Source: Keith Johnston from Pixabay 

একাশিতম সন্তোষ ট্রফির প্রথম সেমিফাইনালে আজ সল্টলেক যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে একত্রিশবারের চ্যাম্পিয়ন বাংলার মুখোমুখি হতে চলেছে দক্ষিণ ভারতের শৈল্পিক ফুটবলের ফেরিওয়ালা কেরালা। গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচ থেকেই দর্শনীয় ফুটবলের এক স্মরণীয় নিদর্শন এবছর রেখে চলেছেন বাংলার ফুটবলাররা। একচ্ছত্র আধিপত্যের সাথে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন পরপর প্রতিটি ম্যাচেই। যুবভারতীর সবুজ গালিচা জুড়ে যেন তাই বাহারি ফুলের মেলা --- সৌজন্যে বাংলা ফুটবলের ড্রিম ইলেভেন। চার ম্যাচে সাত গোল করে নীলাদ্রি সেন ইতিমধ্যেই গোল্ডেন বুটের খুব কাছাকাছি। স্বপ্নের ফর্ম যেন বাঁধা পড়েছে তার ধারালো দুই পায়ে। হ্যাটট্রিকসহ চার গোলে কোয়ার্টার ফাইনালে একাই ছিন্নভিন্ন করেছেন প্রবল শক্তিশালী পাঞ্জাবকে। এবার তিনি ফুটছেন কেরল বধের অপেক্ষায়। আর মাত্র কয়েক মিনিটের কাউন্টডাউন। শুরু হতে চলেছে মহারণ।

নীলাদ্রির এই চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্সের খবরে ইতিমধ্যেই আলোড়ন পড়ে গেছে গোয়ায় , ভারতীয় দলের জাতীয় শিবিরে। আগামী মাসেই মেন ইন ব্লু এএফসি কাপের ম্যাচ খেলতে উড়ে যাচ্ছে লেবানন। নানান পারমুটেশন কম্বিনেশনে দল সাজানোর পরও স্ট্রাইকিং জোনে কিছুতেই যেন ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে না ভারত। স্বভাবতই চিন্তার ভাঁজ কোচ বব হাউটনের কপালে। মিডিয়া মারফৎ নীলাদ্রির গোলের ক্লিপিংস দেখামাত্রই স্ট্রাইকার সমস্যার সমাধানে তড়িঘড়ি প্র্যাকটিস স্থগিত রেখে তিনি ঘাঁটি গেড়েছেন কলকাতায়। পরবর্তী ম্যাচগুলোতে সামনাসামনি পরখ করে নিতে চাইছেন নীলাদ্রিকে। সফল হলেই লেবানন সফরে সোজা সুনীল ছেত্রীর পাশে।

রেফারির লম্বা বাঁশির সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল আজকের রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ। প্রথম মিনিট থেকেই কেরালার মুহুর্মুহু আক্রমণের ঝড়ে রীতিমতো দিশেহারা বাংলা। রক্ষণ ও গোলকিপারের ভুল বোঝাবুঝির সুযোগে ম্যাচ শুরুর মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এক গোলে এগিয়ে গেল আইএম বিজয়নের রাজ্য। কেরালাইট উইঙ্গারদের বুলেট দৌড় আর একের পর এক বারুদ শটে তখন রীতিমতো নাভিশ্বাস দশা বাংলার রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের। এরই মাঝে ম্যাচের গতির বিরুদ্ধে বিপক্ষ বক্সের বেশ কিছুটা বাইরে ফ্রিকিক পেল বাংলা। মিডফিল্ডার প্রীয়নকে অবৈধভাবে সেখানে বাধা দিয়েছিলেন ভিপি সুহের। বল বসিয়ে নিয়েছেন বাংলার অধিনায়ক রাহুল। কেরালার মানবপ্রাচীরও প্রস্তুত। বেশ কিছুটা ছুটে এসে সোয়ার্ভিং শট রাখলেন স্বপ্নের ফর্মে থাকা নীলাদ্রি আর গোলকিপারকে বোকা বানিয়ে বল জড়িয়ে গেল জালে। পিছিয়ে পড়া বাংলা সমতা ফিরিয়ে আনলেও ম্যাচের রাশ তখনও কেরালার পায়ে। বিনীথের নেওয়া দুরন্ত কর্নার কোনোক্রমে ক্লিয়ার করলেন বাংলার নির্ভরযোগ্য স্টপার দীনেশ। ছিটকে আসা বল পায়ে ডানপ্রান্ত ধরে প্রাণপণ দৌড় নীলাদ্রির। আউটসাইড ডজে মাটি ধরালেন বিপক্ষের স্টপারকে। সামনে বিশাল অরক্ষিত জমি। বক্সের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন কেরালার গোলকিপার। অ্যাঙ্গেলটা ছোট করার চেষ্টা করছেন তিনি। মুখোমুখি সংঘর্ষ! তীরবেগে ছুটতে থাকা নীলাদ্রি ছিটকে পড়লেন প্যাকিং বাক্সের মতো। ইতিমধ্যেই বলটা তিনি ঠেলে দিয়েছেন গোলের ঠিকানায়। নীলাদ্রির একক দক্ষতায় বাংলা এগিয়ে গেল ১-২ গোলে। বিপজ্জনক বাধাদানের কারণে রেফারি লালকার্ড দেখালেন কেরালার গোলকিপারকে। জ্ঞান হারিয়ে মাঠের একপাশে লুটিয়ে পড়েছেন নীলাদ্রি। ম্যাচের দিকে তার আর কোনো হুঁশ-ই নেই।

