Image by Gerd Altmann from Pixabay
প্রকৃতি পুরুষ মানুষকে যা সুবিধা দিয়েছে আর মেয়েদের শারীরিকভাবে হীনবল করার সঙ্গে এত রকম প্রাকৃতিক অসুবিধায় আপাদ মস্তক নিগড় পরিয়ে রেখেছে যে পুরোনো আপ্তবাক্য “বীরভোগ্যা বসুন্ধরা” প্রতিবাদযোগ্য মনে হলেও অস্বীকার করার উপায় থাকে না। এর ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সংযম পুরুষের অভিধানে না থাকলেও চলে যেখানে এই গুণগুলো নারীর সামাজিক, পারিবারিক এমনকি প্রাকৃতিক ভূমিকা পালনেও আবশ্যিক হয়ে পড়ে। ভূমিকায় শরীরবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব ও সমাজ মনস্তত্ত্বের একাধিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ভিত্তিক সিদ্ধান্ত হল পুরু হরমোন টেস্টোস্টেরন ও অ্যান্ড্রোজেন লিবিডোর সাথে সাথে প্রতিযোগীসুলভ ও আক্রমণাত্মক মনোভাবের জন্ম দেয়। টেস্টোস্টেরোন নারী দেহেও কামোত্তেজনা সৃষ্টিতে সহায়ক। তাই অপরাধমূলক কাজে মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের অধিকতর অংশগ্রহণ মার্জনীয় ব্যাপার।
আমাদের দেশে তো বটেই পৃথিবীর সব দেশেই অপরাধমূলক কাজের জন্য ধৃত ব্যক্তির মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠ হল পুরুষ। এমনকি যেসব দেশে ধর্মীয় অনুশাসনে নারী যৌন লাঞ্ছনার শিকার হলেও দেশের আইন তাকেই অপরাধী সাব্যস্ত করে, সেখানেও চুরি ডাকাতি খুনের মতো যাবতীয় সাধারণ অপরাধের খতিয়ান দেখলে পুরুষ অপরাধীদের তুলনায় নারী অপরাধীর সংখ্যা নগণ্য। আর মেয়েরা অপরাধ করলেও সাধারণত তার শিকার হিসাবে আর একটি মেয়েকেই বেছে নেয়। বধূ নির্যাতন ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ তথা ভরতবর্ষে অপরাধ জগতের নারী বলতে মূলত নারী পাচারের আড়কাঠি যা করে পুরুষদের লালসা মেটাতেই। চুরি, জালিয়াতি করলেও নারী ডাকাত দল তেমন শোনা যায় না। ব্যতিক্রমী কিছু দস্যুরানী পুরুষ ডাকাত দলে পুরুষদের খুন ধর্ষণের ঢালাও অনুমতি দেওয়ার বিনিময়েই ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। অবশ্য ড্রাগ পাচার ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মেয়েরা হামেশাই ব্যবহৃত হয়।
প্রসঙ্গক্রমে জানাই আমাদের দেশে থানায় ডায়রি থেকে মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধের রাজ্য ভিত্তিক পরিসংখ্যান উপলব্ধ হলেও নারী অপরাধীর অনুপাত কতটা তার তেমন কোনও রেকর্ড ধরে রাখা নেই। যা আছে তা হল বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মহিলার কীর্তি কলাপের বর্ণনা ও তাদের নিয়ে কাহিনী। অন্যদিকে আমেরিকান ও ইওরোপীয় দেশগুলোতে অপরাধের লিঙ্গ ভিত্তিক পরিসংখ্যান যথেষ্ট বিশদে রাখা হয় যার থেকে অপরাধ জগতে নারীর ভূমিকা কতটা তার একটা ছবি পাওয়া যায়। যেমন ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারাগারে নিক্ষিপ্ত আসামীর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা (৫,০৩৭,০০০) মহিলাদের (৫৮১,০০০) তুলনায় ৯ গুণেরও বেশি ছিল। ২০১৪ সালে অসামাজিক কাজের জন্য গ্রেপ্তার হওয়া মানুষের ৭৩% ছিল পুরুষ। এর মধ্যে হিংসাত্মক অপরাধের জন্য ধরা পড়া পুরুষের সংখ্যা ৮০.