একটি দেশ বা জাতির উন্নতি নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্হা ও সংস্কৃতির উপর। কিন্ত সেই শিক্ষাব্যবস্হা যদি ত্রুটিযুক্ত হয়,সংস্কৃতির বদলে যদি অপসংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে,তাহলে কী আমরা নিরাপদে থাকতে পারবো? আমরা কী কবির মতে ছবি হয়ে দেশের ও দশের অবনতি দেখতে থাকবো নাকি এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলবে?একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে প্রত্যেকের উচিত রাষ্ট্রের অধিকার গুলো ভোগ করার সঙ্গে,সঙ্গে সঠিকভাবে দেশ ও দশের প্রতি কর্তব্য করা।এরজন্যই মনীষা চর্চার মাধ্যমে দেশবাসীকে সেই আলোয় আলোকিত করা ও দেশ গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।এইব্যাপারে যার নাম সর্বাগ্রে মনে পড়ে তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ।যাকে বলা হয় ঘনীভূত ভারতবর্ষ। আবার কেউ বলেন ভারত আত্মার মূর্ত প্রতীক। যার সম্বন্ধে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক রমা রোঁলাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন",যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও ,তবে বিবেকানন্দকে জানো"।

স্বামী বিবেকানন্দের প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত। মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী।বিবেকানন্দ জন্মেছিলেন ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারি।মৃত্যু ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই। স্বল্প দৈর্ঘ্যের তার জীবনে রয়ে গেছে অনেক কাজ, বাণী ও অগণিত ভক্তবৃন্দ। মনে পড়ে যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতাটি-যাহার অমর স্হান প্রেমের আসনে/ক্ষতি তার ক্ষতি নাই মৃত্যুর শাসনে/ দেশের মাটি থেকে নিল যারে হরি /দেশের হৃদয় তাকে রাখিয়া ধরি।

নরেন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠার পেছনে যাদের সবথেকে বেশী অবদান ছিল তারা হলেন মাতা, পিতার শ্রীরামকৃষ্ণ। মাতা ভুবনেশ্বরীর কাছ থেকেই তার ইংরেজী শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছিল বলেই নরেন্দ্রনাথ ইংরেজীতে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। মায়ের উপবাস ও সত্যবাদিতা বাল্যকালে তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত নামকরা উকিল ছিলেন বলে বাড়িতে বহু মানুষের আনাগোনা ছিল। তাদের আলাপ-আলোচনা শুনে নরেন্দ্রনাথের মনে যুক্তিবাদের উন্মেষ ঘটেছিল।

নরেন্দ্রনাথের জীবনকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ সবসময় নরেন্দ্রনাথকে স্মরণ করিয়ে দিতেন নিজের জন্য নয়,জগতের কল্যাণের জন্য তোর আগমন। আজকের দিনে শ্রীরামকৃষ্ণের মত গুরুদের বিশেষ প্রয়োজন যারা পথভ্রষ্ট,দিশাহীন যুবসমাজকে পথ দেখাবে,দেশ গঠনের কাজে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো নরেন্দ্রনাথ ও ছিলেন সাধারণ মানের ছাত্র। ছোটবেলা থেকে তিনি শরীর চর্চা করতেন বলেই তার চেহারা ছিল সুগঠিত ও বলশালী।শরীরের গুরুত্ব তিনি বুঝতেন বলেই তিনি বলেছিলেন-"শক্তিই জীবন,দূর্বলতায় মৃত্যু"।তিনি আরো বলেছিলেন-" গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা অনেক ভালো"।

সাধারণ মানুষের মতো নরেন্দ্রনাথের জীবনেও আঘাত এসেছিল। প্রথমটি আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে , পরবর্তীতে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে।পিতার আকস্মিক প্রয়াণের পর সংসারের বিপুল বোঝা হঠাৎ করে তার কাঁধে এসে পড়ে।নরেন্দ্রনাথ ভাইদের মধ্যে ছিলেন বড়।সামান্য চাকুরীর জন্য তিনি হন্যে হয়ে ঘুরছিলেন। একসময় সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করার কথা ভেবেছিলেন কিন্ত রামকৃষ্ণদেব তাকে নিবৃত্ত করেন ও সঠিক দিশা দেখান।নরেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় আঘাতটি এসেছিল শ্রীরামকৃষ্ণদেবের তিরোধানে (১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ই আগষ্ট)।