অনেক সময় আকস্মিক জোরালো আঘাতে মানুষ সব ভুলে যায় ক্ষণিকের জন্য কিংবা চিনে উঠতে পারে না কাউকে --- জ্ঞান ফেরার পর নীলাদ্রিরও মনে হল ঠিক সেটাই। মাঠে বিপক্ষ গোলকিপার ভিগনেশের সাথে সজোরে ধাক্কা অবধি সমস্ত কথা মনে থাকলেও তারপরের স্মৃতিগুলো পুরোপুরি ধোঁয়াশা। অনেক চেষ্টার পরও উদ্ধার হল না কিছুই। ভিগনেশের ডান হাতটা সোজা এসে লেগেছিল নীলাদ্রির বুকে। ঊরুর ঊর্ধ্বভাগ আঘাত করেছিল তলপেটে। তারপর সব পুরোপুরি ঝাপসা। তাহলে কি চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠল সে! কিন্তু পরিচিত কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছে না আশেপাশে। ভীষণ ঠান্ডা এই ঘরটা যেমন নিশ্চিতভাবেই তার বেডরুম নয়, তেমনি হসপিটালের মতোও তো মনে হচ্ছে না ঠিকঠাক। আশেপাশে অক্সিজেন কিংবা স্যালাইন --- দেখা মিলছে না কিছুরই। ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা মখমলি বিছানাটা মাখনের থেকেও বেশি নরম। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে অজস্র বুট, ফুটবল, সিনগার্ড। শূন্য ঘরে চারিদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল কাঁচের দরজায়। মৃদু ঠেলে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন চারজন। তাদের পোশাক কিছুটা ডাক্তারের মতো হলেও গলায় ঝুলছে না কোনো স্টেথোস্কোপ। নীলাদ্রিকে উঠতে দেখে কাছে এগিয়ে এলেন একজন। খর্বকায় চেহারা। হাতে একটা বই। ভদ্রলোকের চেহারাটা নীলাদ্রির ভীষণ চেনা লাগলেও মনে করতে পারল না কিছুতেই। মৃদু হেসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন --- " এখন কেমন লাগছে, নীলাদ্রি?"

কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে পাল্টা প্রশ্ন করল সে --- " আমি কোথায়? এটা কোন হাসপাতাল? কে আপনারা? "

"এটা হাসপাতাল নয়। তুমি এখন ব্রহ্মাণ্ডের বৃহত্তম মানব পুনর্নির্মাণ কেন্দ্রের গৌরবময় ক্রীড়া শাখায় আছো ,নীলাদ্রি। "

দুর্বোধ্য শব্দগুলোর মাথামুন্ডু কিছুই উদঘাটন করতে পারল না ছেলেটা। কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখে মৃদু হেসে তার দিকে এগিয়ে এলেন আরেকজন। মাথার সামনের দিকে টাক, সুবিশাল ভুঁড়ি, পরনে জার্সি আর হাফপ্যান্ট --- চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট হলেও মুখে যেন আত্মবিশ্বাসের সোনালি রেখা। চোখদুটো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে অপরিসীম প্রজ্ঞার ছটা। নীলাদ্রির মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন --- " আমায় চিনতে পারছো বাবা? "

"না! মানে কোথায় যেন দেখেছি! কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না।"

"আচ্ছা বাবা! তবে আমি কে সেটা বলার আগে কিছু ঘটনা অবশ্যই তোমায় জানানো দরকার। তাতে তোমার মনের অন্ধকার খানিকটা হলেও দূর হবে। সাহস পাবে তুমি।"

আলতো করে নীলাদ্রির হাতটা ধরে ওকে বিছানা থেকে নামিয়ে আনলেন সেই ভদ্রলোক। সস্নেহে নিয়ে গেলেন পাতলা পর্দায় ঢাকা ধবধবে সাদা দেয়ালটার সামনে। ডান হাতের নরম টোকায় দুলিয়ে দিলেন পর্দাটাকে। সাথেসাথেই এক রুদ্ধশ্বাস সিনেমা যেন চলতে শুরু করল সেখানে ---

দীনেশের ক্লিয়ার করা বল নিজেদের অর্ধে ধরে প্রবল বেগে ছুটতে শুরু করেছে নীলাদ্রি। আউটসাইড ডজে ছিটকে ফেলে দিল বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে। সামনে শুধু গোলকিপার ভিগনেশ। সেকেন্ড ডিভিশন আই লিগে একই ক্লাবে খেলেছে ওরা দুজন। ডানহাত দিয়ে বুকে ধাক্কা মেরে নীলাদ্রির গতি রোধ করল ভিগনেশ। বল জড়িয়ে গেল জালে। মাঠের একপাশে লুটিয়ে পড়েছে নীলাদ্রি। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে সোজা হাসপাতাল। ভেন্টিলেশন। অবশেষে ডাক্তারবাবু সাদা কাপড়ে ঢেকে দিলেন ওর দেহ। নীলাদ্রির মা ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। বাইরে হাজির সতীর্থ ফুটবলাররা। শববাহী গাড়িতে করে নীলাদ্রির দেহটাকে আনা হল শ্মশানে। বেশ কিছু রিপোর্টারও ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছেন সেখানে। দেহটা গাড়ি থেকে বের করে চিতার ওপর রাখল বাংলা দলের সতীর্থ ফুটবলাররা। একগুচ্ছ পাটকাঠির ডগায় আগুন জ্বালিয়ে ক্রন্দনরত নীলাদ্রির মা অবিন্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন চিতার দিকে। আগুন ছোঁয়াতে আর মাত্র পা দুয়েক বাকি।