৪% এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধের জন্য ৬২.৯%। United States Department of Justice ১৯৮০ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে খুনের একটা পরিসংখ্যান একত্রিত করে দেখা যায় – মোট অপরাধের ৯০.৫% করেছে পুরুষ বা ছেলেরা। খুনের অপরাধে ধৃতদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ সংখ্যাগুরু। শিশু সন্তান হত্যায় জাগতিক মায়ের তুলনায় জাগতিক বাবাদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও ৫ বছরের কম বয়সী পরের শিশুকে হত্যা করার পরিসংখ্যানে পুরুষরা অনেক এগিয়ে, ৮০%। মেয়েরা যেখানে গার্হস্থ্য হিংসায় নিহত (৬৮%) ও যৌন নিগ্রহের পর খুন (৮৮%) হয় অনেক বেশি সেখানে ড্রাগ সেবনে মৃতের সংখ্যায় (৯০.৫%) এবং তাই নিয়ে গোষ্ঠী কোন্দলের ফলে বলি হওয়ায় (৯৪.৬%) পুরুষেরা সংখ্যাগুরু। ২০১১-র গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরুষ অপরাধীর সংখ্যা – বল পূর্বক ধর্ষণে (৯৮%) তো বটেই ডাকাতি, অপরাধের শিকারকে মেরে ফেলা, গুণ্ডামি, জখম, মোটরগাড়ি চুরি, সম্পত্তি চুরি নিজের পরিবার ও সন্তানের প্রতি অপরাধ, জালিয়াতি থেকে মামুলি চুরি সবেতেই পুরুষরা অনেক বেশি অগ্রসর।
২০০২ সালে কানাডায় বার্ষিক মোট অপরাধী চিহ্নিত মানুষের মধ্যে পরিণত পুরুষ ৩,২৬,৫৩৬ জন, পরিণত মহিলা ৭১,০৫৮ জন, অপরিণত ছেলে ৭৪,৫১৩ জন এবং অপরিণত মেয়ের সংখ্যা ২৪,৪৮৭ জন। দেখা যাচ্ছে ছেলেরা অপরিণত বয়সেও মেয়েদের তুলনায় এমনকি পরিণত নারীর তুলনাতেও অপরাধে চাম্পিয়ান। ২০১৩-১৪-তে বেআইনি কার্যকলাপে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ৮৫% ও ১৫% ।
মেয়েরা অপরাধ করলেও গুরুতর জখম, খুন ইত্যাদির সংখ্যা কম, বদলে শপ লিফ্টিং, চুরি, জালিয়াতি এই জাতীয় অপরাধে সীমাবদ্ধ থাকে। দলবদ্ধ ডাকাতি, অন্যকে হ্যানস্থা, র্যাগিং বা বুলিং এসবেও মেয়েরা অনেক পিছিয়ে। তাছাড়া এই অপরাধের নথিকরণে তৃতীয় লিঙ্গের সমকামী রূপান্তরকামী পুরুষেরা পুরুষ অপরাধী নয়,নারী অপরাধীর দল ভারি করেছে যা তথ্যের এক প্রকার বিকৃতি।একমাত্র দেহ ব্যবসা ছাড়া আর সব ধরণের অপরাধেই মেয়েরা সব দেশেই অনেক পিছিয়ে। আর দেহ ব্যবসায় অধিকাংশ মেয়ে নাবালিকা অবস্থাতেও বাধ্য হয়ে আসে। বাধ্য মানে অভাবের তাড়না নয়, তাদের হাত পা বেঁধে জোর করে যৌনদাসত্বে নারকীয় জীবন যাপনে বাধ্য করা হয়। যারা স্বেচ্ছায় উপার্জনের রাস্তা হিসাবে দেহ বিনিময় বেছে নেয়, সাধারণত প্রশাসনিক তৎপরতায় তাদেরকেই ধরা হয়। নাইট ক্লাব, পিপ শো এই জাতীয় প্রমোদ ভবন তো রীতিমতো সরকারকে খাজনা দিয়েই যৌন ব্যবসায় মেয়েদের ব্যবহার করে চলেছে।এমনকি পর্নোগ্রাফিক ফিল্ম দুনিয়া যেখানে অনেকে মেয়ে স্বেচ্ছায় এলেও বহু মেয়েকেই জোর করে নেশাগ্রস্ত করে ঘিনঘিনে কাজ করানো হয়, তা এখন মোটামুটি স্বীকৃত ইনডাস্ট্রি।
