২০২৪-এর জুন মাসে প্রায় হঠাৎ করেই শোনা গেল বাংলাদেশে আরম্ভ হয়েছে সংরক্ষণবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকা হাইকোর্ট ২০১৮-য় বাতিল হয়ে যাওয়া ৩০% মুক্তিযোদ্ধা বংশের জন্য ও অন্যান্য সংরক্ষণ-সহ কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেওয়ার পরই শুরু হয়েছে এই আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের দাবি কোটা নয়, মেধাই হোক সরকারিতে যোগ্যতার মাপকাঠি। এ তো অতি প্রগতিশীল ভাবনা। কিন্তু ওদেশের সর্বোচ্চ আদালত সংরক্ষিত আসন সংখ্যায় ধস নামিয়ে মেধাভিত্তিক আসন ৯৩% রেখে মুক্তিযোদ্ধা বংশধরদের জন্য ৫%, জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য ১% এবং নারী কোটা বাতিল করে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১% বরাদ্দের করার পক্ষে রায় দিয়ে হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা জারি করার পরেও ‘কোটা-বিরোধী’ আন্দোলন ক্রমশ হিংস্র, উন্মত্ত ও স্পষ্টত সরকারবিরোধী হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর আওয়ামি লীগ সরকার বিদ্রোহ দমনে রীতিমতো কঠোরতা দেখালে ক্ষিপ্ত ছাত্ররা ক্রমশ পুলিশ প্রশাসন ও আওয়ামি লীগ সদস্যদের আক্রমণের পাশাপাশি হিন্দুদের ওপরও আক্রোশ মেটাতে থাকে। ওখানে যে আন্দোলনই হোক, হিন্দুরক্ত না বইয়ে হয় না। দেখা গেল সরকারি সেনাবাহিনীও বিদ্রোহ দমনের ছলে নেমে বিদ্রোহীদেরই সহায় হয়ে সরকারকে উৎখাতের কাজটাই ত্বরান্বিত করল। হিন্দু নির্যাতনের পরিচিত খেলাতে মেতে উঠল আন্দোলনকারীরা যাদের নেপথ্যে কট্টর হিসলামপন্থী শক্তির কলকাঠি স্পষ্ট।
হাসিনা তো ভারতে পালিয়ে এসে আশ্রয় ও রানীর হালে আতিথ্য পেলেন। কিন্তু তাঁর সরকার যে দেশবাসীদের এতদিন সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল বা পরোক্ষে অসুরক্ষিত রেখেছিল, সেই হিন্দু বাঙালীদের জন্যই ভারতের সীমা রুদ্ধ হয়ে গেল। অথচ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এর মাধ্যমে বাংলাদেশী হিন্দুদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ভারতবর্ষে তাদের অবস্থা বিবেচনা করে সহজ শর্তে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
ওদিকে জালে পড়া শিকারগুলোকে কেটে-ঝলসে-ধর্ষে ছাত্র-সেনা-জামাতের মহোল্লাসে বনভোজন চলল। ১৯৭১-এ যে কাজটা অসম্পূর্ণ ছিল, সেটাও পূরণ করার সুবর্ণ সুযোগ। পাওয়া গেল পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই যোগ। অর্থাৎ বাংলাদেশের যে অভ্যুত্থান হয়েছে তা সুপরিকল্পিত।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ নলীন কুমার মহাপাত্রের অভিমত, বাংলাদেশ আভ্যুত্থান অনেকটা এর আগে পশ্চিম এশিয়ায়, উত্তর আফ্রিকার ওয়ানা অঞ্চলে এবং সোভিয়েত পরবর্তীতে ঘটা 'Colour Revolution'-এর সদৃশ। যদিও তথাকথিত ‘বর্ণ বিপ্লব’ নাকি ‘বর্ণচোরা বিপ্লব’ সোভিয়েত আধিপত্য থেকে মুক্ত জর্জিয়া, ইউক্রেইন, কিরগিজ়স্তান ইত্যাদি দেশগুলোতে পাশ্চাত্য উদারতার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশের এনে দিয়েছে কট্টর ধর্মান্ধতার অন্ধকার; কিন্তু ৫ আগস্ট মহম্মদ ইউনুসকে উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিবিধি দেখে আর সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই অভ্যুত্থানও ঘটেছে সেই কায়দায় যেভাবে বৈদেশিক মদতে পশ্চিম এশিয়া ও সোভিয়েত-মুক্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছিল। প্রসঙ্গত মার্কিন মুলুককে বাংলাদেশের ব্যাপারে যারপরনাই অত্যুৎসাহী হতে দেখা যাচ্ছে।