"স্টপ ইট। এসব আজগুবি গল্প কোথায় পেলেন আপনারা? কিসব দেখাচ্ছেনটা কী? কেন এভাবে আটকে রেখেছেন আমাকে? কেন দেখাচ্ছেন এসব ভুলভাল জিনিস? " --- দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর চেঁচিয়ে ওঠে নীলাদ্রি।

"অপ্রিয় হলেও যা দেখলে সেটাই সত্যি বাবা।"

"মানে? আমি মৃত? আগুনে পুড়ছি? "

"ইয়েস! ইউ আর ডেড নাও , মাই সন। তোমার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারলেও নিরূপায় আমরা। হাত-পা বাঁধা আমাদের।"

"ও ! তাহলে বলতে চাইছেন যে আমি মরে গেছি? বেঁচে নেই আমি? তাহলে এটা কে দাঁড়িয়ে আছে আপনাদের সামনে? ভিডিওটা কে দেখল? এতক্ষণ ধরে আপনার সঙ্গে কে কথা বলে চলেছে ? বলুন কে কথা বলছে? উত্তর দিন, তাহলে আমি কে! "

"আমি এতক্ষণ ধরে কথা বলছি বর্তমান বাংলা দলের সবথেকে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার নীলাদ্রি সেনের সঙ্গে। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া যার কাছে ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু গতকাল কেরালার বিরুদ্ধে ম্যাচ চলাকালীন দুর্ভাগ্যবশত একটা সংঘর্ষে মারা গেছে নীলাদ্রি আর আজ সে উপস্থিত মানব পুনর্নির্মাণ কেন্দ্রে আরও কয়েক কোটি মৃত ব্যক্তির সঙ্গে।"

রাগে গজগজ করতে করতে বিছানায় এসে বসে পড়ল নীলাদ্রি। ম্যাচ চলাকালীন আঘাত তো সে পেয়েছিল শরীরে। মানসিক সমস্যা তো তার কোনোদিনই ছিল না। তাহলে এই পাগলা গারদে আরও চারটে পাগলের মাঝে কেন যে তাকে এভাবে নিয়ে আসা হল , বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই। ধোঁয়াশাময় আবহে দম ক্রমশ আটকে আসছে তার। মাথায় রীতিমতো রক্ত চড়ে যাচ্ছে।

"শান্ত হও বাবা। আমাদের হাতে আর সময় নেই বেশি। মাত্র তিনটে ঘন্টা। তারই মধ্যে প্রস্তুত হতে হবে তোমাকে।"

"কিসের সময়? কিসের প্রস্তুতি? কি সব বলে চলেছেন আপনি তখন থেকে?"

"মেঝের ফুটবলগুলোয় একটা শট করে দেখাও তো বাবা।"

"এই ঘরের মধ্যে?দেয়াল ফেটে যাবে যে…" - হো হো করে তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে উঠল নীলাদ্রি।

"সেসব ভাবনা না হয় আমার ওপর ছেড়ে তুমি শুধু একটা শট করে দেখাও।" - আশ্বস্ত করলেন স্থূলকায় ভদ্রলোক।

চার-পাঁচবার চেষ্টার পরও বলে কিছুতেই পা ছোঁয়াতে পারল না নীলাদ্রি। হাত দিয়ে বলটাকে পজিশনে বসানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল বারবার। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল ওর।

মৃদু হেসে বলতে শুরু করলেন হাফপ্যান্ট পরিহিত সেই ভদ্রলোক --- " কোনো কিছুকে স্পর্শ করার শক্তিই আর তোমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই নীলাদ্রি কারণ, তুমি এখন বায়বীয় অবস্থায় আছো। মানতে কষ্ট হলেও নীলাদ্রি সেন মৃত। পার্থিব কোনো বস্তুকে স্পর্শ করার ক্ষমতা আর তার নেই। সে এখন অদৃশ্য যে কোনো জীবিত ব্যক্তির চোখে।"

"তাহলে আপনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন কি করে?"