পশ্চিমী দুনিয়ায় নাকি মহিলারাও মারের বদলে অনেক সময় পাল্টা মার দিয়ে ফেলে, যার ফলাও করে নাম রাখা হয়েছে Gender Symmetry, বাংলায় যাকে বলা যায় ‘লিঙ্গ সাযুজ্য’। তবে শারীরিক শক্তির বা মানসিক কাঠিন্যের অভাবে মেয়েরা পুরুষ সঙ্গীকে আঘাত করলেও তা সাধারণত গুরুতর হয় না। গবেষক Dekeseredy তাই বলেছেন, "studies finding about equal rates of violence by women in relationships are misleading because ........, there is a difference between someone who uses violence to fight back or defend oneself and someone who initiates an unprovoked assault.” অর্থাৎ এই সিমেট্রির মধ্যে গোলমাল আছে; কারণ আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে প্রত্যাঘাত ও স্বতঃপ্রণোদিত হিংসা এক নয়।
আবার সভ্য সমাজে সমীক্ষা করে দেখা গেছে non-reciprocal partner violence-এ মানে একতরফা মারায় নাকি মেয়েদের অংশগ্রহণ পুরুষদের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি। স্বাভাবিক বুদ্ধিতে ভেবে দেখলে এই non-reciprocal partner violence-এর উদাহরণ বা ক্ষেত্রগুলো অনুমান করা যায়। খুনসুটি বা মান অভিমানের জেরে হালকা চড় মারা, চুলের মুঠি ধরা, কান মোলা, খিমচে দেওয়া, বুকে কিল মারা ইত্যাদি জাতীয় আক্রমণ মেয়েরা তাদের পুরুষ সঙ্গীকে হয়তো করে থাকে, যাতে সত্যিকারের আঘাত করার ইচ্ছা নয়, থাকে অনুযোগ লজ্জা উৎকণ্ঠা বা অভিমানের প্রকাশ। পুরুষরা নিতান্ত রগচটা বেরসিক বা নারীবিদ্বেষী না হলে, সাধারণত এই জাতীয় আচরণে হয় মজাই পায়, নয়তো অগ্রাহ্য করে এবং এগুলো সচরাচর হিংসা (violence)-র আওতায় পড়েই না। হয়তো এর মধ্যে মেয়ে বলে ক্ষমা করা বা ছাড় দেওয়ার একটা শিভালরি কাজ করে যার দৌলতে ‘lady’s first’, ‘lady’s seat’, গাড়িতে ওঠার সময় দরজা খুলে দেওয়া, বসার চেয়ার এগিয়ে দেওয়া এই ধরণের ভদ্রতা তথা সৌজন্য জন্ম নিয়েছে। তবে এই জাতীয় নির্বিষ আক্রমণও যদি কোনও পুরুষ কোনও মেয়েকে বা মহিলাকে করে, তা অভদ্রতা অসভ্যতা বলে প্রতিভাত হয়। যেমন একটা বাচ্চা তার মা কি বাবার কোলে উঠে হাত পা ছুঁড়ে মারলে তা ভায়োলেন্স বা অ্যাবিউজ হয় না, কিন্তু বড়রা বাচ্চাদের মারলে সেটা মার বলেই গণ্য হবে। মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে নেই এই শিক্ষা সভ্য সমাজ দিয়ে থাকে। কিন্তু উল্টোটায় আইনত বা সৌজন্যত ততটা দোষ নেই বলে আদুরে চড় সত্যিকারের চড়ও হয়ে যেতে পারে। সীমারেখাটা খুব সূক্ষ্ম।
