মানব সমাজে যুগে যুগে কিছু মানুষ জন্ম নেন, যাঁরা কেবল নিজেদের জীবনের জন্য বাঁচেন না; বরং তাঁদের জীবন হয়ে ওঠে মানবতার কল্যাণে এক উজ্জ্বল প্রদীপ। তারা জ্ঞানের আলো ছড়ান, মানুষের অন্তরে আধ্যাত্মিকতার মশাল জ্বালান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যান এক অমূল্য শিক্ষা। তেমনি একজন মহৎ ব্যক্তি ছিলেন ডা: মুনকির হোসেন। তিনি একদিকে ছিলেন খ্যাতিমান বৈজ্ঞানিক, অন্যদিকে ইসলামের একজন প্রকৃত সুফী খাদিম। তাঁর জীবন প্রমাণ করে, বিজ্ঞান, জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় মানুষের জীবনে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ডা: মুনকির হোসেন ছোটবেলা থেকেই ছিলেন জ্ঞানের প্রতি অগাধ অনুরাগী। তাঁর মনে বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন, অনুসন্ধান এবং গবেষণার অনেক আগ্রহ ছিল। বিজ্ঞানের রহস্য তাঁকে আকৃষ্ট করত এবং তিনি সেই আকর্ষণকে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়েছিলেন। তিনি বুঝতেন, সত্যিকার জ্ঞান কেবল পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ থাকলে তা অপ্রয়োজনীয়। প্রকৃত জ্ঞান হলো সেই, যা সমাজকে উন্নত করে, মানুষকে আলোকিত করে এবং আগামী প্রজন্মকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে। তাঁর গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের জীবনমান উন্নয়ন। তিনি বিজ্ঞানকে দেখতেন আল্লাহর একটি মহৎ দান হিসেবে। প্রতিটি আবিষ্কার তাঁর কাছে ছিল সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের একটি উপায়।
ডা: মুনকির হোসেন কখনোই বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে আত্মকেন্দ্রিক করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করা হলে তা সমাজের অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। তিনি নানা গবেষণা পরিচালনা করতেন যাতে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে। তাঁর দৃষ্টিতে বিজ্ঞান মানুষকে শেখায় কীভাবে প্রকৃতিকে জয় করা যায়, সমাজকে উন্নত করা যায়, কিন্তু এর সাথে যুক্ত হতে হবে মানবিক মূল্যবোধ। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। তিনি তাদের শুধু বৈজ্ঞানিক দক্ষতা শেখাতেন না, বরং নৈতিকতা, মানবিকতা এবং আধ্যাত্মিকতার গুরুত্বও বুঝাতেন।
ডা: মুনকির হোসেন ছিলেন একজন দূরদর্শী শিক্ষাবিদ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, কোনো দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয় যদি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে না দেওয়া হয়। তাই তিনি নির্দ্বিধায় নিজের ৭০ বিঘে জমি দান করেন একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য, যার নাম হয় দারুল হুদা। তাঁর এই জমি দান নিছক দান ছিল না; এটি ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক চিরস্থায়ী সম্পদ। তিনি মনে করতেন, জমি বা সম্পদ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরস্থায়ী। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের শুধু আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞানই দেননি, বরং নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিকতার দীক্ষাও দিয়েছেন।
ডা: মুনকির হোসেন ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। তিনি সবসময় নামাজে অনুগত ছিলেন এবং জীবনের কোনো ব্যস্ততা তাঁকে নামাজ থেকে বিরত করতে পারেনি। নামাজ তাঁর কাছে ছিল আত্মার প্রশান্তি, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার একমাত্র উপায়। তিনি সবসময় মানতেন শিক্ষা কেবল মেধা বিকাশের জন্য নয়, বরং হৃদয়কে মানবিক করার জন্যও অপরিহার্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান মানুষের দেহ ও মেধাকে শক্তিশালী করে, আর আধ্যাত্মিকতা মানুষের হৃদয় ও মনকে পূর্ণতা দেয়।
ডা: মুনকির হোসেনের কঠোর নৈতিকতা ও ইসলামের প্রতি অটল বিশ্বাসের একটি ঘটনা দারুল হুদা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একবার সেখানে একটি প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে ইসলামিক অনুষ্ঠানের নামে বাউল গান শোনা যাচ্ছিল। এটি শুরু হতেই ডা: মুনকির হোসেন রেগে গিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠেন— *“তোমরা ইসলামের সাথে খেলো না, যেমন বনী ইসরাইল নিজেদের আকীদার সাথে খেলেছিল।”* মুহূর্তেই হলঘর নীরব হয়ে যায়। যিনি গান করছিলেন, আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারেননি। চারপাশে এমন নীরবতা নেমে আসে যে কেউ তাঁর মুখের সামনে কিছু বলার সাহস পায়নি। এই ঘটনা প্রমাণ করে, তিনি ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে রক্ষা করতে কখনো আপোষ করেননি।
ডা: মুনকির হোসেন প্রমাণ করেছেন, একজন মানুষ একই সময়ে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং সুফী খাদিম হতে পারেন। বিজ্ঞান তাঁকে যুক্তি, বিশ্লেষণ এবং প্রগতির শিক্ষা দিয়েছে। সুফিবাদ তাঁকে দয়া, বিনয় এবং মানবসেবার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। নামাজ তাঁকে আধ্যাত্মিক শান্তি ও মানসিক শক্তি দিয়েছে। এই তিনটি গুণাবলীর সমন্বয়ে তিনি সমাজে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
ডা: মুনকির হোসেনের হাতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে। শিক্ষার্থীরা এখানে আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন করবে, নৈতিকতা, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার দীক্ষাও লাভ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি এমন একটি স্থান হবে, যেখানে মানুষ শিখবে কেবল পেশাগত সাফল্যের জন্য নয়, বরং একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং মানবসেবী মানুষ হওয়ার জন্যও। তাঁর এই উদ্যোগ সমাজকে দেবে আলোকিত নেতৃত্ব, যারা দেশ ও জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
ডা: মুনকির হোসেন আমাদের কাছে কেবল একজন বিজ্ঞানী নন; তিনি ছিলেন মানবতার সেবক, ইসলামের প্রকৃত সুফী খাদিম এবং শিক্ষার এক আলোকবর্তিকা। তাঁর নামাজনিষ্ঠা, ধর্মপ্রাণতা, দানশীলতা, দৃঢ় নীতিবোধ এবং মানবপ্রেম তাঁকে এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম চিরকাল অমর থাকবে। তিনি প্রমাণ করেছেন—বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও মানবসেবা যখন একত্রিত হয়, তখন একজন মানুষ প্রকৃত মহৎ হয়ে ওঠে। তাঁর জীবন আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, সমাজকে আলোকিত করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার এক চিরস্থায়ী শিক্ষা প্রদান করে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু সম্পর্ক আছে, যেগুলো শুধু দুইজন মানুষের বন্ধুত্ব নয়, বরং হয়ে ওঠে এক যুগের চিন্তা, বিশ্বাস ও আত্মত্যাগের প্রতীক। ডা. মুনকির হোসেন ও সাবির গফ্ফারির সম্পর্ক তেমনি এক অনন্য অধ্যায়। এ সম্পর্কের মূল উৎস ছিল জ্ঞান, বিশ্বাস ও মানবকল্যাণের প্রতি এক অভিন্ন দায়বদ্ধতা। বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার দুই ভিন্ন জগতের মানুষ হয়েও তাঁরা পরস্পরের জীবনে আলো হয়ে এসে ছিলেন একজন দাতা ও দিশারী, অন্যজন দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা।
