Source: Dan Farrell on Unsplash

শিল্প যা শুধু চোখ দিয়ে দেখা যায় না, যাকে অনুভব করতে হয়। “আমার শিল্প” “তোমার শিল্প” সবই আলাদা, সব শিল্পীরই নিজস্ব জগত আছে। কিন্তু অনুভব করলে বঝা যায়, শিল্প এক ও অদ্বিতীয়- শিল্প হল মহাশিল্পী সেই পরম্ ব্রহ্মের লীলাখেলা। শিল্পকে আমরা আমাদের মনোরঞ্জন এবং বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশের জন্য ব্যাবহৃত হতে দেখে থাকি। কিন্তু শিল্পী জানে, শিল্প অনুভূতি প্রকাশ বা মনোরঞ্জনের জন্য নয়,শিল্প শিল্পের জন্য ,শিল্প সাধনার জন্য।সৃষ্টির আদিতত্ত্বকে কি আজ পর্যন্ত আমরা উদ্ঘাটন করতে পেরেছি? না। তাহলে কি করে শিল্পকে অনুধাবন করতে পারব? শিল্পের য বিভিন্ন বিভাগ আমরা করেছি, যথা –অঙ্কন ,সাহিত্য সংগীত ,নৃত্য তা কিন্তু ওতপ্রোতভাবে একে অপরের সাথে জরিয়ে আছে। যেমন একজন নৃত্যশিল্পী তাঁর অঙ্গভঙ্গি দিয়ে সারা মঞ্চ জুড়ে যে দৃশ্য তৈরি করে তা পটে আঁকা চিত্রের সমতুল্য। আবার সেই চিত্রের অর্থ বুঝতে গেলে ,তাকে একাত্ম করতে গেলে দরকার সাহিত্যচর্চার। সাহিত্যচর্চা করতে গিয়েই শিল্পী ধরে কলম যাতে আবার কোন শিল্পী সুর দিয়ে সৃষ্টি করে সঙ্গীতের। আবার সঙ্গীত বা সাহিত্য কে পটভূমিতে রেখেই নৃত্য দেখতে আমরা অভ্যস্ত, নয়তো নৃত্যের ভঙ্গিমা একাত্ম করার ক্ষমতা আমাদের হয়না। এই কথাগুলি হয়ত বাস্তবতাহীন অবিবেচকের মত কথাবার্তা, হয়ত এই কথাগুলো উপলব্ধি করার স্পর্ধা আমাদের নেই, তবুও এটাই সত্যি যে , একজন মানুষ যখন শিল্পের জগতে প্রবেশ করবে তখন সে এই বাস্তবতা বিবেচনাহীন কথাগুলোকেই বাস্তব বলে গ্রহন করবে। সে বলবে হ্যাঁ, শিল্প কোন একটি জিনিস বা বিভাগ নয়; এটাই সৃষ্টি ,আদিতত্ত্ব, আর যদি একে ধ্বংস বলে কেউ মনে করে তাহলে বলা ভালো যে এই ধ্বংস নতুন সৃষ্টির অগ্রদূত।

কেন? কারণ পৌরাণিক কাহিনী পড়লে জানা যায় যে আদিশক্তি থেকেই শিল্পের উৎপত্তি। এহেন শিল্প নেই যা তাঁর অগোচর। আদি শক্তি আবার সৃষ্টিধ্বংসের লীলেখেলায় মত্ত। তবে তাঁর ধ্বংসের রূপক “তাণ্ডবনৃত্য” এক মহাশিল্প যা শিবপারবতীর মহামিলন তথা রুপ রস গন্ধ, নদী জল ফুল ফলে ভরা সতেজ প্রকৃতি সৃষ্টির কারণ।তাহলে যে শিল্প অবিভক্ত শক্তির থেকে সৃষ্ট তা বিভক্ত হয় কিভাবে?