"কারণ, আমি মৃত। শুধু আমি নয়, এই জগতে যাদেরই তুমি দেখবে তারা সকলেই মৃত তোমারই মতো। যাই হোক, আমার হাতে এখন সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে তোমাকে। এসব জন্ম-মৃত্যু নিয়ে আলোচনার জন্য পরেও অনেক সময় পাওয়া যাবে।"

ইতিমধ্যেই বেশকিছু লোক প্রবেশ করল সেই ঘরে। কারও গায়ে জার্সি, কেউ বা খালি গায়ে। দেখে তাদের খুব চেনা লাগছিল নীলাদ্রির। কথাবার্তা শুনে মনে হল তারা সকলেই সম্ভবত ফুটবল খেলছিল এতক্ষণ। ঘরে ঢোকামাত্রই পরিচয় করাতে শুরু করলেন টাক মাথার সেই ভদ্রলোক --- " এদের সকলকেই হয়তো তুমি চেনো। পেপার কিংবা টিভিতে দেখে থাকবে প্রত্যেককেই। এদের সাথেই আর তিনঘন্টা পর মাঠে নামবে তুমি। প্রেস্টিজ ফাইট। এই ম্যাচ জিততেই হবে আমাদের। "

"কিসের ম্যাচ?" - বোকার মতো প্রশ্ন করল নীলাদ্রি।

"আজ ১১ই জুলাই। ১২৫বছর আগে আজকের দিনেই খালি পায়ে জাতীয় ক্লাব মোহনবাগান পরাস্ত করেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে। তারই বর্ষপূর্তিতে আয়োজন করা হয়েছে এই প্রীতি ম্যাচের। মুখোমুখি হতে চলেছে ভারতীয় অমর একাদশ ও ইস্ট ইয়র্কশায়ার।"

"আমি কোন দলের হয়ে খেলব? কত বছরের কনট্র্যাক্ট? কোন পজিশনে খেলব আমি? কারা থাকবে আমার দলে?"

"অমর একাদশের হয়ে নিজের নিয়মিত পজিশন স্ট্রাইকারেই খেলবে তুমি, বাবা আর তোমার দলে থাকবেন অকালপ্রয়াত ভারতীয় ফুটবলারদের একটা বড়ো অংশ, নিজেদের সময়ে যারা সুনামের সাথে দাপিয়ে বেরিয়েছেন সবুজ ময়দানে। অভিষেকেই নজির সৃষ্টির সুযোগ আজ তোমার সামনে। পরজগতের এক ল্যান্ডমার্ক ম্যাচে মাঠে নামতে চলেছো তুমি। বিপক্ষে ইস্ট ইয়র্কশায়ারের মতো কিংবদন্তি ক্লাব যারা একটা সময় রাজ করত ভারতীয় ফুটবলে। তাদেরই কিছু পরলোকগত ফুটবলারকে নিয়ে গড়া এই টিম কিন্তু ইতিমধ্যেই ত্রাস সৃষ্টি করেছে অপার্থিব ফুটবল দুনিয়ায়। সো ডোন্ট টেক ইট ইজি।"

"কিন্তু এই আপাত-অস্তিত্বহীন একটা ম্যাচ খেলার জন্য এভাবে আমার সম্ভাবনাময় কেরিয়ারের জলাঞ্জলি ঘটিয়ে, আমাকে খুন করে এখানে নিয়ে এসে কী লাভ হল আপনাদের?"

"এ সবকিছুর উত্তর শুধুমাত্র ঈশ্বর আর নিয়তিই দিতে পারে নীলাদ্রি। আমার কাজ কেবল তোমার মতো হতভাগ্য ফুটবলারদের এই মানব পুনর্নির্মাণ কেন্দ্রে নিয়ে এসে ট্রেনিং করানো। অকালমৃত্যুতে ঝড়ে যাওয়া ফুলেদের পরিচর্যা করা। জন্ম-মৃত্যুতে আমার কোনো হাত নেই বাবা , আর যে ম্যাচকে তুমি অস্তিত্বহীন বলে মনে করছো, তার দর্শক সংখ্যা কোটিরও বেশি। তারকা সমাবেশ কিংবা দর্শক সমাগম --- সবদিক থেকেই এই ম্যাচ তোমার সন্তোষ ট্রফির তুলনায় অনেক বেশি হাইভোল্টেজ।"

"কে আপনি? কোনো বিখ্যাত ফুটবলার? কিছুতেই কেন জানি না --- চিনেও ঠিক চিনতে পারছি না আপনাকে।"

"আমার নাম প্রদীপ ব্যানার্জি। লোকে আমাকে পিকে বলে ডাকে।"

"হ্যাঁ! " বিস্ময়ের ঘোর নীলাদ্রির গলায়। বাংলা দলের কোচ দেবজিৎ ঘোষ অবধি যাকে গুরু বলে মানেন, সেই পিকে ব্যানার্জি আজ ওর চোখের সামনে!

"শুধু আমি একা-ই নই। এখানে আরও অনেকেই আছেন যাদের পরিচয় জানলে তোমার মুগ্ধতার বাঁধ ভাঙবে এক্ষুনি। তাই তো বলছি তোমার জীবনের একটা মাইলস্টোন হতে চলেছে এই ম্যাচ। নিজের সেরাটা উজাড় করে দাও, বাবা।"

"কিন্তু আমি তো বল ছুঁতেই পারছি না। কি করে মাঠে নামব আমি? "

"তুমি এখনও বায়বীয় অবস্থায় আছো নীলাদ্রি। আমরা সবাই মিলে একসাথে তোমাকে ছুঁয়ে এনার্জি ট্রান্সফার করলেই খেলার উপযুক্ত হয়ে উঠবে তুমি। চোখদুটো বন্ধ করে প্রাণপণে সবুজ মাঠ কল্পনা করো একমনে। একটা মৃদু আওয়াজ কানে আসার আগে অবধি চোখ খুলবে না কিছুতেই।"

