে দেখার-
অপেক্ষায় কাঁপে প্রতিটা দরজা।
জমাট বরফ,
নিস্তব্ধ-
বুঝিয়ে যায় মিথ্যে কল্পনা দিয়ে
কবিতা লেখা যায় না কখনও।
শব্দহীন মৃত্যুর কাছে পা মুড়ে বসি
ভেসে ওঠে রূপোলি আলো,
নিজেরই জলে বিসর্জিত হয় পয়স্বিনী।
আমি ভালো আছি
নরম চোখের নীচে নির্ঘুম ছাপ
কীভাবে আজও ফেলে রেখে গেছ-
মায়াহীন এমন ভালোবাসায়
স্নায়ুতঞ্চনে বিকল আজও বিকল হয় না জল।
আশ্বাসে আকাশ ভাসে-
উদ্বিগ্ন কামের শূন্য অতীত।
অলীক আশাদের বিষমুখে বোঝাই,
আমার চরম পরাজয়ে কেঁদে ওঠার মানুষ নেই আর।
ভালো নেই আমি- শোনার মতো কেউ নেই-
এক অক্লান্ত দৌড় আঁকড়ে তবু বলি,
হে ক্লান্তি, আমি ভালো আছি।
আঙুলে বৃষ্টি ফোঁটা ছুঁই
আমার ভালো ঢাকা চুঁইয়ে পড়ে গাল বেয়ে
নরম মাটিতে আবার, দেখি এক বীজ
মাথা তুলেছে সবুজ পাতা দুটো নিয়ে!
ওটুকুই বেঁচে থাকা
দমকা হাওয়ার নিভু নিভু হ্যারিকেন
তবুও ওটুকুই বেঁচে থাকা-
হস্তান্তরে বদলে যাওয়া অধিকার,
বদলায় না শরীর।
স্পর্শের জলে ভাসা একটি পাতার মতো
ব্লকলিস্টে ছটফট করে অপেক্ষা।
হাওয়ার কোনো শত্রু নেই-
বয়ে চলার অন্তত অধিকার শুধু।
সন্তাপে আঁধার কাঁপে,
বাঁচব বলেই বারবার তবু ধ্বংস হয়েছি
কবিতার কাছে!
দেবীপক্ষ
ক্ষতদের আড়ালে হাসে দেবী,
ভোরের আশ্বিন বড়ো স্মৃতিমেদুর
ছাইমাখা মেঘ ঢাকা পড়ে সাদা কাশে।
কাঁচে কাটা পা, ছেঁকা খাওয়া হাত
পিঠের কালসিটেতে প্রসাদ রাখে ভক্তের সাজ
জিভ দিয়ে চেটে খায় রাঙা-হলুদ!
ঈশ্বরী আসেন ভয়ে ভয়ে।
পাতা আসনে বসে রক্তগন্ধে ভরা পুজোঘর দেখেন।
মহিষের কাটা মুন্ড হেসে বলে, 'ভয়ে থাক, মেয়ের জাত'
প্রসাধনহীন নগ্ন শরীর, নিটোল স্তনের ওপর
ফুটিয়ে তোলে শত শত কমল
দুগ্ধপতনে ভাসে কূল-
এত শক্তি আর কার, যা গোটা ব্রক্ষ্মান্ডের
খিদে মেটায় চুপিচুপি?
অপেক্ষা রয়ে গেছে
ক্যালেন্ডার ছুঁয়ে অপেক্ষা রেখেছিল।
তবু রাখা হয়নি কথা।
ধ্রুবতারার দিকে চেয়ে 'সম্পর্ক’ দেখি।
আলো আসে, আলো যায়।
তুমি আঁধার হয়ে ওঠো।
ঘরের ভেতর আরও কত ঘর তৈরী হয়।
ছায়ার ভেতর বাড়ে প্রচ্ছায়া।
একলা দ্বীপে দিশেহারা রাত প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।
অট্টহাস্যে ফেটে যায় যেন আকাশ
ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তুমুল ঢেউ,
তবুও উঠে দাঁড়াই।
বলহীন ভিজে শরীরে, এক পা, দু পা করে
এগিয়ে যাই জলের প্রান্তরে–
যেখানে নিঃশ্বাস নেয় সেই
আঠারো বছরের যুবক
আর তাকে ঘিরে থাকে আমার অবুঝ
অতল বিশ্বাস!