গুড়গাঁওতে একটা কলেজে চাকরির প্রস্তাবপত্র আসা ইস্তক সায়ন্তন যেন কেমন একটা ব্যবহার করছে। অবশ্য নানা ধরণের ‘কেমন কেমন’ আড়াছাড়া ব্যবহার ও যে কোনও অজুহাতেই করে থাকে। অভিনন্দনের মধ্যে আন্তরিকতার চেয়ে খোঁচাই বেশি। কোনও ঈর্ষা কাজ করছে কি? আপাতত নিয়মিত দেখা হবে না বলে আর দেখা করার ইচ্ছাটাও চলে গেল? যোগাযোগের উপায় তো অনেক। কিন্তু ইচ্ছাটাই যদি না থাকে। অত দূরে চাকরি নিয়ে যাওয়া মানে কি জীবন থেকেই সরে যাওয়া? ঈশিতা তো তা মনে করছে না। কিন্তু সায়ন্তনের আচরণে কথায়বার্তায় কেবল চিরবিদায় আর বন্ধনমুক্তির ঘোষণা।
“পাট চুকল বলছিস কেন? আপাতত দু বছরের কনট্র্যাক্ট। আমি এদিকের ইন্সিটিচ্যুটগুলোতে ট্রাই করে যাব। কিন্তু এখন এমন চাকরি পেয়ে ছেড়ে দেওয়ার বিলাসিতা আমি অ্যাফর্ড করতে পারব না। বাবা অন দ্য ভার্জ অব রিটায়ার্মেন্ট। ভাই প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অ্যাডমিশন পেয়েছে। আমার সাপোর্টটা এখন খুব দরকার”।
“সাপোর্ট তো আমিও চেয়েছিলাম। পেলাম কি?”
নিজের ছোট অ্যাড এজেন্সিতে সায়ন্তন বান্ধবীকে কখনও কপি রাইটার হিসাবে, কখনও পার্টনার তথা ডায়রেক্টর হিসাবে যোগদানের প্রস্তাব গত এক বছরে অন্তত সত্তরবার দিয়েছে আর তার সম্মতি আদায়ের পর চুপ মেরে গেছে অথবা ঈশিতার মুখে কাল্পনিক প্রত্যাখ্যানের সংলাপ নিজেই বসিয়ে অভিমান দেখানোর ছলে গুটিয়ে গেছে। অথচ এই চাকরিকাণ্ডেও সেই একই অভিযোগ। ইংরিজি ও গণসংযোগে স্নাতোকত্তর পাস করে দুর্মূল্যের বাজারে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী একটা পেশা নিয়ে কী এমন ভুল করেছে ঈশিতা? ও তো নিজের সবটুকু বৌদ্ধিক ও শারীরিক কর্মকুশলতা নিয়ে বন্ধুর পাশেই দাঁড়াতে চেয়েছিল, এখনও চায়। বন্ধুই হিসেব-নিকেশ কষে ঠিক করতে পারছে না ব্যবসায়িক গাঁটছড়া বাঁধলে পরে কে বেশি উপকৃত হবে। প্রেমিকা অধিকতর লাভবান হয়ে যাবে না তো? নিজের চেষ্টায় কষ্ট করে দাঁড় করানো ব্যবসায় ভালোবাসার পাত্রীও ফোকটে পা রাখার সুবিধা পেয়ে যাক – মন সায় দেয় না। তাকেও দই সাঁটাতে আসা নেপো বলে সন্দেহ হয়। তাই মুঠো আলগা করতে গিয়েও পিছিয়ে আসা। ঈশিতার এক এক সময় মনে হয় ওকে গাছে চড়িয়ে মই কেড়ে নিয়ে বারবার অপমান করাতেই সায়ন্তনের আনন্দ। তারপরেও ঈশিতা সম্পর্ক টিঁকিয়ে রাখার মরিয়া হ্যাংলামিতে নিজের প্রত্যাশাগুলোকেই শাসন করছে। বলেছে, “আমি ব্যবসার কমপ্লিকেসিতে ঢুকতে চাই না। তোর সাহায্য লাগলে অ্যাজ আ ফ্রেন্ড করতে পারি”।
ছমাস আগে যখন সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিল, তখন সায়ন্তন বিস্তর ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে বোঝাতে চেয়েছিল, ‘মাতৃগর্ভে রতনের রাজি’ ফেলে ‘কেলিনু শৈবাল ভুলে কাঞ্চন কোকনদে’-এর মতো বোকামি করতে চলেছে ঈশিতা। সায়ন্তনের অ্যাড এজেন্সি কি ঈশিতারও নয়? “যা একা একা দিল্লী-গুড়গাঁও বেড়াতে যাওয়ার শখ মিটিয়ে আয়”। অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসরের কাজটা পেয়ে বন্ধুকে উৎফুল্ল করার বদলে কি প্রেমিকের অহং-এ ঘা দেওয়া হয়ে গেল?
সায়ন্তনের কম্পানিতে যোগদান সংক্রান্ত বহু আলোচিত প্রসঙ্গটা আর উত্থাপন করতে ইচ্ছা করল না। সায়ন্তনের অভিযোগ কতটা মিথ্যে তা ও নিজেও জানে। ঈশিতা চুপ করে রইল। চলে যেতে তারই কি ভালো লাগছে? গলার কাছে দলা পাকানো কনকনে কষ্টটা গেলার চেষ্টা করতে লাগল।
তাছাড়া ‘ক্রিয়েটিভ আই’তে ঈশিতার সম্ভাব্য ভূমিকায় ছিল একটা অনুচ্চারিত শর্তের টানাপোড়েন। সায়ন্তনের দাবি বিয়ে ছাড়া একত্রে থাকা; আর ঈশিতার দায়দায়িত্বহীন সহবাসের বদলে প্রেমের সফল ও স্বাভাবিক পরিণাম হিসাবে বিবাহেই আস্থা। যে দায়িত্ব নিতে ভয় পায়, তাকে দেহও নয়। আর সেটাই যদি না পায়, সায়ন্তনের মতে তাহলে সম্পর্কের ভিত্তিটাই ফোঁপরা। তাই শরীর নিয়েও একটা দরাদরি মতানৈক্য। কিন্তু ঈশিতা সায়ন্তনের কাছ থেকে বৈবাহিক বা বাণিজ্যিক কোনওরকম সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি না পেয়েও ক্রমশ তারই শর্ত সামান্য নৈতিক প্রতিরোধ ও অনেকটা দৈহিক সমর্পণ দিয়ে পালন করার পথে। কদিন আগে এক দুপুরে – ।
সায়ন্তন ঈশিতাকে তৃপ্তি ও উল্লাসে আঁকড়ে ধরে বলেছিল, “তোর ব্যাপারটা এতটাই ভোলাটাইল ছিল.. আজ সিরিয়াসলি ধরা দিলি”। তার মানে এর আগে পর্যন্ত সায়ন্তনের কাছে ঈশিতার ভালোবাসা সত্যি ছিল না, ছিল উদ্বায়ী! তা ছিল বোধহয়। কিন্তু আর তো নয়। অথচ তার পরেও কীভাবে ও যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে এত সহজে ‘ফেয়ারওয়েল, বিদায়, মুক্তি’ কথাগুলো উচ্চারণ করতে পারে? শুধু উচ্চারণ? কার্যক্ষেত্রেও এতটা নিস্পৃহ হয়ে যেতে পারে,যে অনির্দিষ্টকাল বিরহের আগে একবার দেখা করারও তাগিদ নেই!অনায়াসে বলে দেয়, “তোর তো অনেক অ্যাডমায়ারার,হাত নাড়তে নাড়তে ফুটকি হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের কাউকে ডেকে নে”।
গুড়গাওঁ কিন্তু সায়ন্তনের আয়ত্তের বাইরে কোনও জায়গা নয়। দিল্লীর একটা প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে সায়ন্তনের ‘ক্রিয়েটিভ আই’-এর ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। গুড়গাওঁতেও একটা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চলছে। সুতরাং দিল্লী বহুত দূর নহি হেয়। কিন্তু ও যেন এটাকেই ঈশিতার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার উপলক্ষ করে নিতে চাইছে। বান্ধবীর বাড়ি কলকাতা থেকে অনেক দূরে। একটা হোস্টেলে এতদিন থেকে পড়াশুনো ও বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা চালিয়ে এসেছে। এবার সেই হোস্টেল ছেড়ে দেওয়ার পালা। কলকাতার হোস্টেলে পাতা পুরো সংসারটা গুটিয়ে দূরদেশে নতুন বাসায় স্থানান্তরিত করতে হবে। সুতরাং তল্পিতল্পা যা হবে তা একা একটা মেয়ের টেনে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে খুবই বেশী। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশিত হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার দায়িত্বটা বিশেষ বন্ধুই নেবে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও কোনও না কোনও উপায় খুঁজে বের করতে মরিয়া হবে।
ইশিতা বাঁকুড়ার ইন্দাসে নিজের বাড়িতে দেখা করে এসেছে। বাড়ির কেউ এই স্থানান্তরণের সময় সঙ্গে থাকতে পারবে না। ভাই ভীষণ ব্যস্ত। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সুযোগ পেয়ে মাথা কিনে নিয়েছে। বাবা অবশ্য আসতে চেয়েছিলেন, ঈশিতা বারণ করছে, ‘ভেবো না। কোনও না কোনও ভলেন্টিয়ার জুটে যাবে”। ঈশিতা চাইলে ওর হস্টেলের কোনও মেয়ের সাহায্য নিতে পারে, দারোয়ানের ছেলেটাকে কিছু বখশিস দিলে সেও স্টেশনে গিয়ে একেবারে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসতে পারে, অংশু কিংবা সার্থক তো মুখিয়েই আছে ওর কাজে লাগার জন্য। কিন্তু যাকে অনেকটা দিয়ে ফেলেছে, সারা জীবনটাই দিতে প্রস্তুত, সে ছাড়া প্রয়োজনের মুহূর্তে আর কাউকে প্রয়োজনের কথা জানাতেই ইচ্ছা করছে না। অন্যান্য কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে, এমনকি মা-বাবাও ফোনে উদ্বেগ প্রকাশ করলে মেজাজ খিঁচিয়ে যাচ্ছে।
সেই দুপুরের মান রাখতেও সায়ন্তনকে আগামীকাল যাত্রা শুরু করাতে আসতেই হবে, না হলে আর কোনওদিনও এসে কাজ নেই। মুখে বলেছে “তোকে কষ্ট করতে হবে না, আমার সমস্যা আমি সমাধান করব” আর মনে মনে প্রার্থনা করেছে “এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করিস না প্লীজ”। ভেবেছিল যাওয়ার আগে আর ফোন করা তো দূর, ধরবেই না। কিন্তু অনুরাগ বেশি হলে অভিমান টেঁকসই হয় না। সাধে কি ভালোবাসাকে দুর্বলতা বলে? ছি ছিঃ! তাই এখনও বারবার এসএমএস লিখে ড্রাফ্ট-এ সেভ করে রাখছে, ওর ফোন এলে ধরছে, উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চাইছে, “ভাবছিস কেন, আমি তো আছি। কাল কখন বেরোবি?”
চলভাষে সায়ন্তনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন বালিগঞ্জ পৌঁছে গেছে খেয়াল করেনি। ট্রেনটা চালু হতে টের পেল গন্তব্য ফস্কাচ্ছে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে,এরপর আর গুড়গাঁও-এর প্রতিষ্ঠানটার কলকাতা শাখা অফিস খোলা থাকবে না। রওনা হওয়ার আগে কয়েকটা বিষয় একটু পরিস্কার করার ছিল। মরিয়া হয়ে সহযাত্রীদের মানা অগ্রাহ্য করে চলন্ত ট্রেন থেকে গতিবিদ্যার অঙ্ক কষে টুক করে নেমে পড়তে গেল ঈশিতা। ফলাফলটা পূর্বানুমিত। বুক চেপে সজোরে আছাড় নোংরা প্ল্যাটফর্মে। ডান হাতের কব্জিসহ পুরো পাতা ও বাঁ কনুইয়ের যন্ত্রণায় আর বুকে শ্বাস আটকে থাকায় কিছুক্ষণ নিজে উঠতে পারছিল না। কোথা থেকে একটা ছেলে এসে ঈশিতাকে বলল,“নিজে উঠতে পারবেন, না ধরব?” ঈশিতাকে সাহায্য নিতেই হল। আরও দু-চার জন এগিয়ে এসেছে।
ঈশিতার বেহাল অবস্থা দেখে প্রশ্ন,“কোথায় থাকেন? বাড়ি যেতে পারবেন? বাড়িতে খবর দেব?”
“আমার বাড়ি তো অনেক দূর। বেলঘরিয়ায় হস্টেল। আঃ!-একটু ফার্ন রোডে যাওয়া খুব জরুরি ছিল। আর হবে না”।
“তাহলে এখানে কেউ নেই?” প্লাটফর্মে পড়ে যাওয়া মোবাইল কুড়িয়ে প্রশ্ন করল ছেলেটা।
তাই তো, এখানে কি সত্যিই কেউ নেই? ফোনে তো কেউ ছিল। প্রকৃতই আছে কিনা পরখ করবে? বলল, “লাস্ট যে নম্বরে কথা বলেছি, সেটায় ডায়াল করে দেখুন সে আসে কিনা”। যদি না আসে তাহলে একটা সিদ্ধান্তে আসতেই হবে। কষ্ট হবে খুব, কিন্তু কঠিন হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
“হ্যালো, আমি যার ফোন থেকে কথা বলছি, সেই মেয়েটার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বালিগঞ্জ স্টেশনে। হ্যাঁ। আপনি কি আসতে পারবেন? তাকে দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে ওভারব্রীজের নীচে বসিয়ে রেখেছি”
“অ্যাক্সিডেন্ট নয়, বলুন পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছি”। ঈশিতা সংশোধন করতে চাইল। রক্ত দেখলে যে অজ্ঞান হয়ে যায়, সে কি দুর্ঘটনা শুনে আসতে চাইবে?
“হ্যালো, এই মোবাইল যার, তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি কি আসছেন?”
“আরে, অ্যাক্সিডেন্ট নয়, জাস্ট পড়ে গেছি”।
পাশের এক মাঝ বয়সি পুরুষ মন্তব্য করল, “কত বড় অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারত বল তো? ওভাবে রানিং ট্রেন থেকে মেয়েছেলেকে নামতে আছে? একটু এদিক ওদিক হলে সোজা চাকার তলায় চলে যেতে। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটতে পারত। বাড়ি কোথায়?”
‘মেয়েছেলে’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি জানানোর অবস্থা এখন নয়। ঈশিতাকে ফোন ধরিয়ে ছেলেটা জানাল ‘সে’ আসছে। আসছে? দায়িত্ব নিতে যার এত ভয়, সম্পর্ক গড়তে গিয়ে যার এত হিসাব, সহায়তা দেওয়ার চেয়ে যার কাছে বিচ্ছেদ চাওয়া সহজ – সে আসছে এই জানাটুকুই যথেষ্ট, সত্যি সত্যি আর আনিয়ে কাজ নেই। সায়ন্তনের বাড়ি কাম দপ্তর সল্টলেকে। সেখান থেকে আসতে যা সময় লাগবে, ততক্ষণ স্টেশনে বসে থাকার চেয়ে কোনও মতে ডেরায় ফেরা ভালো।
ছেলেটাকে এবার প্রশ্ন করল ঈশিতা, “আপনি কোথায় যাবেন?”
“আমি তো ঐ কামরাতেই ছিলাম। সোনারপুর যাব। আপনাকে আমরা বারণ করলাম চলন্ত ট্রেন থেকে লাফাবেন না। ইএমইউ কোচ কত তাড়াতাড়ি স্পিড তোলে। ঢাকুরিয়ায় নেমে উল্টো দিকের গাড়ি ধরতেন”।
“তার মানে আপনিও চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন? তখন তো ট্রেন আরও স্পীড তুলেছে-”
“আমাদের অভ্যেস আছে। আপনার রিস্ক নেওয়া উচিৎ হয়নি। আমার জল আছে মুখে হাতে নিলে ভালো লাগবে”।
“জল লাগবে না। ঠিক আছি। আসলে এত দেরি হয়ে গেছে যে -। আপনি আমার বোকামোর জন্য শুধু শুধু ট্রেন মিস করলেন”।
“বারুইপুর আর বজবজ ছাড়া সব গাড়ি সোনারপুর হয়ে যায়। আবার পেয়ে যাব। ঐ যে অ্যানাউন্স করছে, আমি এগোই তাহলে”।
একটু ধাতস্থ হতে মোবাইল বার করল। ডান হাতে ধরা যাচ্ছে না। বাঁ হাতে কোনও মতে ডায়াল করে বলল, “তোকে আসতে হবে না, আমি নিজেই চলে যেতে পারব”
“আমি বেশি দূরে নেই। পনেরো মিনিটের মধ্যে পোঁছচ্ছি। তুই চুপটি করে বসে থাক যেখানে আছিস”।
“আমার গা পাক দিচ্ছে। মাথাও ঘুরছে। অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। শিয়ালদার ট্রেন আসছে আর একটা। এটা মিস করলে পরেরটা কখন জানি না। অতক্ষণ বসে থাকলে চলবে না। কাল বেরোনো আছে। আমি এই ট্রেনটায় উঠে পড়ছি”।
“একদম না। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। আমি অলরেডি কালীঘাট থেকে বাসে উঠে পড়েছি”।
এ তো জুলুমবাজি। মহা গেরো তো। ‘খুব খারাপ’ মানে কী? আর যোগাযোগ না রাখা? সে তো এমনিতেই রাখতে চায় না। তাহলে তার শাসানিকে ভয় কী? নাকি চায়? ট্রেন এক নম্বরে আসছে। এগিয়ে গেল ঈশিতা। ট্রেন এল, চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়েও গেল। ঈশিতা কেন অপেক্ষা করছে? ‘খুব খারাপ’-এর আশঙ্কায়? যন্ত্রণায় বমি পাচ্ছে। পরের গাড়িটা সায়ন্তন এসে পৌঁছনোর আগে এলেও মুশকিল, অথচ আর দেরি করা মোটেই সঙ্গত নয়।
আর একটা শেয়ালদা ছাড়তে হল। হস্টেলটা বেলঘরিয়ায়। কত দেরি হবে কে জানে? সায়ন্তনের ফোন। প্ল্যাটফর্মে খুঁজছে ঈশিতাকে। দেখা পেতেই অসুস্থতা অর্ধেক দূর। জরুরি ক্লায়েন্ট মিটিং আগামী কালের জন্য পিছিয়ে চলে এসেছে। সারা রাস্তা বিস্তর খবরদারি করতে করতে হস্টেলে পৌঁছে দিল। পথে জোর করে টেডভ্যাক নেওয়াল। ব্যথার ওষুধ হজমের ওষুধ কিনে দিল। ঈশিতার আপত্তি অগ্রাহ্য করে এক্স-রে করাল। এক্স-রের দামটা দেওয়ার সময় ঈশিতার ব্যাগের চেন খুলে সাহায্য করল। আগামীকাল চলে যেতে হলে রিপোর্ট পেয়ে কখন ডাক্তার দেখাবে তা নিয়ে অবশ্য কোনও প্রশ্ন নেই। হাঁটু ছড়ে যাওয়া ছাড়া পায়ে তেমন চোট লাগেনি। এই পথটা ঈশিতা একাও আসতে পারত। কিন্তু একজন সঙ্গে থাকায় অদরকারি নির্ভরতার মধ্যে অদ্ভূদ শিহরণ। তারপর হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে “উইশ ইউ হ্যাপি জার্নি” বলে চলে গেল।
নিজের চোখেই দেখে গেল, চোট পেয়ে কতটা অপারগ অবস্থা। হস্টেলের উপস্থিত সহআবাসিকাদের একজন ঘটনা শুনে জানতে চাইল, “কাল কী করে দিল্লী রওনা হবি? ওকেই বল না স্টেশনে পৌঁছে দিতে। বলিস তো আমিও সঙ্গে যেতে পারি। কিন্তু তোর বয়ফ্রেন্ড থাকতে আমার বা আমাদের পারাটা কি উচিৎ হবে?”
সায়ন্তন কমনরুম থেকে “সাবধানে যেও” বলে বেরিয়ে গেল। একবারও জানতে চাইল না, কাল কখন হস্টেল থেকে বেরোবে বা হাতে ফ্র্যাকচার হয়ে থাকলে কী করবে। ঈশিতা নিজের কামরায় গিয়ে টেবিলে ব্যাগ রাখতে রাখতে বুঝে পেল না আজকের এই ছুটে আসাটার জন্য তার আনন্দিত হওয়া উচিৎ না আগামীকাল দেখা করতে না চাওয়ার জন্য হতাশ।
শেষ পর্যন্ত কস্তুরীদিকে সঙ্গে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে হাওড়া স্টেশন। কস্তুরীদির সঙ্গে চাওয়া-পাওয়া, আশা-প্রত্যাশা, দেনা-পাওনার অত জটিল আবর্ত নেই - ‘থ্যান্ক্স্’ জানালে যে “মারব থাপ্পড়। পৌঁছে ফোন করিস।যা কাণ্ড বাধালি,চিন্তায় থাকব” বলে গালে হাত বুলিয়ে ভিড়ে মিশে যেতে পারে। ঐ ছেলেটার নামও জানতে চায়নি, মুখটাও মনে নেই, যে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের বিপদ দেখে নিজের বিপদ অগ্রাহ্য করে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ মেরেছিল। জনস্রোতে তখনও একটা স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর, অহঙ্কারীর মুখই খুঁজে চলা। কে জানে যদি শেষ মুহূর্তে চমক দেবার ইচ্ছা জাগে?