Image by Mudassar Iqbal from Pixabay

যদি বলা হয় আমরা কেউই শিক্ষিত নই ,তাহলে তা কি খুব ভুল বলা হবে? উত্তর হল," না"!

কারণ যে কোন মানুষের পরিচয়ের মাপকাঠি যদি তার শিক্ষা দ্বারা নির্ণীত হয় ,তাহলে আমার মতে বলে যে, যে কোন শিক্ষার মাপকাঠি সেই জায়গার সংস্কৃতির দ্বারাই নির্ণীত হয়।এই তথ্য অনুযায়ী ভারতীয় মানুষের পরিচয় বর্তমানে মাপকাঠির নীচের দিকে বিরাজ করছে। এই কথাটি যতই কঠিন বলে মনে হোক না কেন; এটাই সত্য ,এটাই বাস্তব। একটা বক্তব্যকে যখন সত্য বলে গণ্য করা হয় তখন তার পেছনে প্রচুর যুক্তি থাকে এবং সেই যুক্তির সত্যতা যাচাইয়ের পরই বক্তব্যটির সততা প্রমাণ করার প্রক্রিয়া

শুরু হয়।এখন এই বক্তব্যকে বাস্তব সত্য মানার সপক্ষে যদি কোন প্রমাণ রাখতেই হয় আমি সর্বপ্রথম যে যুক্তিটি তুলে ধরতে চাই তা হল আমাদের বর্তমান মানসিকতা ও তার পেছনে নিজেকে লুকিয়ে রাখা বিশালাকার রাজনীতি। স্বাধীনতার পর আমদের শিক্ষাব্যাবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ যে কাজটি করেছেন তা হল শিক্ষা থেকে সংস্কৃতিকে বিরত করেছেন। অথচ যাদের কবল থেকে আমাদের সংস্কৃতি উদ্ধার করার জন্য প্রকৃত শিক্ষিত ব্যাক্তিগন তাঁদের সর্বস্ব উজাড় করেছেন তাঁদেরই কোন স্থান থাকেনি শিক্ষ্যাব্যাবস্থার সঠিক মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে,বরং বিদেশী রাজনৈতিক দল তাঁদের অনেক বেশী সম্মানের যায়গা দিয়েছে। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রানাথ ঠাকুর আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থার পাঠক্রমে শিল্পকে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন কিন্তু অসমর্থ হন। এদিকে বিদেশগুলি আমাদের ভারতের সংস্কৃতির চর্চা করে

আজ অনেক এগিয়ে। আর আমরা ভেবে চলেছি যে হয়ত বিদেশী শিক্ষার মূল্য অনেক বেশী। তাইত আজ যেকোনো যায়গায় মানুষের স্ট্যাটাস, শিক্ষা সবই নির্ভর করে ইংরাজি শিক্ষার দক্ষতার উপর। এই বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে যে হয়ত ইংরাজি ভাষা চর্চায় আমার বিশেষ দক্ষতা নেই বলে আমার এত রাগ। কিন্তু ব্যাপার তা নয়। আমার ইংরাজি ভাষার সাথে ব্যাক্তিগত কোন শত্রুতা নেই। আমার দর্শন এটাই যে, একটা ভাষা কেন শিক্ষা এবং শিক্ষাগত ভবিষ্যতের উপর একছত্র অধিকার জারি করবে। ইংরাজি ভাষা চর্চাতে কোন দোষ নেই, দোষ হল ইংরাজি ভাষাকে সর্বেসর্বা করে দেখাতে।আজ ইংরাজি ভাষা না জানার জন্য আমরা যে হীনমন্যতায় ভুগি বা যেভাবে ব্যাঙ্গক্তির স্বীকার হই তা কিন্তু আমাদের সংস্কৃত ভাষা না জানার জন্য হওয়া উচিত। অথচ সংস্কৃত তো দূরের কথা আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকেই সঠিক ভাবে আমাদের মধ্যে রোপণ করতে পারিনি। যেখানে মাতৃ ভাষাই শেখার সামর্থ্য আমাদের নেই সেখানে ভাষার জননীকে অনুরণন করা তো ভস্মে ঘী ঢালার সমান। আজ সবদিকে এগিয়ে থাকার যায়গায় বাঙালি সব যায়গায় পিছিয়ে। তার একমাত্র কারণ বাঙালি নিজের অস্তিত্ব স্বীকার করতে নারাজ। বাঙালি বাংলা না জানলে লজ্জা পায়না। কিন্তু আমরা যদি ভারতেরই অন্যান্য রাজ্য গুলিকে দেখি তাহলে দেখব তারা কিন্তু নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি সমস্ত কিছুকে সবার আগে রেখে তারপর দ্বিতীয় শিক্ষার কথা ভাবে, তাতে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বাল হোক বা অন্ধকার। কিছু বাঙালি আজও রবিঠাকুর বিদ্যাসাগার বিবেকানন্দ নেতাজি এঁদের পথ অনুসরন করতে চায় কিন্তু সেক্ষেত্রে সে বিভিন্ন প্রতিকুলতার সম্মুখীন হয়। অনেকে সেই প্রতিকুলতা কাটিয়ে ওঠে অনেকে অসমর্থ হয় কিন্তু তারা চেষ্টা করে নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতি কে সবার আগে রাখার, যে রক্ত যে মেধা যে সময় যে পরিশ্রম ব্যায়িত হয়েছে তার সঠিক মূল্যায়ন করার। শুধু ভাষা কেন শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্য পুরাণ মহাকাব্য সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রে ভারত তথা ভারতের শুধুমাত্র বাঙ্গালী সম্প্রদায় অজ্ঞ। হাতেগোনা গুটিকয়েক বাঙালী বলতে পারবে এর তাৎপর্য ; অন্তত বলার চেষ্টা করবে।

সব থেকে অবাক লাগে বাঙালী সমস্ত জাতি ধর্ম দেশ বিদেশের শিক্ষা সংস্কৃতি সবকিছুকে আপন করে নিতে পারে, পারেনা শুধু নিজ সম্প্রদায়ের সাথে একতা বজায় রাখতে। নিজের মাতৃভাষাকে সঠিক মর্যাদা দিতে। আমরাই আমাদের পরের প্রজন্মকে ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তৎপর, সেই পরিস্থিতির সূচনা কেন সেই বিষয়েও আমাদের একটু দৃষ্টিপাত করা উচিৎ। আমরা যারা বাংলাভাষাকে আপন করে নিয়েছি তারা কেউই কিন্তু প্রতিজগিতামুলক পরীক্ষা বা অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে সেরকম জায়গা করে নিতে পারিনি। কারণ আমাদের গোঁড়ায় গলদ। যত বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তারা ইংরাজি ভাষাকেই একমাত্র কথোপকথনের মাধ্যম হিসাবে তকমা দিয়ে রেখেছে। আর আমরাও সেটাকে মেনে সেই ছাঁচে নিজেদের গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে উঠেছি। আমাদের বিদ্যালয়ে পাঠক্রমে ইংরাজি ভাষাকে তো অপরিহার্য করে রাখা হয়েছে কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা গুলি শুধু পরতে জানলেই অনেক। ইংরাজি মাধ্যমে শিক্ষায় সমস্ত বিষয় ইংরাজি এমনকি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরাজি একমাত্র মাধ্যম। এই উচ্চশিক্ষায় যদি আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার থাকত তাহলেই আমাদের মানসিকতার এই পরিণতি হত না। হিন্দি ভাষা রাষ্ট্রভাষার খেতাব পেল কিন্তু বাংলা বা কোন অন্য আঞ্চলিক ভাষা নয়। এর পেছনে তো বিশাল বড় রাজনীতি রয়েছে। আসল বক্তব্য শিক্ষায় যখন রাজনীতির প্রবেশ ঘটল তখন থেকেই শিক্ষার লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটল। শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানোর পরিবর্তে মানুষকে অনেক বেশী যান্ত্রিক করে তুলতে লাগল।

এখন আমরা যতই চেষ্টা করি , শিক্ষা সম্পর্কে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে গেলে অনেক বড় বিপ্লব দরকার। দরকার রবিঠাকুরের, দরকার স্বামীজির। তাহলেই শিক্ষার উদ্দেশ্য বদলাবে। আমাদের শিক্ষা বদলাতে গেলে আবার প্রচার পেতে হবে রামায়ণ মহাভারত গীতার, জানতে হবে গুরুকুলকে। তাহলেই একমাত্র যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি সম্ভব। মনুষ্যত্ব তখনই ফিরবে যখন শিক্ষায় থাকবে না রাজনীতির প্রভাব। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষার সঞ্চার না করে আমরাই যদি তাদেরকে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করাই তাহলে হয়ত একদিন আমাদের বাংলা আমাদের ভারত শিক্ষার মাপকাঠির সর্বচ্চো স্থানে বিরাজ করবে।

.    .    .

Discus