হাসিনা সরকারের অপসারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে বাংলাদেশকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পথ প্রশস্ত করল। বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (BNP), জামা্ত-ই-ইসলাম (JII) ও সেনাবাহিনীর প্রাধান্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মিলিত ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় পরিস্থিতি আরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটময় হয়ে উঠেছে, যা বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অবশ্যম্ভাবী প্রভাব ফেলতে চলেছে। আর সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হতে চলেছে ভারত বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ; এবং বলা বাহিল্য সেটা কুপ্রভাব।
অবশ্য এর যথেষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছিল গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশীদের নির্লজ্জ ভারত বিরোধিতার মাধ্যমে। তারও আগে আভাস পাওয়া গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের একাধিক মুসলিম এলাকায় ‘বৃহত্তর বাংলাদেশ’ বর্তমানে যার নাম হয়তো ‘বাংলাস্তান’, তার মানচিত্রসহ নীলনকশা আবিষ্কৃত হওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মোহে অন্ধ বাঙালী সতর্ক হওয়ার পরিবর্তে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (NIA) ও কেন্দ্র সরকারের ওপর বিরক্ত হয়েছে, আর ইসলামিক মৌলবাদকে প্রগতিশীলতার পোশাকে ঢাকতে চেয়েছে। ফলে বর্ণবিপ্লবের রংটা আমাদের এমন চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছিল যে তার ক্রমবিবর্তনটা চোখে পড়েনি; তথাকথিত নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদকে মসনদে বসিয়ে জামাত-ই-ইসলামী তালিবানি রাজ কায়েম করার পর চোখে লাগছে।
তবে সব জেনেশুনেও ভারত সরকারের নির্মম নীরবতা ও নিস্পৃহতা দেখে বাঙালী হিসাবে হাড় হিম হয়ে আসে। কেন্দ্র সরকারের এমন করাল রূপ আগে কেউ দেখেনি।
এই অভ্যুত্থানের সূত্রপাত বুঝতে গেলে বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থাটা সংক্ষেপে জানা দরকার। ভারতের মতো সর্বস্তরে না হলেও Bangladesh Civil Service-এ একটা কোটা বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছিল যার মূল সুবিধাভোগী ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের বংশধরেরা।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস Civil Service of Pakistan-এর অনুসরণে সৃষ্টি যার জন্ম ব্রিটিশ ভারতের Indian Civil Service ব্যবস্থা থেকে। স্বাধীনতার ঠিক পরেই মুজিবর রহমানের প্রধানমন্ত্রিত্বে সিভিল সার্ভিসে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়। সূচনাতেই আপত্তি করেছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী যাঁর মত ছিল চাকরি পুরোপুরি মেধাভিত্তিক হোক। তা সত্ত্বেও মন্ত্রীসভায় আইন পাস হয় এবং কোটা ব্যবস্থা চালু হয়, যার মাধ্যমে এই অতি কাঙ্খিত চাকরির ৩০ শতাংশ প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়, ১০ শতাংশ রক্ষিত হয় মুক্তযুদ্ধের সময় ধর্ষিতা মহিলাদের জন্য এবং ৪০ শতাংশ যথেষ্ট জনপ্রতিনিধিত্ব নেই এমন কিছু জেলার জন্য। এর ফলে মেধাভিত্তিক পদ পড়ে থাকে মাত্র ২০ শতাংশ।
মুজিব ১৯৭৫ সালে নিহত হওয়ার পর নতুন সরকার ১৯৭৬ সালে স্বল্প প্রতিনিধিত্বের জেলার জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা কমিয়ে ২০% করে, যার ফলে মেধারভিত্তিক পদ বেড়ে হয় ৪০%। ১৯৮৫-তে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিতা রমণীদের জন্য সংরক্ষিত ১০% আসন সব নারীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। জেলাভিত্তিক কোটাও অনেকটা কমিয়ে ১০% করা হয়, পরিবর্তে স্থানীয় আদিবাসীদের জন্য ৫% সংরক্ষণ চালু করে। এই সংস্কারের ফলে সিভিল সার্ভিসে মেধাভিত্তিক পদ হয়ে দাঁড়ায় ৪৫%।