তবে পারস্পরিক জুটি হিংসা (reciprocal partner violence)-এর ক্ষেত্রে অর্থাৎ মারামারি লাগলে বলা বাহুল্য মেয়েরা অনেক বেশি গুরুতর আহত হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে Violence and Victims-এর এক রিভিউ পরিষ্কার জানাচ্ছে ছোটখাটো তাৎক্ষণিক মারামারিতে স্ত্রী পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ মোটামুটি সমান হলেও গুরুতর আঘাত ও অত্যাচারের পরিসংখ্যানে মেয়েরা পুরুষের পাশে দাঁড়াতেই পারে না। মেয়েরা সাধারণত আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণ করে থাকে যেখানে পুরুষরা নারী ও পরিবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের বাসনায় ও যৌনতার দাবিতে স্বতত আগ্রাসী হয়ে ওঠে। Trauma Violence Abuse জার্নালে ২০১১-তে প্রকাশিত রিভিউও একই কথা জানায় – মহিলারা আক্রমণাত্মক হয় অবদমিত রাগে, অবহেলিত থেকে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য, অথবা নিছক আত্মরক্ষার তাগিদে।
২০১১-য় প্রকাশিত Aggression and Violent Behavior জার্নালের সমীক্ষাও দেখায় ছোটখাটো আঘাতে দু পক্ষই সমান হলেও সঙ্গীকে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো বিপজ্জনক আঘাত পুরুষরাই হেনে থাকে। আঘাতের উপাচার চয়ন থেকেই স্ত্রী ও পুরুষের আক্রমণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। মেয়েরা যেখানে কিছু ছোঁড়া, চড় মারা, হাল্কা কিল, আঁচড়, কামড় ইত্যাদির আশ্রয় নেয়, পুরুষেরা সেখানে লাথি, ঘুষি, লাঠি বা বেল্ট দিয়ে পেটানো, গলা টিপে ধরা বা গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করা – এই জাতীয় গুরুতর জখমকারী প্রাণঘাতী আক্রমণ করে থাকে।
তবে এই শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। জেন্ডার সিমেট্রির শৌখিন ধারণার বাইরে যদি বাস্তব হিংসাত্মক ঘটনাগুলি দেখি, সেগুলি কিন্তু আদতে নন-রেসিপ্রোকালই, যেখানে পুরুষরা একতরফা আগ্রাসী আচরণ করে। গার্হস্থ্য হিংসা, যৌন হিংসা বা যে কোনও প্রচলিত নারী নির্যাতনে মেয়েরা একতরফা মার খায়, পাল্টা মার দেয় না বা দিতে পারে না – কারণটা শারীরিক দুর্বলতা, সংস্কার বা সমাজের অসহযোগিতা – যাই হয়ে থাক। সুতরাং যাকে নন ‘নন রেসিপ্রোকাল’ বলা হচ্ছে সেগুলি আদতে হিংসা নয়, আর রেসিপ্রোকাল পার্টনার ভায়োলেন্স সত্যিই রেসিপ্রোকাল না কার্যত পুরুষালি আগ্রাসন তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
আত্ম নিয়ন্ত্রণের অভাবই পুরুষকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে। সমাজের লিঙ্গ বৈষম্য এই প্রবণতার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। মনোবিজ্ঞানীরা "general theory of crime”কে পরখ ও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন। দেখা গেছে পুরুষ ও নারীর অপরাধ করার কারণগুলোও কিছুটা ভিন্ন। Sex Differences in Crime: Do Means and Within-Sex Variation Have Similar Causes?-এর লেখক David Rowe, Alexander Vazsonyi, and Daniel Flannery একটা পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন মদ্যপান যা অসংযত কাজের একটা সাধারণ কারণ, তাতে মহিলা ও পুরুষের অনুপাত ১: ১.২৮।