চোখ বোজা অবস্থাতেই নীলাদ্রি অনুভব করল বেশ কয়েকটি রুক্ষ হাত ছুঁয়ে গেছে ওর সারাদেহ। কিছুক্ষণ পর কানে ভেসে গেল ধারাবিবরণীর শব্দ। চোখ খুলে খাট থেকে নেমে পা ছোঁয়াল বলে। এখন আর শট নিতে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না তাকে। সবমিলিয়ে এত কান্ডে বেশ ঘাবড়ে গেছে ছেলেটা। বল পায়ে পেয়ে কিছুটা উৎসাহিত কণ্ঠেই বলে উঠল  - " কিন্তু স্যার, বিপক্ষ ডিফেন্ডারদের শক্তি, দুর্বলতা কিংবা খেলার ধরন সম্পর্কে কিছু তথ্য কি পাওয়া যাবে আপনার কাছে?"

"তোমাদের অত্যাধুনিক ভিডিও অ্যানালাইসিস প্রক্রিয়ার সাথে আমি সড়গড় হতে পারিনি এখনও।তবে চেষ্টা চালাচ্ছি রোজ। তাছাড়া বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছি আমি। ওই যে মতিদাকে দেখছো সোফায়। ওর হাতে লাল ডায়েরি। ওখানেই লেখা আছে এই পরজগতের সমস্ত ফুটবলারের যাবতীয় খুঁটিনাটি। সত্যজিতের সিধুজ্যাঠার নাম শুনেছো তো? মতিদাও এখানে ঠিক সেই কাজটাই করে। তাছাড়া লেখার হাত তো ওনার বরাবরই বেশ ভালো। তোমাদের মতো বয়সে দাদার বিশাল ফ্যান ছিলাম আমি।

সমস্ত দলের ম্যাচ দেখতে আমি পাঠিয়ে দিই মতিদাকে। ছবির মতো ম্যাচ রিপোর্ট দাদা জমা দেন আমাকে। তারপর চলে কাটাছেঁড়া।এভাবেই চলে আসছে প্রায় এক দশক ধরে। মতি নন্দীর উপন্যাস আর ম্যাচ রিপোর্ট --- দুটোর ধারেই মন কাটতে বাধ্য তোমার।" - হাসতে হাসতে কথা শেষ করলেন প্রদীপ ব্যানার্জি।

একের পর এক বিস্ময়ে পুরোপুরি বিহ্বল হয়ে পড়েছে নীলাদ্রি। ছোটবেলায় 'কোনি ' উপন্যাস পড়ে থাকলেও চর্মচক্ষে মতিদর্শন যেন স্বপ্নপূরণের সামিল। হঠাৎ ঘোর কাটল একটা গমগমে স্বরে - " শোনো নীলাদ্রি, ম্যাচ শুরু হতে আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। এর মধ্যে ইয়র্কশায়ারের গত ম্যাচের রিপোর্ট তোমাকে শোনানো সম্ভব নয় পুরোপুরি। তবে ওদের দুই স্টপার ১৮ আর ৭১ এরিয়াল বলে প্রায়ই চলে আসে একলাইনে। ঠিক ওই সময়েই গতি বাড়িয়ে তোমাকে হানা দিতে হবে বক্সে …."

"হুমম। হুমম। একদম। একদম।" - মতি নন্দীকে থামিয়ে শুরু করলেন পিকে - "কুলুথুঙ্গন ডি বক্সের একেবারে সামনে থাকবে। একটু পিছন থেকে খেলাটা ধরবে কৃশানু আর চাপম্যান। লেফট উইংয়ের ঠিক ওপর থেকে ম্যাচটা অপারেট করবে তুমি। নতুন প্লেয়ার বলে ওরা তোমাকে মার্ক করবে না খুব একটা। ওপেন স্পেস বেশ ভালোই পাবে। আক্রমণভাগে নেতৃত্ব দিয়ে বিপক্ষ ডিফেন্সকে স্ট্রেচ করার দায়িত্বটা কিন্তু তোমাকেই নিজের কাঁধে নিতে হবে নীলাদ্রি।"

"কোনো ভয় নেই ,ভাই। মাঝমাঠ টপকে কোনো বল এদিকে আসতে দেব না আমি। তুমি শুধু কৃশানুর সাথে ওয়ালগুলো ঠিকঠাক খেলো।" --- আশ্বাসের হাত কাঁধে রেখে ফিসফিসিয়ে বললেন সুদীপ ব্যানার্জি।

কৃশানু, সুদীপ, কুলুথুঙ্গন,চ্যাপম্যান --- যে নামগুলো এতদিন প্র্যাকটিসের সময় কিংবদন্তী হিসেবে কোচদের মুখ থেকে কানে আসত বারবার, তাদেরই সতীর্থ আজ নীলাদ্রি! নিজেকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না কিছুতেই। মৃত্যুও যে কখনওসখনও এমন সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আসে, তা এই মানব পুনর্নির্মাণ কেন্দ্রে না এলে হয়তো জানা হয়ে উঠত না কোনোদিনই।

"ফুটবলের যা নিয়ম এতদিন জেনে এসেছো তুমি, তার সাথে বিশেষ কোনো তফাৎ নেই এখানে। তবে জিপিআইএস বা ঘোস্ট পাওয়ার ইন্ডিকেটিং সিস্টেমটা একটু বুঝতে হবে মন দিয়ে।" - ডায়েরিতে চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন মতি নন্দী।

"সেটা কি গোল লাইন টেকনোলজির মতো কিছু? " - উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করল নীলাদ্রি।

"না। এই প্রযুক্তির প্রয়োজন পার্থিব জগতে হয়নি কখনও। এখানে জিপিআইএসের মাধ্যমে এটাই দেখা হয় যে , কোনো ফুটবলার ভৌতিক ক্ষমতার প্রয়োগ করে অনৈতিকভাবে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে কিনা! কেউ এ হেন কাজ করলে সিস্টেম তৎক্ষণাৎ তা ইন্ডিকেট করে এবং হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করা হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে।"

পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে খাটের ওপর রাখলেন টিম ম্যানেজার সুলতান আহমেদ। ঘরের এক কোণে বসে তখন খোশমেজাজে গল্প করছেন অঞ্জন মিত্র আর স্বপন বল। খাটে মেলা টিমলিস্টে চোখ বোলাতে বোলাতে থমকে গেল নীলাদ্রি - 

১/ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়র

২/মোমেন মুন্না

৩/ধনরাজন

৪/এ এস ফিরোজ

৫/কালিয়া কুলুথুঙ্গন

৬/কার্লটন চাপম্যান

৭/প্রশান্ত ডোরা

৮/ভিপি সত্যেন

৯/মনিতোম্বা সিং

১০/কৃশানু দে

১১/সুদীপ ব্যানার্জি

১২/নীলাদ্রি সেন

প্রথম একাদশে নিজের নাম না দেখে ভীষণ মুষড়ে পড়ল নীলাদ্রি। তাহলে পিকে স্যার,মতি স্যাররা এতক্ষণ ধরে কি বোঝালেন তাকে! আন্তর্জাতিক কিংবা ক্লাব ফুটবলের বড়ো মঞ্চে অভিষেক হয়নি বলেই কি প্রথম একাদশে জায়গা হল না তার! তবে কি এই অপার্থিব মানব পুনর্নির্মাণ কেন্দ্রেও প্রতিভার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় রেকর্ডবুক আর বায়োডাটাকে! নীলাদ্রির চোখেমুখে হতাশার ছাপ দেখে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলেন অঞ্জন মিত্র - " কি ব্যাপার নীলাদ্রি? মন খারাপ? "

"না। মানে আমি কি রিজার্ভে থাকছি?"

"কই না তো! তেমন কিছু তো জানা নেই আমার।"

হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে মাথাটাকে ব্যায়ামের ভঙ্গিতে ঘোরাতে ঘোরাতে নীলাদ্রির কাঁধে আলতো চাপড় দিলেন পিকে --- " তুমি ফার্স্ট ইলেভেনেই আছো নীলাদ্রি। ওই লিস্টের একজনের খেলার কথা থাকলেও গতকাল রাতে হঠাৎ জানতে পারলাম, খেলানো যাবে না তাকে। টেনশনে লিস্টটা আর চেঞ্জ করা হয়ে ওঠেনি।"

"কে? কে খেলতে পারবে না? এখানেও প্লেয়ারদের চোট হয় নাকি?"

"না , ঠিক তা নয়। আসলে জুনিয়র ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার হওয়ায় ওকে খেলানোর বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছে ইস্ট ইয়র্কশায়ার। ভারতের বাইরের ফুটবলারদের অ্যালাও করতে প্রতিপক্ষ নারাজ। ওরা নিজেরাও কেবল ব্রিটিশ ফুটবলারদের নিয়েই নামবে মাঠে। বাংলাদেশ যেহেতু ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাই মুন্নার ব্যাপারে কোনোরকম আপত্তি জানায়নি ওরা। কিন্তু জুনিয়র মাঠে নামলে দল তুলে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে আগে থেকেই। কাল রাতে ওদের অবজেকশন লেটারের খবর পাওয়ামাত্রই স্ট্রাইকার নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছিলাম ভীষণ। ঠিক তখনই চিত্রগুপ্তের চর এসে জানালেন, তোমার ভয়ংকর একটা ফাঁড়া আছে সামনের সেমিফাইনাল ম্যাচে। মনেপ্রাণে চাইছিলাম , এই ফাঁড়াটা যাতে তুমি কাটিয়ে উঠতে না পারো আর হলও তাই। যুবভারতী থেকে সোজাসুজি দ্য গ্রেট হেভেনের ডেডলি স্টেডিয়াম। ইস্ট ইয়র্কশায়ারের মতো টিমের বিরুদ্ধে জুনিয়রের কিলিং ইনস্টিংক্টটা ভীষণ প্রয়োজন ছিল আমাদের। অমন একটা রেগুলার প্লেয়ারকে ছাড়া এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জেতা যে কোনো দলের পক্ষেই কার্যত অসম্ভব। তবে তোমার আকস্মিক উপস্থিতি চিন্তামুক্ত করেছে আমায়। সন্তোষে তোমার যা পারফরম্যান্স দেখলাম, তাতে ওদের ডিফেন্স নিয়ে ছেলেখেলা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। মাঠের নব্বই মিনিটের প্রতিটা সেকেন্ড শুধু তোমার। উপভোগ করো প্রাণপণে।"

অমর একাদশের হয়ে খেলার জন্য শেষমেষ মৃত্যু টেনে নিল নীলাদ্রিকে। প্রতিবছর দলবদলের মরসুমে সফল ফুটবলারদের নিয়ে একাধিক ক্লাবের টানাহ্যাঁচড়া চললেও যমে-মানুষে টানাটানি বোধ হয় এই প্রথমবার!

ড্রেসিংরুমে রাখা বারো নম্বর জার্সিটা পরে নিভিয়ার বুটের দড়ি বেঁধে সবার পিছনে জগিং করতে করতে মাঠে প্রবেশ করল নীলাদ্রি। মিনিট পনেরো ওয়ার্ম আপ করতে না করতেই রেফারির লম্বা বাঁশিতে শুরু হয়ে গেল মহারণ। প্রথম মিনিট থেকেই টিপিক্যাল লং বলে অমর একাদশের ডিফেন্স ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন লার্সন আর ড্যানিয়েল। কখনও মোমেন ,কখনও ধনরাজ নিজেদের অন্য উচ্চতায় তুলে ধরে হেডে ছিন্নভিন্ন করলেন প্রতিপক্ষের আক্রমণ। দেখতে দেখতে পঁচিশ মিনিটের মাথায় প্রথম কর্নার পেল ইস্ট ইয়র্কশায়ার। রড্রিগেজের বাঁক খাওয়ানো শট কোনমতে ক্লিয়ার করে দুর্গের পতন রক্ষা করলেন অমর একাদশের গোলরক্ষক প্রশান্ত ডোরা। এরপরও বেশ কয়েকবার প্রতিপক্ষের আক্রমণের সামনে চিনের প্রাচীর হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। কিন্তু পারলেন না শেষমেষ। প্রথমার্ধের একেবারে শেষ লগ্নে এক গোলে এগিয়ে গেল ব্রিটিশরা। বিরতিতে পিকের বিখ্যাত ভোকাল টনিকেও কাজ হল না তেমন। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম আক্রমণেই আবারও গোল তুলে নিল ইস্ট ইয়র্কশায়ার। দ্বিতীয় গোল হজম করা মাত্রই তেঁড়েফুঁড়ে উঠলেন অমর একাদশের ফুটবলাররা। মাঝমাঠ থেকে বল ধরে সর্পিল গতিতে বিপক্ষ বক্সে বারবার হানা দিতে থাকলেন কৃশানু। সুদীপ যেন তখন মাঝমাঠের মাইকেলএঞ্জেলো। ষাট মিনিটের মাথায় মণিতোম্বার নিখুঁত কর্ণারে মাথা ছুঁইয়ে দলের হয়ে ব্যবধান কমালেন কুলু। মাঝে প্রতিআক্রমণে ইস্ট ইয়র্কশায়ার আরেকটি গোল করলেও ফ্যালকাও নিয়মবিরুদ্ধভাবে উচ্চতা বাড়ানোয় জিপিআইএস সিস্টেম দেখে শেষমেষ তা বাতিল করতে বাধ্য হলেন রেফারি। স্নায়ুর চাপে প্রথমার্ধে পুরোপুরি নিষ্প্রভ থাকা নীলাদ্রি দ্বিতীয়ার্ধে ছুটতে শুরু করল পিভোটের মতো। তার ডামি রানেই মার্কারকে এড়িয়ে ডি বক্সের বাইরে থেকে কোনাকুনি শটে সমতা ফিরিয়ে আনলেন চ্যাপম্যান। ইস্ট ইয়র্কশায়ারের ডিফেন্স যেন তখন গড়ের মাঠ! আক্রমণের সুনামিতে বেসামাল ব্রিটিশ গোলরক্ষক। কৃশানু-কুলু-চ্যাপম্যান --- ত্রিফলায় ছারখার ইংরেজদের গর্বের রক্ষণভাগ।

ম্যাচ শেষ হতে আর মাত্র মিনিট তিনেক বাকি। ইনজুরি টাইমের বোর্ড দেখিয়ে দিয়েছেন চতুর্থ রেফারি। সুদীপের ভাসানো বল হেড করে ইস্ট ইয়র্কশায়ার বক্সে নামালেন কৃশানু। বল তখনও বুক হাইটে। স্বাভাবিকভাবে পা ছোঁয়ানো অসম্ভব দেখে ঘুরে গিয়ে শূন্যে উঠে বাইসাইকেল কিক মারল নীলাদ্রি। রেফারির শেষ বাঁশির সাথেসাথেই বল জড়িয়ে গেল জালে। প্রথমার্ধে কর গুনে দুবার বলে পা ছোঁয়াতে পারলেও দ্বিতীয়ার্ধে অক্লান্ত পরিশ্রম আর সবশেষে একটি সোনায় বাঁধানো গোল! দুহাত ছড়িয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়েছে নীলাদ্রি। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে তার। নীলাদ্রিকে ঘিরে গোটা দল ফেটে পড়েছে উল্লাসে। পিকে, মতি নন্দী থেকে সুলতান,অঞ্জন --- আনন্দে সবাই ঢুকে পড়েছেন মাঠের ভিতর। ওদিকে ইস্ট ইয়র্কশায়ার ড্রেসিংরুমে তখন দশমীর স্তব্ধতা।

সতীর্থদের ঘাম টপটপ করে ঝড়ে পড়ছে নীলাদ্রির বন্ধ চোখের পাতার ওপর। মাথায় তাদের আদরের হাত। বিধ্বস্ত ছেলেটা বিশ্রাম চাইছে আরও কিছুক্ষণ। আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। বেশ কয়েক মিনিট কাটার পর আস্তে আস্তে চোখদুটো খুলতেই চমকে উঠল নীলাদ্রি। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে স্নেহের হাত সযত্নে মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছেন ওর মা। চোখের জল টপটপ করে পড়ছে নীলাদ্রির কপালে। চোখদুটো টিপে পরিষ্কার করে নিয়ে আবার তাকাল নীলাদ্রি। কোথায় সেই মাঠ, পিকে স্যার,ড্রেসিংরুম! কিচ্ছু নেই! হাসপাতালের বেডে শুয়ে নীলাদ্রি আর ওকে ঘিরে রয়েছে নিজের মা, বাংলা দলের কিছু সতীর্থ আর কোচ দেবজিৎ স্যার।

"আমাদের প্রার্থনায় ঈশ্বর সাড়া দিয়েছেন গো। ফিরেছে। ফিরেছে। আমার বাবুর জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তারবাবু! ও ডাক্তারবাবু! আমার ছেলের জ্ঞান ফিরেছে।" - আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন নীলাদ্রির মা।

"ডাক্তারবাবু বলেছিলেন আজ দুপুরের মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে তুই হয়তো কোমায় চলে যাবি। আমরা সবাই তো নাওয়া-খাওয়াই ভুলে গেছিলাম তোর চিন্তায়। সত্যিই ফুটবলদেবতা মুখ তুলে চেয়েছেন রে। উনিই তোকে রক্ষা করলেন এ যাত্রায়।" -  নীলাদ্রির কানে এল কোচের কান্নাভেজা গলা।

"ভাই,তুই বেরিয়ে যাওয়ার পর পরশু সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। ম্যাচটা আর জিততে পারিনি রে…."- অভ্রের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে দেবজিৎ স্যার বলতে শুরু করলেন --- " ছাড় তো ওসব। বাদ দে। নীলাদ্রি যে ফিরে এসেছে,এটাই সবথেকে বড়ো জয় আমাদের। সামনের টুর্নামেন্টগুলো ওর সাফল্যের অপেক্ষাতেই দিন গুনছে। পরবর্তী গন্তব্য ন্যাশনাল টিম।মিলিয়ে নিস।"

হালকা হাসল নীলাদ্রি। সত্যিই ও আর এসব চিন্তা করছে না কিছুই। এ যাত্রায় বেঁচে ফেরাটাই অনেক বড়ো ওর কাছে। বেডের পাশের টেবিলে ফুলের তোড়াসমেত রঙিন প্যাকেট দেখে মাকে জিজ্ঞেস করল নীলাদ্রি --- " এটা কে দিয়ে গেছে গো, মা?"

"আজ খুব ভোরে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। মাথায় বড়ো টাক। পরনে হাফপ্যান্ট। তিনিই এসে বললেন এগুলো তোমায় দিয়ে দিতে…" - উত্তর দিলেন নার্স।

প্যাকেট খুলল নীলাদ্রি। একটা হাফপ্যান্ট আর প্র্যাকটিস জার্সি। সাথে একটা বই, মতি নন্দীর লেখা ' স্ট্রাইকার'। বইয়ের ভাঁজে কাগজে লেখা -  "বেস্ট উইশেস 'ম্যান অফ দি ম্যাচ'।"

আলগা হয়ে আসা নীলাদ্রির হাত থেকে বেস্টফ্রেন্ড অরিন্দম বইটা কেড়ে নিয়ে বলল - " দারুণ বই। সুস্থ হয়ে পড়িস কিন্তু অবশ্যই। একদিন তোর গল্পও লেখা হবে এভাবে।"

নীলাদ্রির কানে যাচ্ছে না এসব কিছুই। দূর থেকে ভেসে আসছে অজয় বসুর কমেন্ট্রি - "কৃশানুর হেড। নীলাদ্রির বাইসাইকেল কিক এবং গোওওওওল। বল জড়িয়ে গেল জালে।"

মনুষ্যজগতে আটচল্লিশ ঘন্টা অচৈতন্য অবস্থায় থাকলেও স্বপ্নে কিংবা দুঃস্বপ্নে নীলাদ্রি ঘুরে এসেছে অশরীরী এক জগৎ থেকে। স্কোরশিটে নাম তুলেছে অমর একাদশের হয়ে। ফিরে এসেছে মরণের ওপার থেকে। রুকস্যাকে ভরে এনেছে কিংবদন্তী পিকে ব্যানার্জির স্নেহাশিস আর একরাশ স্বর্ণালি অভিজ্ঞতা। সবকিছু এই পার্থিব জগতে ভাগ করে নেওয়া যায় না যে…..

.    .    .

Discus