স্বাধীনতার ২৬ বছর পর ১৯৯৭ সালে যখন মুক্তিযোদ্ধারা বয়সের কারণে কর্মক্ষম নেই, তখন তাদের নিমিত্ত কোটা তাদের উত্তরসূরীর জন্য সংরক্ষিত করা হল। ২০০৮-এ যোগ্য নিয়োগের স্বার্থে এই ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি, এই মর্মে রিপোর্ট জমা পড়ল প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্ভেন্টের পক্ষ থেকে। তারপরেও ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা তাদের নাতি-নাতনীর প্রজন্ম পর্যন্ত প্রসারিত করা হল। তাতে ভাগ না বসিয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১% কোটা এনে মেধাভিত্তিক নিয়োগের অংশই ৪৪%-এ নামানো হল।
২০১৮-য় কোটা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবেদন জমা পড়ে আদালতে। আবেদন নাকচ করে দেয় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট (Supreme Court of Bangladesh)। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রতিবাদের জেরে সব কোটা তুলে দেন। কিন্তু প্রতিবাদীরা সংরক্ষণ প্রথার সংস্কার চেয়েছিল, বিলুপ্তি নয়। জুলাই ২০২০-তে কোটা বিলুপ্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যা জিইয়ে রাখলে যা হয়। ২০২১-এ কোটা বিলুপ্তির রায়কে চ্যালেঞ্জ জানায় জনৈক মুক্তিযোদ্ধার বংশধর ও অন্য ৬ ব্যক্তি। ৫ জুন ২০২৪ বাংলাদেশের হাইকোর্ট সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে পুনরায় প্রাথমিক অবস্থায় ফিয়িয়ে আনার পক্ষে রায় দেয়। আর এটাই বিক্ষুব্ধ জনতার জমানো বারুদে অগ্নিসংযোগ করে।
ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের Students against Discrimination নামে এক ছাতার তলায় সংগঠিত করে প্রথম দফা প্রতিবাদে নামে।
২০২৪ সালের বাংলাদেশ কোটাব্যবস্থা সংস্কার আন্দোলন “জুলাই বিপ্লব” নামেও অভিহিত হচ্ছে, যার চালিকাশক্তি মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ছাত্রীরাও ছিল সঙ্গতে। প্রথমে সরকারী চাকরির জন্য কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হলেও এটি দ্রুত একটি বৃহত্তর আন্দোলনের রূপ নেয়। সরকারকে স্বেচ্ছাচারী হিসাবে শনাক্ত করে তার পদত্যাগের দাবিতে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ রূপে বিকশিত হয়।
৫ জুন ২০২৪-এ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বংশধরদের জন্য ৩০% কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করার পক্ষে রায় দেয় বাংলাদেশ হাইকোর্ট, যে ব্যবস্থা ২০১৮ সালেই আন্দোলনের জেরে সরকার বাতিল করেছিল। তারপরেই ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। ঈদুল আজ়্হা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটির কারণে কিছুদিন আন্দোলন স্থগিত রাখার পর আন্দোলনটি পুনরায় শুরু করা হলে তা ক্রমশ ব্যাপক ও তীব্র আকার ধারণ করে। সচরাচর আন্দোলন স্থগিত রাখলে তা শিথিল হয়ে যায়। কিন্তু এখানে দেখা গেল দ্বিতীয় পর্যায়ে তা তীব্রতর হয়ে গেল। মানে আটঘাট বেঁধে একটা সুচারু পরিকল্পনা করেই ময়দানে নামা হয়েছিল।
১ জুলাই প্রথমে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ পুনরায় শুরু হয়, এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন সার্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রতিবাদে ধর্মঘট ঘোষণা করেন, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়। ওদিকে প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ (Anti-discrimination Students Movement) নামে একটি ছত্রি সংগঠনের ব্যানারে ‘বাংলা অবরোধ’ শুরু করে যা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাথমিকভাবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এই আন্দোলনে যোগ দিলেও পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভে শামিল হয়। ৭ জুলাই, প্রতিবাদকারীরা সারাদেশব্যাপী ‘বাংলা ব্লকেড’-এর ডাক দিয়ে ‘বাংলা অবরোধ’ শুরু করে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, রাজশাহী ও বগুড়াসহ প্রধান শহরগুলোতে যানবাহন ও রেলপথ অবরোধ করে, যার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রচণ্ড ব্যাহত হয়।
মেয়েরাও নারীদের জন্য বরাদ্দ সামান্য সংরক্ষণের বিরোধিতায় নেমে পড়ে। আন্দোলনের জেরে ১০ জুলাই আদালতের আপিল বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে চার সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ জারি করে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা আদালতের স্থগিতাদেশ নয়, সরকারের কাছ থেকে কোটা সমস্যার একটি চূড়ান্ত সমাধান দাবি করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
১১ জুলাই পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ফলে আন্দোলন প্রথমবারের মতো হিংসাত্মক রূপ নেয়। ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বিরোধী বিক্ষোভ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কোটা না পেলে কি রাজাকারদের নাতিপুতিরা পাবে?” এই মন্তব্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে বিক্ষোভকারীদের “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে খোঁচা দেওয়া হয়েছে ধরে নিয়ে স্লোগান ওঠে — “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার”, “এক দুই তিন চার; আমরা হলাম রাজাকার”, “চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার” ইত্যাদি। পরে অবশ্য বোঝা গেল আন্দোলনের নেপথ্যে রাজাকারদের বংশধরেরাই ছিল পুরোভাগে।
১৫ জুলাই শাসকদল ও সরকার ক্রমশ হিংসাত্মক হয়ে ওঠা আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর দমন নীতি প্রয়োগ করে; ফলে পারস্পরিক সংঘর্ষে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হয়। উল্টোদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বিশেষ করে ছাত্রলীগের সভাপতি-সহ অন্যান্য সদস্যদের কক্ষগুলোতে ব্যাপাক ভাঙচুর চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের সদস্যদের ১১টি কক্ষ থেকে বের করে দেয় ও কোটা পদ্ধতির পক্ষে থাকা ছাত্রসংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রছাত্রীরা তাদের ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগের সদস্যদের বের করে দেয়। ১৫ জুলাই চট্টগ্রামে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের কমপক্ষে ১৫ জন সদস্যকে ছয়তলার ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই ঘটনার পর অনেক ক্যাম্পাসই নিজেদের ‘ছাত্রলীগ মুক্ত’ ঘোষণা করে।
অন্যদিকে ১৬-১৭ জুলাই উঠে আসে সিলেটে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা, চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুই কর্মীর গুলি চালনা, শাবিপ্রবি অঞ্চলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হল দখল নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তল্লাশিতে ছাত্রলীগ নেতাদের রুম থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও নেশার দ্রব্য উদ্ধার হওয়া, এইসব সংবাদও।
দুই পক্ষেই শতাধিক হতাহত। ১৬ জুলাই জারি করা নির্দেশ অনুযায়ী ইউজিসি ১৭ জুলাই সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরবর্তী নির্দেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করে এবং নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়তে বলে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের পাশাপশি নেমেছে Rapid Action Battalion (RAB)। উপরন্তু সরকার ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও রাজশাহীতে সরকার Border Guard Bangladesh (BGB) মোতেয়ন করে।
১৭ জুলাই রাতে আন্দোলনকারীরা ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচির ঘোষণা করে। এর পরিপ্তরেক্ষিতে বিজিবি একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারা দেশেই ২২৯ প্লাটুন বিজিপি মোতায়েন করা হচ্ছে।
১৮ জুলাই দেখা গেল বাংলাদেশের ব্যাংক, বাংলাদেশ ছাত্র লীগ (BCL), এমনকী বাংলাদেশ মন্ত্রকের ওয়েবসাইট হ্যাকড হয়েছে। ওয়েবসাইট খুললে “Huntdown” শিরোনামে শান্তির প্রতিষ্ঠা, ছাত্র সংহার পরিহারের দাবি রয়েছে।
আন্দোলন দমনের চেষ্টায় ১৯ জুলাই মধ্যরাতে দেশজুড়ে কার্ফিউ জারি হয়, সেনাও নামে। প্রধানমন্ত্রী স্পেন সফর বাতিল করেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কারফিউ প্রসঙ্গে বলেন “এটা অবশ্যই কারফিউ। এটা নিয়ম অনুযায়ীই হবে এবং সেটা শুট অ্যাট সাইট হবে”।
সকাল ১১টা থেকেই মেরুল-বাড্ডায় BRAC University সহ অন্যান্য স্কুল-কলেজে পুলিশ-ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ, এবং মীরপুরের ‘Bangladesh University of Business & Technology’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, Bangladesh University of Professionals সমেত অন্যান্য শিক্ষায়তনে আন্দোলনকারী-পুলিশ প্রবল সংঘর্ষের সময় পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ হতেই ব্যাপক এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের গুলিতে নর্দান ইউনিভার্সিটির ২ শিক্ষার্থী নিহত ও শতাধিক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এছাড়াও মাদারীপুর সরকারি কলেজের এক ছাত্র পুলিশের ধাওয়ায় হ্রদে পড়ে, রামপুরায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এক গাড়িচালকের পুলিশের গুলিতে ইত্যাদি মিলিয়ে তল্লাটে সেদিন প্রায় ৩০ জন ছাত্র-জনতা পুলিশের হাতে মারা যায়। একই সঙ্গে সরকারের নির্দেশে সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। রাত ৯টা নাগাদ সরকার সারাদেশে সব ধরনের ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। পরে ব্লক করা হয় ফেসবুক, টিকটক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিও।
পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সরকার ১৯ জুলাই রাতে বৈষম্যবিরোধী আনদোলনের তিন প্রতিনিধি সরসিজ আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ্ ও তনভীর আহমেদের সঙ্গে আলোচনায় বসে। সরসিজ আলম একসময় ছাত্রলীগের নেতা ছিল ও সেই হিসাবে Dhaka University Central Students' Union-এর নির্বাচনে অংশও নিয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বাবার অভিযোগ, আলোচনা চলাকালে নাহিদকে বন্ধুর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে যাওয়া হয়। নাহিদের অভিযোগ, চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে অত্যাচার চালিয়ে তাকে অচেতন করে দেওয়া হয়। তারপর পূর্বাচলে তার জ্ঞান ফেরে।
এরপর ২১ জুলাই ২০২৪ ওদেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপীল বিভাগ (Appellate division of the Supreme Court) কোটার অনুপাত ৫৬% থেকে কমিয়ে ৭% করার সুপারিশ করে। বৈষম্যবিরোধীরা তাতেও সন্তুষ্ট নয়। পুলিশের সংঘর্ষ অব্যাহত রাখে। ফলে এদিনও বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি বাহিনীকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাতে হয়। হিংসায় পাঁচজন নিহত হয়। সেতুভবন ভাঙ্গচুর, রামপুরার বিটিভির ভবনে আগুন দেওয়া ও বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন মামলায় পুলিশ বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নিপুণ রায় ও গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয়। প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা করে।
এরপর ২২ জুলাই প্রতিবাদীরা দুই দিনের জন্য আন্দোলন স্থগিত রাখে। এবার তাদের দাবি সরকারকে কার্ফিউ তুলে নিতে হবে, ইন্টারনেট পরিষেবা ফিরিয়ে আনতে হবে ও প্রতিবাদী ছাত্রদের আর ধরপাকড় করা চলবে না। এদিন এক নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি আরও একদিন (মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০২৪) বাড়ানো হয়। দুপুরের দিকে কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও হিংসার জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, শিবিরকে দায়ী করেন ও ‘আরও শক্ত অ্যাকশন’ নেওয়ার কথা জানান।
বিধিনিষেধ শিথিল করে ২৩ জুলাই সরকারি তরফে ঘোষণা করা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক, রপ্তানির ইত্যাদির জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা পুনরায় চালু করার কথা। ২৪ জুলাই থেকে ব্রডব্যান্ড ফিরেও আসে, তবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক ছাড়া।
কিন্তু ২৬ জুলাই পুলিশ হাসপাতালে নাহিদ ইসলাম, আবু বকর ও আসিফ মাহমুদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকে রাখে। পরের দিন সরসিজ আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকেও ধরা হয় তাদের সঙ্গে বিরোধী শক্তি জামাত-ই-ইসলাম ও গণ অধিকার পরিষদের সচিব/সম্পাদক নুরুল হক নূরের যোগাযোগ আছে অভিযোগে। আটক সমন্বয়কদের মুক্তি না দিলে এবং প্রতিবাদীদের হত্যার জন্য দায়ী মন্ত্রী ও পুলিশকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ২৯ জুলাই থেকে আবার আন্দোলন জোরদার করা হবে হুমকি দেওয়া হল।
২৮ জুলাই এদের নিয়ে মোট ৬ জন প্রতিবাদী Detective Branch দপ্তরে প্রতিবাদ কর্মসূচী প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচী স্থগিত করে। তাতে অন্যান্য সমন্বয়করা অভিযোগ করে ওদের ৬ জনকে জোর করে ঐ বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছে। অতএব ওদের সমর্থন সহ বা ছাড়াই চলবে প্রতিবাদের পালা।
সরকার হুমকির সময়সীমা পাত্তা না দেওয়ায় প্রতিবাদীরা ব্যাপক ও বিশালাকারে দেশের বিভিন্ন দিক থেকে প্রদর্শন শুরু করল। পুলিশও ২৮২২ জন ছাত্রছাত্রীকে গ্রেফতার করল। প্রতিবাদে পথে নামে শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অপরাজেয় বাংলা’ পদযাত্রায় বিদ্যালয় নিহত ছাত্রহত্যার ঘটনাকে নাম দেয় “জুলাই গণহত্যা” ("July Massacre")।
২৯ জুলাই সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ৩০ জুলাই দিনটিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ‘শোকদিবস’ ঘোষণা। আওয়ামি লীগ নেতারা ফেসবুকে কালো প্রোফাইল ছবি দিলেন শোকজ্ঞাপন করতে। কিন্তু প্রতিবাদীদের তাতেও গায়ে জ্বালা। বিচার পাওয়ার পর নাকি শোক পালন করা হবে। নেতারা নির্দেশ দিল শোক নয়, শহীদদের স্মরণ করা হবে ১ আগস্ট সোশাল মিডিয়ায় প্রোফাইল-ডিপি লালে-লাল করে।
Transparency International Bangladesh-এর কার্যকরী পরিচালক ইফতিকারউদ্দীন, Bangladesh Environmental Lawyers Association (BELA)-এর মুখ্য আধিকারিক সৈয়িদা রেজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রমুখ বেশকিছু বিশিষ্ট মানুষ সরকারি পদে থেকেও বাংলাদেশ সরকারকে ৬ জন গ্রেফতার করা সমন্বয়ককে Detective Branch (DB) হেফাজত থেকে শর্তহীন মুক্ত করার জন্য চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিলেন।
৩১শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ দেশজুড়ে “বিচারের দাবিতে পদযাত্রা” ("March for Justice") আয়োজন করে। শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, শ্রমজীবী — সব পেশার নাগরিকদের কাছে সহযোগিতার আবেদন রাখে। চট্টোগ্রামে বিএনপি সমর্থক ৫০-৬০ জন আইনজীবী এই পদযাত্রা শুরু করলে আওয়ামি লীগও পালটা পদযাত্রা আয়োজন করে। কিন্তু প্রতিবাদীরা পুনরায় ঢাকা-রাজশাহী রাজপথ অবরোধ করায় পুলিশও ৫ জনকে গ্রেফতার করল। তবে সেইদিনই ৩১ জুলাই ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ সহ সামাজিক মাধ্যম পুনরায় খুলে যায়।
সরকারি শোকদিবসকে নাকচ করে ১ আগস্ট আন্দোলনকারীরা পালন করল “Remembering Our Heroes” কর্মসূচী সোশাল মিডিয়ায় #JulyMassacre ও #RememberingOurHeroes হ্যাশট্যাগ সহকারে। ২ আগস্ট নিহত-আহতদের সুবিচার, ছাত্রনেতাদের মুক্তি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খোলা ইত্যাদি ৯ দফা দাবি জানিয়ে সেই দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে উঠল। আবার চলল রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, শব্দ গ্রেনেড উত্তরা, খুলনা, সিলেট, হবিগঞ্জ এবং আরও বেশ কয়েক স্থানে।
উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আন্দোলনের সমন্বয়করা তা প্রত্যাখ্যান করে। এইখানেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ইতি এবং সূচনা ‘অহসযোগ আন্দোলন’-এর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। উল্টোদিকে প্রতিবাদীদের, অভিযোগ সরকার সাধারণ জনতার ওপর ব্যাপক আগ্রাসন চালানোর ফলেই এই ছাত্র আন্দোলন সরকার-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে এবং কার্যত একটি গণ- অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। তাই কারফিউ থাকা সত্ত্বেও আন্দোলন অব্যাহত থেকেছে এবং তার দাবিও প্রসারিত হয়েছে।
বিক্ষোভ ও দমনের জেরে ব্যাপক হতাহত হয়। আগস্ট ২ পর্যন্ত ২১৫ জন নিহত, ২০,০০০-এর বেশি মানুষ আহত এবং ১১,০০০-এর বেশি মানুষকে বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। বেসরকারি সূত্রানুযায়ী মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত হতে পারে বলে অনুমান। একটি সূত্র আবার জানাচ্ছে, দেশজুড়ে কারফিউ জারি ও রাস্তায় সেনা নামানোয় প্রায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী ও কয়েক হাজার অন্যান্য নাগরিক আহত হওয়ার পাশাপাশি ৬৭৩ জনের অধিক নিহত হয়। ইউনিসেফ-এর মতে কমপক্ষে ৩২ জন শিশু নিহত এবং আরও অনেকে আহত ও আটক হয়েছে। তবে ২৯ জুলাই গণপরিষদের বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সংঘর্ষ ও হিংসা মোট ১৫০ জন মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করেন।
পুলিশ-সূত্রে খবর, আন্দোলন শুরুর পর থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত এবং ১,১১৭ জন আহত হয়েছে। এছাড়া পুলিশের ২৩৫টি থানা, ফাঁড়ি ও ক্যাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুলিশের ২৮১টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, ১৭-২৩ জুলাই এই সাত দিনে সারা দেশে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে ১১৩টি। এরমধ্যে ঢাকাতেই অগ্নিসংযোগ ঘটে ৯০টি।
আবার অভিযোগ সরকার হাসপাতালগুলোকে পুলিশের অনুমতি ছাড়া তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়ায়, সেগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ বাজেয়াপ্ত করায় ও বহু দেহ অশনাক্ত অবস্থায় কবর দেওয়ায় প্রকৃত মৃত্যু সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আন্দোলনের অগ্রগতির নানা স্তরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দাবিগুলি পরিবর্তিত হতে থেকেছে। মূলত তিন প্রস্থ দাবি উত্থাপিত হতে দেখা গেছে।
প্রাথমিক দাবি : আন্দোলনের গোড়ার দিকে দাবি ছিল মূলত তিনটি।
১. সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল।
২. সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ন্যায্য হারে কোটা বরাদ্দ।
৩. কোটা সর্বোচ্চ ৫%-এ নামিয়ে একটি নতুন আইন পাস।
নয় দফা দাবি : আন্দোলনে দেশজুড়ে কয়েক শত শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও হাজার হাজার ছাত্র-জনতার আহত হওয়ার কথা স্বীকার করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ৩0 জুলাই ‘রাষ্ট্রীয় শোক’ পালনের দিন ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু আন্দোলনের সমন্বয়করা ‘রাষ্ট্রীয় শোক’ পালনের সরকারি প্রস্তাবটি সরাসরি প্রত্যাখান করে ১ আগস্ট চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে 'রিমেম্বারিং দ্য হিরোস' কর্মসূচী পালন করার কথা ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশ বাহিনীর হিংসাত্মক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সরকারের আছে সংশোধিত ‘নয় দফা’ দাবি পেশ করে। সেগুলো হল —
১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র ও নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
২. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, দলীয় ক্যাডার দ্বারা ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে, কারণ এঁরাই হিংসাত্মক কাজ চালিয়েছেন।
৩. যে অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা নিহত হয়েছে, সেখানকার ডেপুটি পুলিশ মহাপরিদর্শক, পুলিশ কমিশনার এবং পুলিশ সুপারদের তাদের পদ থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রক্টরদের হিংসার সময় ছাত্রদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতার কারণে পদত্যাগ করতে হবে।
৫. বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৬. পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সামরিক কর্মকর্তা ও আক্রমণে জড়িতদের আইনের আওতায় গ্রেপ্তার ও বিচারাধীন করতে হবে।
৭. বিক্ষোভ কালে নিহত ও আহতের পরিবারগুলিকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৮. অবিলম্বে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ছাত্রাবাস পুনরায় খুলতে হবে।
৯. শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মীদের প্রত্যাহার করতে হবে।
এছাড়াও ৩০ জুলাই ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’ নামে একটি সংস্থাও কোটা আন্দোলনের ধৃত ৬ সমন্বয়কের মুক্তিসহ আরও নয় দফা দাবি পেশ করেছিল।
৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনা আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী নাহিদ ইসলাম জানায়, তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নয়। আরেক সমন্বয়কারী আসিফ মাহমুদ বলে, "গুলি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে কোনো সংলাপ হতে পারে না।"
এক দফা দাবি : ৩ আগস্ট বিকেল ৫:৩০-এ শহীদ মিনারে নামে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোহম্মদ নাহিদ ইসলাম ‘নয় দফা দাবি’র পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা না করেই সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে একটিই মাত্র দাবি রাখে -- প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের সবার পদত্যাগ। এটাই ‘একদফা দাবি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, সুপ্রীম কোর্ট যেখানে প্রতিবাদীদের পক্ষে রায় দিল, সরকার যেখানে তা মেনে নিয়ে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল, সেখানে আর কীসের আন্দোলনের অবকাশ থাকে, যেখানে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা আন্দোলন সমন্বয়করাও প্রথমে প্রতিবাদ প্রত্যাহারে রাজি ছিল? কিন্তু দেখা গেল এর পরেই আন্দোলন হিংস্রতর হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্র: