ঔপনিবেশিক আমল থেকে বাঙালী জাতির শিক্ষাগত যোগ্যতা, আর্থসামাজিক অবস্থান ও ভাষা নিয়ে যে ঈর্ষা ছিল, তাতে বিস্ফোরণ ঘটে স্বাধীনতার বিনিময়ে দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গ থেকে আসামে পালিয়ে আসা বাঙালী শরণার্থীর ঢল নামায়। “বঙ্গাল খেদা” আন্দোলন নামটা সম্ভবত ষাটের দশকের প্রাপ্তি ও বঙ্গাল খেদানোর হিড়িক তখন থেকে জাতীয় প্রেক্ষাপটে ফুটে উঠলেও স্বাধীনতার পর থেকেই খেপে খেপে বাঙালী বা বহিরাগত বিতাড়নের প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে, যার প্রথম অভিব্যক্তি চল্লিশের দশক থেকেই দেখা যায়।
সহস্রাধিক বছর ধরে বাঙালীরা বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অধিবাসী হয়েও কেন বহিরাগত? কারণ দক্ষিণ তথা সমগ্র আসামে বাঙালী সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াও সরকারী চাকরি ও অন্যান্য উচ্চপদে সেই ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই বাঙালীরা অগ্রসর। সংখ্যালঘু অসমীয়াদের তাই একটা ঈর্ষা জমানোই ছিল। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে পায় মুখ্যত অসমীয়ারাই। কিন্তু সেইসঙ্গে সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তি লাভ করতে গিয়ে দেখল বাঙালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী হল তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।[1] যদিও বাঙালীরা কখনও জাতিবৈষম্যের পরিচয় দেয়নি, শুধু যোগ্যতা দ্বারা উৎকর্ষ অর্জন করেছিল, তবু স্থানীয় পেশা কাজ ও বাণিজ্যক্ষেত্র থেকে মেধাবী কুশলী প্রতিযোগীদের সরিয়ে ফেলা দরকার, নতুবা চিন থেকে আগত খর্বনাসা মানুষগুলো ভারতে অঙ্গীভূত হওয়ার সবকরকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করেও বিদ্যাবুদ্ধি ও সম্মানজনক পেশাতে একাধিপত্য লাভ করতে পারছে না। তাই মধ্যবিত্ত বাঙালীদের মেরে ফেলা বা তাড়িয়ে দেওয়াই কর্মসন্ধানী অলস অসমীয়া যুবারা সহজ পথ বলে বেছেছিল।[2][3][4][5][6][7] বাঙালীদের সম্পত্তি ধ্বংস, মারধরসহ উন্মু্ক্ত হিংসায় ভরে গিয়েছিল গোটা রাজ্য।[8]
১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে অহম রাজ্য ব্রটিশ সরকারের বাংলা প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর[9] সিলেটি বাংলার অনুরূপ ভাষাবাষী অহমরা শিক্ষিত বাঙালীদের সরকারী পদে আসীন ‘বাবু’ ও অন্যান্য সম্মানজনক পেশায় যুক্ত জাতি হিসাবেই দেখেছিল। অসমীয়রাও মান্য বাংলাকেই নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে বেছেছিল। কিন্তু দুই ব্যাপটিস্ট মিশনারি তাদের মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্যের নামে অসন্তোষ উস্কে বাঙালীদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ও অসমীয়া ভাষার দাবিতে উত্তাল করে তোলেন।[10] বহিরাগত সদ্য ভারতভুক্ত অহোম বা অসমীয়ারা বাঙালীদেরই বহিরাগত ভাবতে শুরু করে।[12] এই ভাবনাটাই কালক্রমে প্রবল জাতিবিদ্বেষ ও হিংসার রূপ নিল।
এরপর গোটা ৪০-এর দশক জুড়ে প্রথম দিকে পাকিস্তান তথা দেশভাগের দাবিতে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ থেকে ও ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ইসালামিক পূর্ব-পাকিস্তান থেকে হিন্দু নিপীড়ন-নিধন-ধর্ষণ- লুণ্ঠনের জেরে কাতারে কাতারে বাঙালী শরণার্থী আসামে এসে পৌঁছতে লাগল, বিশেষত দক্ষিণাংশে বরাক উপত্যকায় যা আসলে বাংলারই বাংলাভাষী ভূমি ছিল। কিন্তু স্থানীয়দের চোখে তারা বহিরাগতই। এর মধ্যে প্রথম উদ্বাস্তুস্রোত আসে ১৯৮৬-এর নোয়াখালি হিন্দু গণহত্যা ও নির্মূলীকরণের সময়।[13] সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক জনানুপাত বজায় রাখতে মুসলিম নেতৃত্ব ও সরকারি নীতির যৌথ আনুকূল্যে মুসলিমরাও অনুপ্রবেশ করে আসছিল যথেষ্ট মাত্রায়, যে আলোচনা পরবর্তী পর্বে করেছি। খেপে খেপে বাঙালী আগমনে স্থানীয় অসমীয়রা ও বিভিন্ন উপজাতিগুলি উদ্বিগ্ন ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল।[14] শরণার্থীর সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে ১৯৪৯-এর মে নাগাদ ২৭,৪০,৪৫৫-এ পৌঁছে গিয়েছিল।[15] কোপটা পড়ল হিন্দু বাঙালীর ওপরেই।
মে ১৯৪৮-এ গৌহাটির পানবাজার অঞ্চলে অসমীয়াদের হিন্দু বাঙালীদের প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই সম্ভবত স্বাধীন ভারতে প্রথম অসমীয়া জাতিবিদ্বেষের ঘটনা, যা দ্রুত আসামের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।[16] গৌহাটিতে বাঙালীদের দোকানপাট লুঠ হয়। অশ্লীল দেওয়াল লিখনে ভরে যায় রাস্তা: “সব মাছ খেল কারা? বঙ্গালী আবার কারা! বঙ্গাল খেদা।”[17]
১৯৫৬ সালে যখন পূর্ববর্তী গোয়ালপাড়া জেলায় অশান্তি তুঙ্গে ‘বঙ্গাল খেদা’নোর জিগির ও আয়োজন চলছে পুরোদ্যোমে তখন রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন (States Reorganization Commission) সেখানে যায় উক্ত জেলাকে পশ্চিমবঙ্গভুক্ত করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। কংগ্রেস বিধায়ক শরৎচন্দ্র সিংহ, যিনি পরে আসামের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন, তিনি গোয়ালপাড়া জুড়ে যাত্রা করে বাঙালী হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা উস্কানো বক্তৃতা করে গণহিংসায় প্ররোচনা দিলেন।[17] রাতারাতি গোয়ালপাড়ার ২৫০টি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়কে অসমীয়া মাধ্যমে রূপান্তরিত করা হল। তৎলাকীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর লেখা চিঠি থেকে জানা যায় একজন বাঙালী ছুরিবিদ্ধও হয়েছিল।[18]
প্রসঙ্গত মানভূম ধলভূম সিংভূম বাংলাভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও বিহারভুক্ত থাকায় যে অসঙ্গতি এবং সেখানেও বাংলাভাষার ওপর নানা অবদমন, হিন্দী নিয়ে জোরাজুরি চলায় যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল, তার নিষ্পত্তি হয়েছিল রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সদর্থক হস্তক্ষেপেই। ১৯৫৬-র ১লা নভেম্বর মানভূমের খণ্ডিতাংশ পুরুলিয়া জেলারূপে পশ্চিবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিধানচন্দ্র রায়ের মতো মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রে সওয়াল করার মতো শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো সহযোগী বাগ্মী থাকতেও কি আসামভুক্ত বাঙালীদের জন্য কিছু করা যায়নি? না কি দুটি রাজ্যের সঙ্গে বিবাদে জড়ানো পশ্চিমবঙ্গের পক্ষেও সম্ভব ছিল না? কিন্তু রাজ্যপুনর্গঠন কমিশন পর্যন্ত গড়ি্য়েছিল যখন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও সহযোগী বিরোধী নেতৃবৃন্দের চেষ্টা নিশ্চয়ই ছিল অনুমান করা যায়। কিন্তু অসমীয়াদের হিংস্রতার জন্য নিষ্পত্তি হয়নি।
বলা বাহুল্য গোয়ালপাড়ার পশ্চিমবঙ্গে আসা হয়নি। বাঙালীকে সহ্যও করবে না, আবার তাদের নিজেদের স্থানে যেতেও দেবে না। বরং ইসলামি কায়দায় গোয়ালপাড়ার বাঙালীদের অসমীয়া করে জনসংখ্যা ও জমি দুটোই দখলে রেখে দিল অসমীয়া সম্প্রসারণবাদ।
বিহারের কংগ্রেস সরকারও রাজ্য পুনর্গঠনকে কমিশনকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে, বাংলা-বিহার সংযুক্তি প্রস্তাব তুলে এবং সংসদে নানা নাটক মঞ্চস্থ করে বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গে জমি হস্তান্তর আটকানোর চেষ্টা করেছিল; এবং এর ফলে বিহারীদের সঙ্গে বাঙালীর তিক্ততা বেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারা হিংসার আশ্রয় নিয়ে হত্যালীলা ঘটায়নি এবং শেষ পর্যন্ত কমিশনের নির্দেশমতো জমি ছেড়েও দেয়, শুধু মানভূমের নয়, উত্তরবঙ্গের জন্যও কিছুটা। সেই ব্যাপারে পরবর্তী অধ্যায়ে যাব। কিন্তু বাংলারই জমিতে বাঙালীকে বহিরাগত বলে দাগিয়ে অসমীয়ারা যা করল ও করে চলেছে, তার সঙ্গে একমাত্র মুসলমানদেরই তুলনা হতে পারে।
‘বঙ্গাল খেদা’। ‘বঙ্গাল’ মানে শুধু বাঙালী নয়, বহিরাগত। ["Drive out the OUTSIDERS mostly referring to BENGALIS!"][23][24][25][26] ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত বৃহত্তম প্রাদেশিক জাতিবিদ্বেষী আন্দোলনের (Xenophobic movement) নাম। ‘বঙ্গাল খেদা’নোর সময়কাল নিয়ে কিঞ্চিত বিতর্ক আছে। সুনির্দিষ্ট করে বলাও মুশকিল। স্বাধীনতার পর থেকেই খেপে খেপে বাঙালী বা বহিরাগত বিতাড়নের প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে, যার প্রথম অভিব্যক্তি চল্লিশের দশকের শেষ দিক থেকেই দেখা যায়। তবে ১৯৬০-এর দশকেই এর প্রাবল্য সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল, যা বাঙালী গণহত্যা রূপ নেয়। ‘বঙ্গা খেদা’ আন্দোলন নামটাও তখনকার প্রাপ্তি।
১৯৫৭ সালের ২৮শে ডিসেম্বর বিলমা প্রসাদ চলিহা আসামের মুখ্যমন্ত্রী হন, যিনি জিগির তোলেন ‘আসাম শুধু অসমীয়াদের’ যেখানে অসমীয়া ভাষাই হবে একমাত্র সরকারি ও শিক্ষাদানের ভাষা। অবিকল পাকিস্তানের মিলিটারি প্রশাসনের সংখ্যালঘুর ভাষা উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার মতো। এতদিন লাগাতার মার খেয়েও, উৎখাত হয়েও একতরফা শান্তিরক্ষা ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে আসছিল। কিন্তু বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শতাব্দী প্রাচীন, প্রায় সহস্রাধিক বর্ষ ধরে চলে আসা বাংলাভাষাকে রাতারাতি নির্বাসন ও বাঙালীকে জীবিকাচ্যুত করার সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানিয়ে পারেনি। ইতিহাস ও জনবিন্যাস দেখিয়ে বাংলাভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা ও বাংলাভাষীদের জন্য শিক্ষার মাধ্যম রাখার আবেদন জানায়।
কিন্তু তথ্য, যুক্তি, আবেদন — সবই গণতান্ত্রিক ব্যাপার, অণু-জাতীয়তাবাদী সম্প্রসারণবাদের কাছে ধোপে টিকবে কেন?