যে শিল্প থেকে প্রকৃতির সৃষ্টি তার নান্দনিকতা অবিশ্বাস্য, যা অনুভব করা অনস্বীকার্য। এ তো সেই মহাশিল্পীরই দেয়। একইসাথে সে সৃষ্টি করে রেখেছে রং সুর ভাষা ,একই ক্যানভাস এ। শিল্প এক আশ্চর্য শক্তির রূপক, আর আমরা সেই শিল্পকর্মের রং সুর ভাষা। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে রয়েছে শিল্পের ছোঁয়া। কিন্তু এই শিল্পত্ত কে অতীব করে আমরা দিয়েছি মহাশিল্পীর শিল্পকর্মে হাত, করেছি যথেচ্ছ কাঁটাছেঁড়া, নতুন কিছু গড়ার আশায়। পারিনি বরং বলা ভালো ব্যর্থ হয়েছি, আর ব্যর্থ হয়ে বেছেছি শিল্পের ধ্বংসীকরনের পন্থাকে। মহাশিল্পীর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করেছে এক অতুলনীয় শিল্প, কিন্তু আমরা যে ধ্বংসলীলায় মেতেছি তার তল আজও খুঁজে পাইনি। প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি আমরা মহাশিল্পীর থেকে জন্ম নেওয়া ক্ষুদ্র শিল্পী, সত্যি কি সে যোগ্যতা আমাদের আছে? তাহলে ধ্বংসের তল পাচ্ছি না কেন? কেন স্বাকারাত্মক শিল্পকে পৌঁছে দিচ্ছি নাকারাত্মক শক্তির কাছে? শিল্পকে বুঝতে শিখছি না কেউ, শুধু হাতরে বেড়াচ্ছি কামনা পূরণের আশায়। শিল্প যদি সত্যি মহাশিল্পীর হয়, আর যদি তা আমরা উপলব্ধি করে থাকি তবে যে শিল্পকে ধ্বংসের পথে আমরা নিয়ে গেছি সেই শিল্প থেকেই আমরা আবার সৃষ্টি করব নান্দনিকতা, অতুলনীয়তা, অবিশ্বাস্যতা, যাতে এতদিন ধরে পরম্ব্রহ্ম কে অবমাননা করার প্রায়শ্চিত্ত আমরা করতে পারি।

চরম যান্ত্রিকতার যুগে শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র স্বপ্নের অভাবে। স্বপ্নও হচ্ছে অর্থযুক্ত। সেই বাঁধনছাড়া অর্থহীন স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে চাওয়া পাওয়ার হিসাবের অতল তলে। আগের অর্থহীন স্বপ্নই আমাদের কল্পনা করতে শেখাত রাজপুত্র, ভ্রমররুপী রাক্ষস ,পক্ষীরাজ ঘোড়াদের অস্তিত্ব। তার সাথে ছিল আমাদের ঠাকুমার ঝুলি। কেন জানি না আজ শুধু আমার তোমার সংসার আমাদের উত্তরপুরুষ দের করে তুলছে যান্ত্রিক ও স্বপ্নহীন। তাদের মধ্যে কল্পনা ,স্বপ্ন নয় ,বিরাজ করে বিলাসিতা। তারা শিল্পী হতে চায় শুধু বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য। আমরা শিল্প কে প্রথমে শিল্প ও পরে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসাবে দেখেছি আর আজ আমরা শিল্পকে দেখছি কামনাপুরনের পণ্য হিসাবে।

শিল্পকে শুধুমাত্র ব্যাবসা হিসাবে না দেখে দেখিনা নিজের সুক্ষ ও স্থুল শরীরের অংশ হিসাবে। দেখিনা আবার সেই অর্থহীন স্বপ্ন। যাই না ঠাকুমার কাছে তার ঝুলি থেকে বের করে আনতে পক্ষীরাজ ঘোড়া ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী কে। আমরা তো মহাশিল্পীরই অংশ, তাই করিই না চেষ্টা শিল্পকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করার। তাতে হয়ত একটা জন্ম শেষ হবে।

শিল্পকে বুঝতে গেলে একটা কেন, শতজন্মও কম পরবে।কারন সত্যিই যখন কেউ শিল্পকে অনুভব করবে, সেই অনুভূতি অনুভব করার অনুভূতিটিই তার থাকবে না। উত্তরসুরীরা হয়ত জানবে এক মহান শিল্পীর কথা কিন্তু সেই শিল্পী জানবে না তার শিল্পী হওয়ার কথা। সে শুধু একাত্ম হবে মহাশিল্পীর সাথে, উড়াবে মহাজাগতিকতার জয়ধ্বজা। সে জানবে না “সে” কে? শুধু শিল্পের ছোঁয়ায় স্নিগ্ধ করে যাবে প্রতিদিনের যান্ত্রিক রোজনামচায় ভরা জীবন। একঘেয়েমি দূর করার জন্য দিয়ে যাবে রং সুর ভাষায় ভরা সবুজ সতেজ স্বপ্ন।

তবু বলি, এত কিছুর মাঝেও শিল্পকে বোঝার বা ব্যাক্ত করার স্পর্ধা আমার তো নেইই, বিশ্বাস এই যে খুব কম মানুষেরই আছে। শিল্প সম্বন্ধে যতটুকু বললাম তা নিমিত্তমাত্র। আসলে শিল্প ভাবনারও অতীত।

.    .    .

Discus