১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে স্বামীজীর অন্তরে জেগে উঠল ভারতবর্ষ ভ্রমণের সংকল্প।শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে নয়,অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে দেখবেন ভারতবর্ষকে।পদব্রজে শুরু হল যাত্রা।শেষ হল কন্যাকুমারীতে ১৮৯২ সালের ডিসেম্বরে।এই কন্যাকুমারীতেই স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যানস্হ হয়ে ভাবতে লাগলেন ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস ও তার গৌরবের কথা।ভাবতে,ভাবতেই বিবেকানন্দ খুঁজে পেলেন ভারতের উন্নতির উপায়।জড়ের শক্তিতে নয়,চৈতন্যের শক্তিতে জাগাতে হবে দেশ তথা বিশ্ববাসীকে।ঠিক করলেন ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দের আমেরিকার শিকাগো শহরের অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদান করবেন। সেই ব্যবস্থাও হলো।

বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদান করে বিবেকানন্দ যে শুধু ভারতবর্ষের প্রাচীন গৌরব সহ ভারতবাসীর মাথা উঁচু করেছিলেন তা নয় ,বিদেশী ভক্তদের সহায়তাই ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ১লা মে ভারতবর্ষে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন স্হাপন করেন। যার মূল কাজ ছিল আর্তপীড়িত মানুষকে সহায়তা করা ও শিক্ষাদান। পাশ্চাত্যে বিবেকানন্দ এত জনপ্রিয় হয়েছিলেন ও তার ধনী শিষ্য ও শিষ্যার সংখ্যা এত বেশী ছিল যে ইচ্ছে করলে তিনি বিলাস,বৈভবে দিন কাটাতে পারতেন। কিন্ত তিনি তা করেন নি।তার মূল লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষের কল্যাণ। এইজন্য বিদেশীদের কাছে হাত পাততে তিনি কুন্ঠাবোধ করেন নি।এইখানেই বিবেকানন্দ সাধারণের থেকে আলাদা।সাধারণ হয়েও অসাধারণ। বিবেকানন্দের মত এত নিবিড়ভাবে ভারতবর্ষকে কেউ প্রত্যক্ষ করে নি।ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে বিবেকানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা দুটি -অশিক্ষা ও দারিদ্র। বিবেকানন্দ এই সমস্যা সমাধানে বিশেষভাবে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন-"সাধারণ মানুষের টাকায় শিক্ষিত হয়ে যারা তাদের কথা ভাবে না , তাদের মত বিশ্বাসঘাতক আর কেউ নয়"।মানবপ্রেম ছিল তার ধর্মের মূল কথা।তাইতো তিনি বলেছিলেন "বহু রূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর/জীবে প্রেম করে যেইজন,সেইজন সেবিছে ঈশ্বর "।

মানুষের দুঃখে তার হৃদয় কাঁদতো বলেই পাশ্চাত্যের বিলাস-বৈভব তাকে আকৃষ্ট করতে পারে নি।জন্মভূমির প্রতিটি ধূলিকণায় তার কাছে ছিল পবিত্র। বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন সামাজিক সাম্য।শ্রেণীবিভাজন,ধন-সম্পদের বৈষম্য তার পছন্দ ছিল না।তিনি প্রকৃতই ছিলেন সাম্যবাদী।বিবেকানন্দ ধর্ম বলতে বুঝতেন সৎ কর্মকে।তিনি বাহ্যিক আড়ম্বরের চেয়ে অন্তরের পবিত্রতার ওপর বেশী জোর দিয়েছেন। তিনি বলতেন -"খালি পেটে ধর্ম হয় না।তাই ক্ষুধার্তকে অন্ন তুলে দেওয়াই ধর্ম"। অথচ আজকের দিনে দেশে কত বড়লোক আছেন ,কজন সমাজের হিতসাধনে এগিয়ে আসেন ?

পরাধীন ভারতবর্ষে বিবেকানন্দের লক্ষ্য ছিল ভারতবাসীকে আত্মবলে বলীয়ান করা।কেননা আত্মবলে বলীয়ান না হলে কোন জাতির উন্নতি হতে পারে না।বিবেকানন্দ বলতেন,পরাধীন ভারতবাসীর কাছে ধর্ম হলো দেশকে স্বাধীন করা।বিপ্লবীরা তার কথা শুনে ও বই পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু নিজে একথা স্বীকার করেছেন। বিবেকানন্দ বলতেন,"পৃথিবীতে যখন এসেছো,তখন একটা দাগ রেখে যাও"।বিবেকানন্দের ধর্ম মত ছিল উদার ও যুক্তিনিষ্ঠ।অথচ কেউ,কেউ বিবেকানন্দ কে বিশেষ একটি ধর্মের প্রচারক বলে সংকীর্ণতার বেড়াজালে তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করেছেন।

বিবেকানন্দ কোন একটি ধর্মের নন ,তিনি সবার।মনে রাখা দরকার তিনি হিন্দুধর্মের প্রবক্তা হয়েও বুদ্ধ,যিশুখ্রিস্ট ও হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে যে গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন তা তার অন্যতম প্রিয় শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতার বহু রচনাতেই পরিস্ফুট। আমেরিকার সানফ্রান্সিস্কোতে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন-"মোহাম্মদকে আমি প্রণাম করি।তিনিই প্রথম সাম্যের বাণী এনেছেন "।একই রকম ভাবে তিনি বলেছেন যদি আমি নাজারেথবাসি ঈশার সময় প্যালেস্টাইনে বাস করতাম তাহলে চোখের জলে নয় ,হৃদয়ের শোণিত দিয়ে তার পা দুখানি ধুয়ে দিতাম। বিবেকানন্দের এই চিন্তা নেতাজী বারবার তুলে ধরেছেন।যারা বিবেকানন্দকে একান্ত ভাবে হিন্দুধর্মের প্রবক্তারূপে শুধুমাত্র তুলে ধরেন,অথচ তার জীবনের অন্যদিক গুলি তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না তাদের উদ্দেশ্যেই হয়তো শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন-"তোমাদের চৈতন্য হোক "।

বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলতে গিয়ে যদি তার শরীর ও স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা না করা হয় তাহলে একটু ত্রুটি থেকে যাবে।স্বামীজী ছিলেন কর্মপ্রাণ মানুষ ও দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ। তাই তো জীবিত অবস্হায় নানারকম (প্রায় দশ-বারো রকম , পারিবারিক ডায়াবেটিস, অনিন্দ্রা,চোখেররোগ, পেটেররোগ, হার্টেররোগ ইত্যাদি) রোগে ভুগা সত্বেও নিজের কাজে ফাঁকি দেন নি।বরং যে অতিরিক্ত পরিশ্রম তিনি করতেন বা শরীরের উপর অত‍্যাচার করতেন তা দেখে ডাক্তাররা তাকে বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। কিন্ত তিনি বলতেন যে পরিমাণ কাজ তাকে করে যেতে হবে,তাতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। তিনি আক্ষেপ করে একটা সময় বলেছিলেন,আমি যে কাজগুলো করে যাচ্ছি আরেকটা বিবেকানন্দ থাকলে বুঝতে পারতো। এটা ঠিক স্বামীজী জানতেন পৃথিবীতে তার আয়ু বেশিদিন নাই। কাজেই যতটা সম্ভব দ্রুত তাকে কাজ করতে হবে।কেননা জীবনের মূল্য নিহিত আছে সৎ কর্মে।আর সৎ কর্মই হল প্রকৃত ধর্ম। বিবেকানন্দের স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। এ নিয়ে অনেক কাহিনী আছে।বিবেকানন্দ ছোটবেলা থেকেই ধ্যান করতে ভালোবাসতেন। এই ধ্যান তার একাগ্রতা শক্তিকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছিল। বিবেকানন্দের মানসিক জোর ছিল দেখার মতো।মানসিক শক্তির জন্যই তিনি সবরকম বাধাকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।

বিবেকানন্দ সকলের। যারা দেশকে ভালোবাসে,মানুষকে ভালোবাসে বিবেকানন্দ তাদের। আর যারা স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিবেকানন্দকে ব্যবহার করে,বিবেকানন্দ কখনোই তাদের নয়।তাই বিবেকানন্দকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে চাইলে আগে তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হতে হবে।আমাদের দেশে তার উল্টোটাই ঘটছে বলে সমাজের এত অবক্ষয়,এত দুর্নীতি।তার থেকে উদ্ধার পেতে গেলে দরকার এইরকম মনীষীদের জীবন চর্চা করা।তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে সমাজের জঞ্জাল সরাতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে-নচেৎ ভবিষ্যত কিন্ত ভীষণ অন্ধকারময়। তখন আমরা আমাদের উত্তরসূরিদের কাছে ও ক্ষমার অযোগ্য হয়ে উঠবো।তাই বিবেকানন্দ চর্চাই পারে আমাদের প্রকৃত পথ দেখাতে।

.    .    .

তথ্য সূত্র:

১)অচেনা -অজানা বিবেকানন্দ-শংকর২)ভারত নির্মাণ ও স্বামী বিবেকানন্দ-ড:মধু মিত্র

৩) বিশ্বের বিষ্ময় ভারত-সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ-শ্রী মধুসূদন

৪) বিড়ম্বনায় বিবেকানন্দ-কণাদ দাশগুপ্ত ও দেবাশিস পাঠক

৫) আমার ভারত-অমর ভারত-স্বামী বিবেকানন্দ

৬)বিবেকানন্দ ও যুবসমাজ-রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার

৭) স্বামী বিবেকানন্দ:জীবন ও দর্শন- পৃথ্বীরাজ সেন।

Discus