Merton's theory of anomie অনুযায়ী নারীদের অপরাধ প্রবণতার পেছনে অনেক সময় তার মধ্যে পুরুষালি ভাবকে দায়ী মনে করা হয়। যেসব মেয়েরা সমাজ নির্ধারিত মেয়েলি ভূমিকা প্রত্যাখ্যান করে ‘টম বয়’ গোছের হয় তাদের মধ্যে অন্যান্য সাধারণ মেয়েদের তুলনায় অপরাধ প্রবণতা বেশি। এর মানে এই নয় যে একটু ডানপিটে ও স্বাধীনচেতা মেয়ে হলেই সে নিষ্ঠুর ও অপরাধী মনোবৃত্তির হবে। কিন্তু আগ্রাসী মনোভাব, অপরাধ ও হিংসার সাথে কোনওভাবে বিজ্ঞানীরা পরুষালি বৈশিষ্ট্যের বিশেষত পুরুষ হরমোনের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। যেমন টেস্টোস্টেরন এই পুরুষ হরমোনটি নারী দেহেও কামোত্তেজনা বৃদ্ধিতে সহায়ক। তাই অতৃপ্ত কামের প্রভাব মেয়েদের যৌন আচরণ বিশেষ করে তা যদি অন্য মেয়ে বা শিশুর ওপর বল বা ছল প্রয়োগে প্ররোচিত করে, তাহলে অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে পুরুষালি ভাবের সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমার বক্তব্য এই তত্ত্ব দিয়ে তৃতীয় বিশ্বে পণ, পুত্র সন্তানের আকাঙ্খা ইত্যাদির জন্য কেন শাশুড়িরা বধূ নির্যাতন করে, কেন কন্যা ভ্রূণ হত্যা করে বা করায় বা মা হয়ে কেন নিজের সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে পারিবারিক চাপে মেরে ফেলে এইসব সামাজিক ব্যধির ব্যাখ্যা মেলে না। এই সমস্ত প্রথাসিদ্ধ অপরাধে যে সব নারী অংশগ্রহণ করে তারা মোটেই পুরুষালি প্রবৃত্তির জন্য কাজটা করে না, করে পুরুষতান্ত্রিক চাপে পড়ে যেখানে নারী জন্মটাই অপরাধ বলে প্রতিভাত হয় তাদের চোখে। পুরুষকে মাত্রতিরিক্ত প্রাধান্য দিতে গিয়ে তারা তাদের অধীনস্থ অন্য মেয়েদের ওপর অত্যাচার করে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা নিজের লিঙ্গ পরিচয় মানতে না চাওয়াও কী স্ত্রী কী পুরুষ উভয়কেই অসামাজিক কাজের দিকে ঝোঁকায় যার ফলে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা প্রায়শ অসামাজিক পেশায় যুক্ত থাকে। আবার পুরুষরা যেখানে ধরা পড়ে গেলে নিজেদের অপরাধের সাফাই দিতে চায়, সামাজিক লজ্জার কারণে নারী সেটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে থাকে। মেয়েদের মধ্যে অসামাজিক আচরণ বা অপরাধ প্রবণতার কারণ নিয়ে সঠিক অনুসন্ধান না হওয়ার অন্যতম কারণ তদন্ত, গ্রেপ্তার থেকে বিচার এমনকি তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পর্যন্ত সবই প্রধানত পুরুষেরা করে থাকে। ফলে পুরো ব্যাপারটাই এক তরফা হয়ে যায়। আবার সেই একই কথা বলতে হয়, যেসব সমাজে নারী নির্যাতন একটা সামাজিক প্রথায় পর্যবসিত, সেইসব সমাজে নারী হয়ে আর একটি নারীর প্রতি নৃশংসতম আচরণ (যেমন গায়ে আগুন দেওয়া, সদ্যোজাতাকে মুখে নুন দিয়ে বা শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা ইত্যাদি) এগুলোকে পাশ্চাত্য অপরাধ বিজ্ঞানের গবেষণার আওতায় আনাই হয়নি সম্ভবত।