প্রথম হামলা হয় জুন মাসে গৌহাটির কটন কলেজে (Cotton College) যা ছড়িয়ে পড়ে সারা রাজ্যজুড়ে “বঙ্গাল খেদা” আন্দোলনের রূপ নেয়।[27] এবারে সমগ্র আসাম জুড়ে এক-তরফা বাঙালী নিধনের আগুন জ্বলে ওঠে। কী চমৎকার! যে বাঙালীরা বহিরাগত শরণার্থী, তাদেরও যাহোক একটা পুনর্বাসন হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, দন্ডকারণ্যে বা আন্দামানে। কিন্তু বরাক-কাছাড়-করিমগঞ্জের যেসব বাঙালীরা সেখানকারই ভূমিসন্তান, তাদের রাতারাতি উচ্ছেদ প্রাদেশিক আন্দোলনের রূপ পেয়ে গেল।
তারপর রচিত হয় আসামের প্রথম উল্লেখযোগ্য এথনিক ক্লিনজ়িং বা জাতিগত নির্মূলীকরণের প্রয়াসের ব্লুপ্রিন্ট। রচয়িতা ছিল অসমীয়া শিক্ষকদের এক সংগঠন। ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে চাপান উতোরের মধ্যে ১৯৬০-এর জুলাই মাসে শিবসাগরে সেই শিক্ষক সংগঠনের একটি সভা আয়োজিত হয়, যেখানে রচিত হয় এক গণহত্যার ষযযন্ত্র। পরিকল্পনানুযায়ী ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা যেখানে বাঙালী সংখ্যাধিক্য তুলনায় কম, সেখানে অসমীয়া জনগণ বাঙালীদের আক্রমণ করার কর্মসূচী গ্রহণ করে। পরের দিন শিবসাগরে বন্ধ্ ডাকা হয় এবং একদল ছাত্রকে পাঠানো হয় জোড়হাট, ডিব্রুগড় ও আশপাশের একালার দিকে মিটিং-এর সিদ্ধান্ত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।[28] পাকিস্তানিরাও বাঙালী গণহত্যা করেছিল সেনার মাধ্যমে, কিন্তু অসমীয়া অণু-জাতীয়তাবাদী সম্প্রসারণবাদীর দল শিক্ষাক্ষেত্রের শিক্ষক ও ছাত্রদেরও ঘাতকের ভূমিকায় নামাতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।
১৯৬০-এ ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের বর্ববৃহৎ সাফল্য ছিল কামরূপ জেলার (অধুনা বসাকা জেলার) গোরেশ্বরে ঘটা বাঙালী হিন্দু গণহত্যা[29] ৩রা জুলাই ১৫,০০০ সশস্ত্র আসামী জনতা বন্দুক বাঙালী বাড়ি ও দোকানে এমন হামলা চালায়,[30] যে গোটা এলাকা থমথমে হয়ে গেল।
৪ঠা জুলাই থেকে টানা দশদিন অসমীয়া জনতা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালী হিন্দু স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণ লুঠতরাজ করে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়, অথবা দখল করে নেয়।[31] ডিব্রুগড়ে মিশ্র জনবসতিতেও বাঙালী হিন্দুদের বাড়ি বেছে বেছে আক্রমণ করে লুঠপাট, ছুরি মারা, অগ্নিসংযোগ ও শেষে বাড়ি থেকে বিতাড়ন ইত্যাদি চলে।[27]১৪ই জুলাই শিবসাগরের নানা জায়গায় বাঙালীদের দোকান লুঠ, মারধর ইত্যাদি চলতে লাগল। নিম্ন আসামের কামরূপ, নওগাঁও ও গোয়ালপাড়া জেলায় তুমুল হিংসা চালানো হল।
সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা গেল জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৬০-এর মধ্যে। প্রায় ৫০,০০০ হিন্দু বাঙালী পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আশ্রয় নিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলালকে জানিয়ে চিঠি লেখেন, যাতে লেখা ছিল অন্তত ৪০০০ বাঙালী হিংসা কবলিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিল শুধু ৫-১১ই জুলাইয়ের মধ্যে। ১২-২০ জুলাইয়ের মধ্যে আরও ৪৪৭ জনের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার কারণ দাঙ্গা কিনা স্পষ্ট নয়। ৩১শে জুলাইয়ের পর থেকে শরণার্থীর ঢেউ পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়েছিল। ডাঃ রায়ের পরবর্তী চিঠি অনুযায়ী আরও ৪৫,০০০ বাঙালী আসাম থেকে উৎখাত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এসেছিল।[28] সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ৫০,০০০ বাঙালী পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয় নিঃস্ব হয়ে। তাদের মধ্যে ‘দস্যু ভাস্কর’ অমনিবাস লেখক রবীন দেও ছিলেন যিনি কলকাতায় আশ্রয় নেন।[32] ১৯৫৯-এই ব্যবসা বন্ধ করে ব্রহ্মপুত্র ছেড়ে বরাক উপত্যকায় চলে যেতে বাধ্য হন সুকোমল পুরকায়স্থ যিনি ১৯৬১-র বাংলাভাষা আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত নিহত হন।[33]
গোপালজী মালহোত্রা তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ৪,০১৯টি কুটির, ৫৮টি পাকাবাড়ি লুঠপাট ও ধর্বংস করা হয়েছে।[28][34][35] কমিশনের প্রতিবেদন জানিয়েছিল যত বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশিকে আঘাত ও পঙ্গু করে দেওয়া হয়। কলকাতা বা নোয়াখালিতে মুলসিম দাঙ্গাবাজদের অমর কীর্তি মনে পড়তে বাধ্য। একজন বাঙালী মহিলাকে আক্রমণ করে ধর্ষণও করা হয়:। প্রথম দিনই ১০০০ বাঙালী পালাতে বাধ্য হয়। এই সময় থেকেই শুরু হয়েছিল সহস্র সহস্র বাঙালীর ঝলকে ঝলকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পালিয়ে থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসার পালা। সুবীর ভৌমিক হিসাবে দেখিয়েছেন, ৫ লক্ষ বাঙালী আসাম থেকেও উদ্বাস্তু হয়েছে।[31] সবটাই ৬০-এর দশকে হয়নি। ৭০ ও ৮০-র দশক থেকে আসামে বাঙালীবিদ্বেষ হিংস্রতর প্রবলতর ও ব্যাপকতর হয়েছে। কিন্তু সেই অধ্যায় পরে আলোচিত হবে, কারণ ৬০-এ আরম্ভ এই তৃতীয় তরঙ্গের বঙ্গাল খেদানোর ধারাবাহিকতায় ঐ দশকেই বাংলাভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আসামে বাঙালীর ঘুরে দাঁড়ানোর সন্ধিক্ষণ এসে উপস্থিত হল। পড়তে পড়তে লিখতে গিয়ে শুধু পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী গণহত্যা, তাদের বিকলাঙ্গ করে দেওয়া এবং যাদের চলচ্ছক্তি ছিল তাদের উদ্বাস্তু হয়ে কাঁটাতারের এপাশে চলে আসার তুলনা মনে আসছে।
এটাই প্রথম ব্যাপক ও সর্বাঙ্গীন হিংসাত্মক বাঙালীবিদ্বেষের প্রকাশ। বাঙালীর বাংলাভাষা ব্যবহারের অধিকার হরণের সরকারি আয়োজনের নাম ছিল ‘বঙ্গাল খেদা’। বাঙালীর সর্বস্ব লুঠপাট করে আসামকে বাঙালী শূন্য করার নাম ছিল ‘বঙ্গাল খেদা’। পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুপন্থী মুসলমানদের চেয়ে চরিত্রগত তফাত তো খুঁজে পাচ্ছি না এই মনোভাবের। হয়তো নৃশংসতার ব্যাপকতায় কিছুটা পিছিয়ে থাকবে, সেটাও সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় শক্তি অসমীয়াদের হাতে ছিল না বলেই।
Keywords: আসামে বাঙালী বিদ্বেষ, ঔপনিবেশিক আমল থেকে জমে থাকা বাঙালীবিদ্বেষ, স্বাধীনতা ও দেশভাগ, দেশভাগের পর আসামে শরণার্থী, হিন্দু বাঙালী শরণার্থী, আসামে বাঙালীবিদ্বেষী হিংসার প্রথম তরঙ্গ, আসামে বাঙালীবিদ্বেষী হিংসার দ্বিতীয় তরঙ্গ, মুসলিম নেতৃত্ব, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন, States Reorganization Commission, বঙ্গাল খেদা, গোরেশ্বর গণহত্যা, বাঙালীবিদ্বেষী হিংসার তৃতীয় তরঙ্গ, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, আসাম শুধু অসমীয়াদের, হিন্দু বাঙালী পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আশ্রয়, কামরূপ, নওগাঁও, গোয়ালপাড়া
তথ্যসূত্র:
"Bangladesh". State.gov. Archived from the original on 27 October 2019. Retrieved 25 October 2013. "Bangladesh – Population Census 1991". catalog.ihsn.org.