ডা. মুনকির হোসেন ছিলেন বীরভূম জেলার ভূমিপুত্র, জন্ম তাঁর খুটকেইল নামের ছোট্ট এক গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন গভীর চিন্তাশীল, জিজ্ঞাসু এবং পরিশ্রমী। তাঁর চোখে পৃথিবী ছিল এক বিশাল গবেষণাগার, যেখানে প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি সৃষ্টিই ছিল আল্লাহর মহান পরিকল্পনার নিদর্শন। তিনি শিক্ষার হাত ধরে ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করেন এবং রসায়নে পিএইচডি ও পরে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ(PDF) পর্যন্ত গবেষণা সম্পন্ন করেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবন কখনো নিছক পরীক্ষাগারের সীমায় বন্দি ছিল না। তাঁর গবেষণার লক্ষ্য ছিল মানুষকেও বোঝা, মানুষকে উন্নত করা, আর আল্লাহর সৃষ্টির রহস্যের সন্ধান করা।
অন্যদিকে সাবির গফ্ফারি একবার কেরালায় গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন, যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো শুনেছিলেন "দারুল হুদা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি"-এর নাম। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে ধর্ম, বিজ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে সেখানে ছাত্ররা শুধু জ্ঞান নয়, নৈতিকতাও অর্জন করছে। সেই মুহূর্তেই তাঁর মনে এক স্বপ্ন জন্ম নেয়—যদি এমন একটি প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিষ্ঠা করা যেত! এই স্বপ্নই তাঁকে নিয়ে আসে ডা. মুনকির হোসেনের কাছে। তখন বছর ২০১০–২০১১। সাবির গফ্ফারি পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসে তাঁর বন্ধু নুরুল হুদা সাহেবের সঙ্গে এই চিন্তা ভাগ করেন। নুরুল হুদা বলেন, “আমি এমন একজন মানুষকে চিনি, যিনি এ কাজের জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসবেন — তাঁর নাম ডা. মুনকির হোসেন।”এই কথাটিই ছিল এক নতুন ইতিহাসের সূচনা। কিছুদিন পর তাঁরা ফোনে যোগাযোগ করেন। সাবির গফ্ফারি যখন মুনকির সাহেবকে বিস্তারিত জানান।পরবর্তী সময়ে, তাঁরা কেরালা থেকে আগত দারুল হুদার প্রতিনিধিদলকে পশ্চিমবঙ্গে আমন্ত্রণ জানান।
নির্দিষ্ট দিনে SKSSF দল বীরভূম জেলার ভিমপুরে উপস্থিত হয় তাদের মধ্যে ছিলো হায়দার আলী তাঙ্গাল সাহেব যিনি তখনকার ভয়েস চ্যান্সেলর ছিলেন এবং বাহাউদ্দিন উস্তাদ । সেখানে নামাজ আদায়ের সময় একটি ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়, কারণ কেরালার মানুষ সাধারণত শাফি মাজহাব অনুসরণ করেন, আর স্থানীয় মানুষজন হানাফি মাজহাবের। কিছু গ্রামের মানুষ ভাবেন, এরা হয়তো আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের, ফলে বিরোধ তৈরি হয়। কিন্তু সেদিন মুনকির হোসেন সাহেবের প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও মানবিকতার পরীক্ষার মুহূর্ত এসেছিল শান্ত কণ্ঠে বোঝালেন আমরা সবাই মুসলমান, মাজহাব ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ ও রাসূল আমাদের এক করে রেখেছেন, আমাদের লক্ষ্য বিভেদ নয়, বরং ঐক্য।তাঁর এই কথাগুলো যেন গ্রামবাসীর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে, গ্রামের মানুষ তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করে এবং সেই দিন থেকেই জমি দানের ব্যাপারে আলোচনার দ্বার খুলে যায়।
পরবর্তী কিছু মাস ধরে অনেক বৈঠক হয়, চিন্তা হয়, পরিকল্পনা হয়। ডা. মুনকির হোসেন ক্রমেই এই উদ্যোগে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত করে ফেলেন। তাঁর চোখে তখন ছিল একটাই স্বপ্ন এই বাংলার মাটিতে এমন এক প্রতিষ্ঠান হবে, যেখানে বিজ্ঞান ও ইসলাম হাত ধরাধরি করে চলবে; যেখানে ছাত্ররা যেমন রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিখবে, তেমনি কুরআনের আলোয় নিজেদের নৈতিকভাবে শুদ্ধ করবে।
অবশেষে তিনি তাঁর নিজের ৭০ বিঘে জমি দান করেন এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য। এই কথাটিই তাঁর চরিত্রের আসল প্রতিফলন। দান তাঁর কাছে ছিল না কোনো আত্মপ্রচার, বরং ইহকাল ও পরকালের জন্য সওয়াবের কাজ।তাঁর এই দানের ফলে পশ্চিমবঙ্গে “দারুল হুদা ইসলামিক কমপ্লেক্স” প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল শুধু একটি ভবন নয়, বরং এক আদর্শ, জ্ঞান, নৈতিকতা, বিনয় ও মানবসেবার এক প্রতীক।
এই পর্যায়ে সাবির গফ্ফারির ভূমিকা ছিল একজন স্থপতির মতো। তিনি সংযোগ ঘটিয়েছিলেন কেরালার দারুল হুদার সঙ্গে, এনেছিলেন শিক্ষাগত এক কাঠামো। তাঁদের সম্পর্ক ক্রমে পরিণত হয় আধ্যাত্মিক বন্ধনে। ডা. মুনকির হোসেনের চরিত্রে একটি অদ্ভুত ভারসাম্য ছিল যেটি আমাকে অনেক আকর্ষণ করেছিল। একদিকে তিনি আধুনিক বিজ্ঞানী — রাসায়নিক বিক্রিয়া, পরীক্ষাগার, সূত্র ও বিশ্লেষণের মানুষ, অন্যদিকে তিনি ছিলেন নামাজপ্রাণ, সুফিবাদে অনুপ্রাণিত এক খাদিম। তাঁর জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে আল্লাহর ইচ্ছাই ছিল মূল প্রেরণা। তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন, কোনো পরিস্থিতিতেই নামাজ ছাড়তেন না। অনেক সময় গবেষণার মাঝখানেও নামাজের সময় হলে। তাঁর এমন ঈমানদার স্বভাবের সাক্ষী ছিলেন তাঁর ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরাও যেমন আলতাফ হোসেন, আসিরুল ইসলাম, কাজিমুদ্দিন, ওবায়দুল হক, শায়েনশা মোল্লা, সোহেল মন্ডল, আসমাউল প্রমুখ।
একটি বিশেষ ঘটনা তার ছাত্র আলতাফ হোসেন বর্ণনা করেন, একদিন জনাজার নামাজে যাওয়ার সময় এক গ্রামবাসী মুনকির সাহেবকে তুচ্ছ করে বলেছিলেন, “সব করলেন, কিন্তু বিয়ে করলেন না কেন?”
তখন তিনি মৃদু হাসি দিয়ে শান্তভাবে বলেছিলেন, “এই কথাটাই না বললে ভালো হতো যেটি কাজ আছে সেটি বলো” তাঁর কণ্ঠে কোনো রাগ বা তিরস্কার ছিল না, বরং ছিল গভীর সহানুভূতি। এ দ্বারাই বোঝা যায় মানুষটি জবাব দিতে জানেন, কিন্তু কখনো কাউকে আঘাত করেন না।
মুনকির হোসেন সাহেবের আধ্যাত্মিক দিকের আরেক অধ্যায় হলো তাঁর সম্পর্ক হজরত হিলালউদ্দিন চিস্তি রহ.-এর সঙ্গে। একদিন তিনি চিস্তি সাহেবের দরগায় গিয়েছিলেন। দুপুরে খাবারের সময় হিলালউদ্দিন চিস্তি তাঁকে আহ্বান করেন একসঙ্গে ভোজে অংশ নিতে। কিন্তু মুনকির সাহেব বিনীতভাবে বলেন, “আমি আজ রোজা রেখেছি।”এই উত্তর শুনে চিস্তি সাহেব খুশি হয়ে দোয়া করেছিলেন তার জন্যে
সেদিন হয়তো সেই দোয়ারই বরকতে হয়তো মুনকির সাহেবের জীবনে এমন এক আলো ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে হাজারো মানুষের হৃদয় আলোকিত করে।
সময়ের সাথে সাথে দারুল হুদা পশ্চিমবঙ্গ একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাকেন্দ্রে রূপ নেয়। সেখানে শুধুমাত্র ইসলামি শিক্ষা নয়, আধুনিক বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্লাসও চালু হয়। এই মডেলটি কেরালার দারুল হুদার শিক্ষানীতি অনুসরণে গড়ে তোলা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির ছাত্ররা পরে...
এস কে এস এস এফ (SKSSF) -এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এই সংগঠন কেরালায় ধর্মীয় ও সামাজিক ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল, এবং পশ্চিমবঙ্গেও সেই আদর্শ ছড়িয়ে দিতে থাকে।তখন তার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট জ্ঞান, ধর্ম ও মানবতার সমন্বয় ঘটানো।
SKSSF (Samastha Kerala Sunni Students Federation) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, কেরালার কোঝিকোড় জেলার জামোরিন হাই স্কুলে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক সম্মেলনে।
উদ্বোধন করেন কে.ভি. মোহাম্মদ মুসলিয়ার কুত্তানাদ, সভাপতিত্ব করেন কে.কে. আবুবকর হযরত, আর সেই সম্মেলনই কেরালার ছাত্র সমাজে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।এর মূল দায়িত্ব ছিল সমাজে ইসলামী নীতি, মানবিকতা ও সেবার ধারাকে শক্তিশালী করা।এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামী শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করা, তরুণ সমাজকে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ করা, সমাজে বিভাজন ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে যুক্তি, শান্তি ও নৈতিকতার মাধ্যমে গড়ে তোলা। মুনকির হোসেন ও তাঁরা চেয়েছিলেন এমন এক সমাজ, যেখানে ছাত্ররা শুধু পরীক্ষায় পাস করবে না, বরং মানুষের জীবনে আলোর দিশা দেখাবে।
বর্তমান যুগে শিক্ষা ও নৈতিকতার মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। জ্ঞান অর্জনের দৌড়ে মানুষ যতই অগ্রসর হচ্ছে, নৈতিক মূল্যবোধ ততই পিছিয়ে পড়ছে। এই কারণে দক্ষিণ ভারতের কেরালায় এমন এক সংগঠনের জন্ম হয়, যার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে এক আদর্শ প্রজন্ম তৈরি করা। এই সংগঠনটির নাম “SKSSF” — সম্পূর্ণ রূপে “Samasta Kerala Sunni Students Federation”।
SKSSF প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, কেরালার প্রখ্যাত ইসলামিক সংগঠন “Samastha Kerala Jamiyyathul Ulama” -এর ছাত্র শাখা হিসেবে। এর জন্ম হয়েছিল এমন এক সময়, যখন তরুণ সমাজ বিভ্রান্তিকর চিন্তা ও নৈতিক অবক্ষয়ের পথে এগোচ্ছিল। সেই সময় একদল ইসলামপ্রাণ আলেম উপলব্ধি করেন যে, ছাত্রসমাজকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হলে তাদের জন্য একটি শিক্ষিত ও নৈতিক ভিত্তিসম্পন্ন সংগঠন গঠন করা জরুরি। এই চিন্তা থেকেই SKSSF-এর সূচনা।
শিক্ষাক্ষেত্রে SKSSF-এর আরেকটি বড় ভূমিকা হলো তরুণদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তোলা এবং বিভ্রান্তিকর মতবাদের বিরুদ্ধে সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা। সংগঠনটি তরুণদের শেখায় কীভাবে ইসলামী নীতিতে থেকে আধুনিক জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যায়। এভাবেই তারা প্রমাণ করেছে যে ইসলাম কেবল নামাজ-রোজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি জীবনযাপনের একটি পূর্ণাঙ্গ পথনির্দেশ।
আজ SKSSF শুধু একটি সংগঠন নয়, বরং এক আদর্শ আন্দোলন। তারা প্রমাণ করেছে যে একজন ছাত্র কেবল বইপড়ুয়া নয় সে সমাজের নৈতিক দিকনির্দেশকও হতে পারে। তাদের কর্মকাণ্ড কেরালার সীমানা ছাড়িয়ে প্রবাসী দেশেও পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল যুগে তারা “Digital Da’wah” বা অনলাইন প্রচারের মাধ্যমেও ইসলামি বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।