পুরুষের প্রজনন সাফল্য বহুগামিতার মধ্যে, যার ফলে অন্য পুরুষ তার নারীলাভের পথে প্রতিদ্বন্দ্বী। মনোবিদ অ্যানি ক্যাম্পবেলের মতে মায়ের স্নেহ বঞ্চিত ছেলেরা বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে, যেখানে মেয়েরা শারীরিক আগ্রাসনের বদলে আড়ি করে বা বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজেরাই আরও গুটিয়ে যায়। নেদারল্যান্ডে আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক ভ্যান ভাগ্ত (Mark van Vugt) মনে করেন পুরুষরা আগ্রাসী ও দলবদ্ধ হিংসাত্মক কাজ করে থাকে সম্পদ, জমি, যৌনসঙ্গী ও মর্যাদা লাভের জন্য। তাঁর Male Warrior hypothesis-তে বর্ণিত আছে হোমিনিড অর্থাৎ আদিম গুহামানবের সময় থেকে কীভাবে পুরুষ জোত-জমি যৌনতার চাহিদায় গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব করে এসেছে। বর্তমানে বিবর্তিত সামাজিক মানুষও সেই আদিম তাগিদ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু এর দ্বারা জৈবিক প্রয়োজনে পুরুষে পুরুষে অন্তর্দন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বা চুরি ডাকাতি সহ খুনের ব্যাখ্যা মেলে, নারীর প্রতি একক ও দলবদ্ধ হিংস্রতার কারণ বোঝা যায় না।
পুরুষালি হিংস্রতার পেছনে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরনের (testosterone) ভূমিকা সংক্রান্ত প্রথম তত্ত্ব Challenge hypothesis অনুযায়ী বয়ঃসন্ধিক্ষণে টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ বৃদ্ধির ফলেই জননক্ষমতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব বেড়ে যায় যা আগ্রাসী আচরণের একটা প্ররোচনা। বাস্তবে জেলে হিংস্র অপরাধীদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে রক্তে টেস্টোস্টেরণের মাত্রা ও হিংস্রতার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক প্রমাণ হয়েছে। ঐ একই পরীক্ষা থেকে এটাও দেখা গেছে পিতৃত্বের পর টেস্টোস্টেরণের মাত্রা সাধারণত অনেক কমে যায়। দ্বিতীয় তত্ত্ব Evolutionary Neuro-androgenic (ENA) Theory of Male Aggression-ও বলে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন ও অ্যান্ড্রজেন পুরুষের মষ্তিস্কে প্রতিযোগীসুলভ এমনকি অন্যের ক্ষতি করার মনোবৃত্তি তৈরি করে। তাহলে কি এই টেস্টোস্টেরনই সব গোলমালের মূল? এই পুরুষ হরমোনটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালে নারীর প্রতি যৌন অপরাধ এমনকি যৌনতার তাগিদে হিংস্রতারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
বেশ চমৎকার ব্যাবস্থা। কচি ছেলে থেকে পরিণত পুরুষ – টেস্টোস্টেরণ ও অ্যান্ড্রোজেন ধারণের সৌজন্যে অপরাধের প্রকৃতিদত্ত লাইসেন্স রয়েছে। সাধে কি বাংলায় ভালো পুরুষকে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ বলে যার মধ্যে পুরুষত্ব কম? প্রশ্ন জাগে বিদ্যাসাগর মশাইদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কি খুব কম ছিল যাঁকে আমরা স্মরণ করি বজ্রকঠিন সংকল্প ও পুরুষাকারের জন্যই? আসলে ‘পুরুষাকার’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিই ভ্রান্ত। মানবিক গুণ ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে নারীত্বের সম্পর্ক থাকলেও পুরুষত্বের সঙ্গে সাহসের সম্পর্ক নেই।
International Encyclopaedia of the Social and Behavioural Sciences অনুসারে বয়স যাই হোক পুরুষেরা শারীরিক ও বাচিক আগ্রাসনে লিপ্ত হয়ে পড়ে সহজে, যেখানে মেয়েরা নাকি পরোক্ষ হিংসা যেমন গুজব বিস্তার ইত্যাদিতে বেশি সক্রিয়। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত বা ব্যর্থ পুরুষরা কিন্তু কাঙ্খিত নারীর প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে তার নামে গুজব রটায়, এমনকি বাস্তবে অভুক্ত থেকেও পুরুষালি সাফল্য প্রচারের জন্য কল্পিত যৌন সংসর্গের মিথ্যে দাবি রটিয়ে বেড়ায়। এবং এটা ব্যক্তিবিশেষের স্বভাব নয়, অনেক পুরুষেরই সাধারণ প্রবৃত্তি, তার প্রমাণ একাধিক বার পেয়েছি। এসব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থেকে শারীরিক আগ্রাসনের নমুনা খুন, ধর্ষণ বা মুখে অ্যাসিড ছোড়া, আর পরোক্ষ হিংস্রতা হল মিথ্যে গুজব রটানো – দুটোতেই পুরুষ মানুষের পারদর্শিতা সংশয়াতীত।
প্ররোচনা ছাড়াও হিংস্রতার পরিসংখ্যানে পুরুষরা মেয়েদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। Child Development জার্নালে ২০০৭-এ প্রকাশিত ১৪৮টি সমীক্ষার ফল বলছে শৈশব ও কৈশরেও ছেলেরাই অনেক বেশি আগ্রাসী মনোভাবের হয়। Oxford Handbook of Evolutionary Psychology-ও বিভিন্ন পরীক্ষা বিশ্লেষণ করে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। এমনকি সমবয়সীদের র্যাগিং, বুলিং বা অন্যকে হ্যানস্থা করে আনন্দ পেতেও ছেলেদেরই বেশি দেখা যায়। গার্হস্থ্য হিংসা বা domestic violence-এ তো পুরুষরা মোটামুটি এক চেটিয়া। আর নারী যদি নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ও তা হয় আর একটি নারী যেমন পুত্রবধূ, ভাতৃজায়া, সৎ কন্যা বা ক্ষেত্রবিশেষে বিপরীতক্রমে শ্বাশুড়ি এদের ওপর। অবশ্য শ্বশুরবাড়ি সংক্রান্ত বা অন্যান্য সাংসারিক কারণে খিটিমিটির জেরে পুরুষরা অনেক সময় মেয়েদের বিরুদ্ধে মাসনিক নির্যাতনের অভিযোগ তোলে যা হয়তো পরোক্ষ পীড়নের আওতাধীন। মানসিক নির্যাতনের কথা উঠলেও বলতে হয় মেয়েরা সহজাত সহনশীলতায় যে ধরণের আচরণকে নির্যাতন মনেই করে না, ছেলেরা সেইসব ব্যাপারকেও নির্যাতন হিসাবে ধরে নেয়। যেমন মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি বা বরের অধীনে থাকবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই বিবাহিত হয়, যেখানে পুরুষরা শ্বশুরবাড়ির প্রভাবকে এমনকি তাদের কন্যার ব্যাপারেও হস্তক্ষেপকে পৌরুষে আঘাত বলে মনে করে। আসলে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত পারিবারিক কাঠামোয় মেয়েরা মার খেয়ে চেঁচালেও তা পুরুষদের পক্ষে অত্যাচার হয়ে যায়, আর এক তরফা কথা না শুনে কলহ করলে তো কথাই নেই।
মেয়েরা সরাসরি আগ্রাসী হয় গোপনে আর জনসমক্ষে থাকে পরোক্ষ আগ্রাসী (Passive-Aggressive Behaviour)। অন্য দিকে ছেলেরা প্ররোচিত হলে জনসমক্ষেও হিংসা প্রদর্শনে কুণ্ঠিত নয়। প্ররোচনা নিয়ন্ত্রিত হলে হিংসাও অনেকটা কমে আসে। সমাজের লিঙ্গ বিধি পুরুষ মানুষকে অবলীলায় প্ররোচিত হতেও প্ররোচনা দেয়। কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, বয়স যাই হোক পুরুষেরা শারীরিক ও বাচিক আগ্রাসনে লিপ্ত হয়ে পড়ে সহজে, যেখানে মেয়েরা নাকি পরোক্ষ হিংসা যেমন গুজব বিস্তার ইত্যাদিতে বেশি সক্রিয়। সাধারণত বিশেষ সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া মেয়েরা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া স্বতোপ্রণোদিতভাবে সঙ্গীর প্রতি আগ্রাসী হয়েছে এটা কোনও সমাজই চট করে ভেবে নেয় না। তবে কিছু মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় দেখা গেছে মনে প্রচণ্ড রাগ ও আঘাত করার ইচ্ছা পুষে রাখার সংখ্যা মেয়েদের ক্ষেত্রে সামান্য বেশি। নিরন্তর লাঞ্ছিত হতে হতে পুরুষ সঙ্গী বা জীবনসঙ্গীকে বাস্তবে প্রত্যাঘাতে সমর্থ না হলেও তার ইচ্ছা জাগাটা যেমন স্বাভাবিক, অশান্তির ভয়ে সেই ইচ্ছার অবদমনটাও চরম বাস্তব। সুতরাং সব রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সমীক্ষাই পারিবারিক তথা সামাজিক হিংসায় পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রকে (যার ফলে মেয়েরা মেয়েদের প্রতিই হিংস্র হয়ে ওঠে) অবিসংবাদিত বিজয়ী ঘোষণা করা যায়।
আর এক ধরণের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের কথা কোথাও বিশেষ আলোচিত হতে দেখিনি, সেটা হল নানা ধরণের নোংরামি। জোর করে নোংরা বা অপবিত্র জিনিসে মুখ দিতে বা খেতে বা পান করতে বাধ্য করা। কাগজে প্রায় দেখা যায়, দিনের পর দিন ঘরে হাত পা বেঁধে বৌকে আটকে রেখে খাদ্য পানীয়ের বদলে রেচনজাত তরল পান করিয়েছে স্বামী। পুলিসি হেফাজতে থার্ড ডিগ্রী কিংবা হোস্টেলের র্যাগিং-এর ঘটনাতেও এমনটা শোনা খুব শোনা যায়। পুরুষালি হিংস্রতার সঙ্গে এই ঘিনঘিনে নিপীড়নের প্রবণতার জন্য পুরুষদের মধ্যে ধর্ষণসহ যৌনবিকার বেশি দেখা যায়। নিপীড়ক পুরুষটিও মানসিকভাবে অসুস্থ, কিন্তু সেই অসুস্থতার জেরে সে লাভ করছে বিকৃত সুখ আর তার শিকারকে করে তুলছে মানসিক রোগী। প্রসঙ্গত পুরুষতান্ত্রিক জগৎকে Androgenic World বলা হয়। সুতরাং নামকরণেই অপরাধের লাইসেন্স আদায় করা আছে!
তথ্যসূত্র: