বদ্যিনাথ ধামে কত-শত পুণ্যার্থী। পূজোর সামগ্রী কেনার সারি সারি দোকান। পাণ্ডাদের হাঁকাহাঁকি। যে দোকান থেকে পূজোর ডালা কেনা হবে সেখানে জুতো পাহারা ফ্রী। বেশির ভাগ দর্শনার্থী বা পূজার্থীরা সেইসব দোকানে ভিড় করে ফুল, নৈবিদ্য, পাণ্ডা সব একসাথে পেয়ে যায়। এর মধ্যে যদি একটা বাচ্চা মেয়ে হাতে ধূপকাঠি নিয়ে ঘুরঘুর করে তো তাকে চোখে পড়ার তো কথা নয়, পড়েও না। “হটো, হটো” “সর সর” বলে তকে ঠেলে এগিয়ে যায় সবাই। সকাল থেকে সন্ধ্যের মধ্যে যদি একটাও পাঁচ টাকা দামের ধূপের প্যাকেট বিক্রি করতে পারে তো বর্তে যায় সোনি। কালে কস্মিনে দু একটি দয়ালু ব্যাক্তির সাক্ষাত একই দিনে ঘটে। আবার বহু দিন এমনও যায়, একটাও বিকোয় না। সেদিন দিনের ক্লান্তি আর হতাশায় সহানুভূতি হিসাবে বাবার কাছে বেদম মার জোটে।
একেই ছেঁড়া জামা, খালি পা। বছরভর নাক সর্দিতে ভড়ভড় করছে। তার ওপর কাঁদতে হলে সর্দি বেড়ে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। গলায় তার সর্বক্ষণ জ্বালা; কাঁচা সর্দি লাগলে নাকও জ্বলে। গলার মধ্যে সবসময় তলোয়ারবাজি চলছে। ঢোক গিলতে গেলে তো দশটা শূল যেন একসাথে ফোটে। কাঁদতে ভালো লাগে না সোনির। তবু তাকে কাঁদতে হয়। আরও বেশি বেশি কষ্ট পাবার জন্য তাকে কাঁদতে হয়। কষ্ট লাঘবের জন্যও কাঁদতে হয়। আবার কাঁদলেও কষ্ট পেতে হয়।
কেউ ভোলায় না। মা নেই সোনির। বাবার একসময় ফুল, নৈবেদ্যর দোকান ছিল। এখন নেই। এখন কোথা থেকে কী রোজগার করে আনে সেই জানে। আকণ্ঠ নেশা করে এসে মেয়ের কাছে বিক্রিবাটার খবর চায়। রিপোর্ট পছন্দসই না হলে, কচি হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার মতো টাকা না পেলে, পিটিয়ে হাতের সুখ তো আছেই ।
মাঝে মাঝে ফুলের মালাও রাখে সোনি। মালা বা ধূপ বিক্রি হোক না হোক রমেশ ভাইয়ার দোকানে পাঁউরুটির শেষ ছাল-ছাল কয়েকটা টুকরো, এক-আধটা ভাঙা গজা, কখনও সখনও সঙ্গে একটু চা জুটে যায় বেলার দিকে। সাত সকালে কোনও কোনও দিন সামান্য ছাতুজল খেয়ে বেরোতে পারে মেয়েটা বাবাকে লুকিয়ে। তারপর বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ পাউঁরুটির ছাল। কপাল ভালো থাকলে কচুরি তরকারি। ফোকটে পাওয়া। রমেশ ভাইয়ার মা দোকানে থাকলে ডেকে দেয়; নয়ত চাইতে হয়, অনেকক্ষণ অনুনয় করে। এটাই তার সকালের নাস্তা তথা দুপুরের খাবার। গলায় কষ্টর জন্য বার বার গরম চা খেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু একবারই জোটে না রোজ, দুবার চাইলে রমেশ বা তার বাবা খেদিয়ে দেবে না? মাঝে মাঝে নিজের বিক্রিবাটা ভুলে গরম জিলেবির দিকে লোলুপ নয়নে তাকিয়ে থাকে। রমেশের মা থাকলে ভাঙা ভাঙা জিলিপির খান কতক টুকরো সরিয়ে রেখে লুকিয়ে সোনিকে দেয় কোনও কোনও দিন। সোনিদের পিত্তি পড়ে না। ওদের পৌষ্টিকতন্ত্র এটুকু খেয়েই টিকে থাকতে অভ্যেস করে নিয়েছে। তাই সম্বল করে ওরা লড়ে যায়।
ফুলের মালা রাখার ঝুঁকি আছে। না বিকোলে নষ্ট। অথচ তাকে তো দাম দিতেই হবে। কাল্লু আর তার বড় ভাই ধারে মালা দিতে চায় না। দেবেই বা কেন? তাদেরকেও ধান্দা অর্থাৎ ব্যবসা করে খেতে হয়, পরিবার পালতে হয়। তাই তাদের কাছে আজকাল ঝড়তি পড়তি ফুলের মালা চেয়ে নেয়। সেগুলোই হাতে ঝুলিয়ে ঘোরে সোনি। যদি একটাকা দুটাকাতেও বিকোয়। ঐ বাতিল মালাই বিক্রি হয়েছে খবর পেলে পয়সা চায় কালুরা। যে দাম পেয়েছে বলে, তা বিশ্বাস করতে চায় না। দর কষাকষি করে বিক্রির বখ্রা দেওয়ার পর মনে হয় নিজের থেকেই চলে গেল; কারণ ঐ ফুলের মালা খদ্দেরকে গছাতে যে পরিশ্রমটা হয় তার দাম ধরতে গেলে হিসেব মিলবে না, মালার দামের চেয়ে বেশি পড়ে যাবে। তাই মালার চেয়ে ধূপই নিরাপদ। অন্তত বাসি হওয়ার ভয় থাকে না। তবে অনেক পুরোনো মালের গন্ধ চলে যায়। অবশ্য পুণ্যার্থীরা তাড়াহুড়োয় প্যাকেট কেনে, গন্ধ যাচাই করে না। মন্দিরের বিগ্রহর সেই নিয়ে অনুযোগ নেই। কিন্তু বড় দোকানগুলোই যেখানে খদ্দের জোটাতে গলা ফাটিয়ে অস্থির হয়ে যায়, গলায় বারোমাসি টনসিল ফ্যারিংস্-এর কষ্ট নিয়ে সোনি আর কতটা কী করতে পারে? সকাল দিককার খাওয়াটা বিনে পয়সায় জুটিয়ে নেওয়াটাও কম পাওয়া নয়। বিক্রি হল তো খুব ভালো, না হলেও বাড়ির বাইরেটাই ভালো সোনির। সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ঢোকার সময় বুক ঢিপ্ ঢিপ্ করে সোনির। বাবা কী মূর্তি ধারণ করে কে জানে!
“সোনি, কিধর গয়া বিটিয়া?”
বাবা ডাকছে? ঠিক শুনছে? বাবা এই গলায় কথা বলতে পারে!
“ক্যয়া পাপা”। ‘পাপা’ ডাকে গলাটা আদুরে লাগে। ইংরিজি তো দূর হিন্দীতেও অক্ষর-পরিচয় হয় না এমন বিহারী ছেলেমেয়েরাও মা বাবাকে “মাম্মি, পাপা” বলতে শেখে।
“কালসে তেরী মা হামারে সাথ রহেগী”।
মা! সে তো কোন কালে শম্শানে ছাই হয়ে গেছে!
“মা?”
“হাঁ, তেরি মা, মেরি বিবি। তু দিনভর বাহার ঘুমতী ফিরতী রহতী। ঘর-গিরস্তী কৌন সাম্হালেগী? মাকে বাত মাননা, নেহী তো...”। ডান হাতটা তুলে উল্টো ঝাপড়ের ভঙ্গী করল জয়নাল। মম্মি নয়, সৌতেলী মা বলে কথা!
বেটি দেখল তার বাপ নিজস্ব মেজাজে ফিরছে। নানীর কাছ থেকে প্রতিদিন নিজের জন্য তিনখানা রুটি নিয়ে আসে সোনি রাতে খাবে বলে। যদি বাবা একদম বেহুঁশ থাকে তো তিনটের মধ্যে অন্তত দুটো সে খেতে পায়। বেহোঁশ বাবাকে পেঁয়াজ, নুন লঙ্কাসহ একটা কম দিলেও চলে যায়। কিন্তু পাপা যদি একটু হুঁশে থাকে তাহলে একটা রুটিও নিজের জন্য রাখা মুশকিল হয়। বাবাকে মিথ্যে বলতে হয়,“নানী দোগো রোটী দীই হেয়”।
জামাইয়ের হাতে বেধড়ক প্রহৃত হয়ে মেয়ে মারা যাবার পর লছ্মী অনেক কান্নাকাটি করে জামাইকে শাপশাপান্ত করে। এমনকি একে ওকে ধরে তার শাস্তির বন্দোবস্তোও করতে চেয়েছিল। পাঁচ বছরের কচি নাতনিকে নিজের কাছে রাখতেও চেয়েছিল। নানাজী জীবিত, নানীর জোর ছিল। তাদের কাছেও না হয় টুকটাক কাজ করত। কিন্তু খেতে তো পেত। বাপের কাছে থাকলে তো শুকিয়ে মরবে।
কিন্তু জয়নাল তখন স্ত্রীকে মেরে কন্যার প্রতি দারুণ স্নেহশীল হয়ে পড়েছিল। তাকে ছাড়ল না। তার অযত্নে লোকসানে যাওয়া দোকান ন’কড়ায় ছ’কড়ায় বেচে দিল। তাই দিয়ে মাসখানেক খানাপিনা করল। তারপর পাঁচ বছরের মেয়ের হাতে আগরবাত্তির থলি তুলে দিয়ে হুকুম করল,“ মন্দিরমে বেচকে আ”। সেই থেকে চলছে সোনির ব্যবসা, সকাল কাম দুপুরে প্রতিবেশী দোকানদারের দয়ায় সামান্য খোরাক আর নানীর কল্যাণে রাতে তরকারি ছাড়া নুন মিরচা দিয়ে রুটি নিয়ে ছল চাতুরি। যদি রুটির সঙ্গে আচার জোটে তাহলে তো কথাই নেই। নতুন মা এলে কি রোজ বাড়িতে রুটি হবে? দিনের বেলা ভাতও কি ফুটবে?
এ বছর ঠান্ডা পড়েছে তাড়াতাড়ি। পূজোর পর বা দশেরার পরও বেশ গরম ছিল। হঠাৎ নভেম্বরের শেষ থেকে তুখোড় ঠান্ডা। সোনির গলায় এখন লাভাস্রোত। হেঁচে হেঁচে আর নাকের জ্বালায় মাথার চুল ছেঁড়ার যোগাড়। কথা বলতে গেলে কফে গলা বুঁজে আসে। ঢোক গিলতে গেলে গলা আর নাকের রাস্তা বেয়ে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে ওঠে। গায়ে মেগে যেচে পাওয়া একটা ছেঁড়া সোয়েটার। ময়লা। গোটা শীতভর কাচা হয় না। পরেও হয় কিনা সন্দেহ। ৩-৪ ডিগ্রী তাপমাত্রাতেও মাথায় টুপি নেই, মাফলার নেই, রুমাল নেই। একটা পাতলা ওড়না দিয়ে কাজ চালাতে হয়। পায়ে মোজা তো দূর, একটা ছেঁড়া কেড্সে পা ঢোকাতে পারলেও মনে হয় লটারি পেয়েছে। এই নিয়েই সকালের হাড় হিম করা ঠান্ডাতে বৈদ্যনাথজীর মন্দিরের সামনে গিয়ে ধূপকাঠি আর কখনও বা সাথে ফুলের মালা নিয়ে পূজা-দর্শনার্থীদের অনুনয়। অনেক সময় শ্লেষ্মা ও গলার কষ্টে কথা ফোটে না, ইশারায় বলতে হয়। কেউ কেউ দয়া করে কেনে।
আজ সোনি বাড়ি ফিরল জ্বর নিয়ে। সৎমা বলল,“বুখার মে খাতে নহী । পানি পী কে সো জা।”
সোনি কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। তার একটু গরম দুধ দরকার ছিল। আজকাল মাঝেমধ্যে ঐ তরলটার আমদানি হতে দেখে ঘরে। নানীর কাছে কবে শেষ দুধ পান করেছে খেয়াল নেই। সে শুয়ে পড়ল।
সৎমা ঠিকাদারের কাছে কামিনের কাজ করে যা যৎসামান্য রোজগার করে, তা শত অশান্তিতেও স্বামীকে জানতে দেয় না। তার বদলে কৌটোয় মুড়ি থাকে, ছাতু মজুত থাকে, রোজ সকালে ভাত আর রাতে রুটি হয়। মাঝে মাঝে দুধও আসে। বাবাকেই খেতে দেখেছে। সৎমা দুধ খায় কিনা সোনি জানে না। বাচ্চা মেয়েটার জুটবে না এটুকু স্থির। কোনও কোনও দিন ছাতুর পুর ভরে নতুন মা লিট্টিও বানায়, যেমন আজ বানিয়েছে।
আজকাল নানীর কাছ থেকে রুটি আমদানি বন্ধ হয়েছে। সৌতেলী মা-ই খেতে দেয়। বাচ্চা মেয়েটাকে বাপ মার বকুনি দিলে আটকায়। তবে সৎ মেয়েকে ঠিক নিজের বলে কাছে টানতেও পারে না যেন। নিজের রোজগারে তাকে খেতে দিচ্ছে বলে কথাও সোনায়। কাজও করায়। এত সর্দিকাশি নিয়েও সোনি কাপড় কাচে, বাসন মাজে টুকটাক। ভারি চাদর টাদর অবশ্য সোনিকে দিয়ে কাচায় না। নতুন মা আসার আগে বাড়িতে এত কাচাকাচির বালাইও ছিল না।
ওদিকে সোনির মামী জয়নালের দ্বিতীয় বিয়ের পর সোনির দায়িত্ব ওদের নয় বলে শ্বাশুড়ির সাথে বচসা করে রাতের তিনখানা শুকনো রুটির বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। শ্বশুর অথর্ব। শাশুড়িরও গায়ের জোর কমে এসেছে। সেই সাথে মুখের জোর দাপট সবই। বেটি তো পরায়া ধন। তাও আবার মৃত। তার মেয়ের কথা ভেবে বদ জামাইয়ের সংসারে আর কতকাল সাহায্য করবে? তবে সোনি মন্দির থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যে বেলা নানীর বাড়ি গেলে নাস্তা পানি পায়। কিন্তু সেটা ঘন ঘন হয়ে গেলে আবার বাড়িতে রাতের খাদ্য বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছে। তাই নানীর বাড়ি আর বিশেষ যায় না; গেলেও লুকিয়ে চুরিয়ে যেতে হয়। জানাজানি হলেই রাতে তার খাওয়ার দরকার নেই বলে ধরে নেওয়া হবে।
আজ সোনির ধুম জ্বর। মাথা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে বারবার উঠে কলতলায় নাক ঝেড়ে আসতে হচ্ছে, কফ ফেলতে হচ্ছে কাশতে কাশতে। হাঁটার ক্ষমতা নেই। নাক গলা আর টাকরায় অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। সে আগুনকে যুঝতে মনে হচ্ছে আগুন আগুন কিছু খায় বা পান করে। অনেক সময় দেখেছে গরম কিছু খেলে সাময়িকভাবে গলার কষ্ট কম মনে হয়। মুখ খালি থাকলে গলায় প্রশ্বাসের বাতাস আঘাত করলেই আবার হুহু করে জ্বলন।
আজ সৎমা লিট্টি বানিয়েছে। সঙ্গে ঝাল চাটনি। একটু দুধও যোগাড় হয়েছে। পাপার আজ নেশার ঘোর কম। গবাগব খেয়ে চলেছে। সঙ্গে চলেছে দ্বিতীয়পক্ষকে অবিশ্রান্ত গালাগাল।
আর পারল না সোনি। ঘরের ভেতর থেকে টলতে টলতে দালান বা বারান্দা বা খাওয়ার জায়গা যাই বলা হোক সেখানে বেরিয়ে এল। “ভুখ লগী হেয় মা। এক-দো লিট্টি অউর থোড়া দূধ দো না।”
মায়ের তখন নিজেরই কম পড়েছে।“বোলা না, বুখারমে খাতে নহী। এক রাত নহী খানেসে তবিয়ত সুধর জায়েগী।”
“ভুখসে পেটমে দর্দ হো রহা। গলেমে জলন। থোড়া দূধ তো দো”।
সম্পূর্ণ বেহুঁশ না হওয়া বাপ গর্জে উঠল,“তু দূধ পিয়েগী তো মেয় কেয়া পিয়ুঁগা?”
“তুম তো শরাব পিতে হো, দুধ কিঁউ?” কষ্টে মরিয়া হয়ে বলে ফেলল সোনি।
“ জবান খিঁচ লুঙ্গা সালী। কিতনে আগরবাত্তি বিকা আজ?”
“এক প্যাকিট”।
“পয়সা কিঁউ নই দী?”
“কাল দে দুঙ্গী। আজ তবিয়ত বহুত খরাব হেয় পাপা।”
“খরাব হেয় তো যাকে সো জা। দিমাক মৎ খা।”
সৎমা পরের লিট্টিখানা স্বামীর পাতে দেওয়ার বদলে মেয়েকে শুধল,“ইয়ে তু খায়েগী? দুধ নহি মিলেগী”।
যা পাওয়া যায়। হাত বাড়াল সোনি। হাতে থালা ছুঁড়ে বৌয়ের হাত থেকে সেটা ফেলে দিতে গেল মেয়ের বাপ। মা কোনও মতে সেটা লুফে নিল গোপনে। জয়নাল চিৎকার করল,“ হারামখোর, কামচোর। পয়সা হড়প গয়া। উপরসে খানা মাঙতা? যাকে অপনি নানীসে পুছ। অউর তু কিঁউ সৌতেলী বেটিকী বাতোমে আ রহী হেয়? সুন সোনি, কাল কমসে কম পাঁচ প্যাকিট আগরবাত্তিকা পয়সা চাহিয়ে। নহি তো পড়া রহ্ বাহার”।
বাপ পুরো নেশায় থাকলে একটু উদোমাদা হয়ে যায়। এই আধা নেশটাই বেশি সাংঘাতিক। দ্বিতীয়পক্ষকে ঘরে ঢুকিয়ে সত্যিই দরজা এঁটে দিল সে। সৎ মা মেয়ে কারোরই খাওয়া হল না। আট বছরের সোনি পড়ে রইল বাইরের দাওয়ায়, যেখানে বসে খাওয়া হচ্ছিল। মাথার ওপর টিনের ছাউনি। ঘেরা দেওয়াল নেই। এক কোনের উনুন নিভু নিভু। একটুক্ষণ তাপ ছড়িয়ে সেটাও নিস্তেজ হয়ে গেল। সামনে খোলা উঠোন পেরিয়ে হুহু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। অন্ধকারে ভূত জিনরাও থাকতে পারে। ওদিকের বড়লোকদের পাড়ায় ক্রিস্টমাসের আগের দিনের চূড়ান্ত সাজসজ্জা চলছে। এখান থেকেও তার আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ঠান্ডায় সব অসাড় হয়ে গেছে সোনির। গায়ে ছেঁড়া সোয়েটার আর মাথায় পাতলা ওড়না ছাড়া আবরণ আর কিছু নেই। ভাগ্যিস পাপা দরজা বন্ধ করার আগে ও ওটুকু পরেছিল। নিজেদের দাওয়ায় আড়াল নেই। পাশে হরকিষনদের বারান্দাটা দেওয়াল ঘেরা, দরজা নেই যদিও। ভাগ্যিস নেই। ওখানে কতগুলো নেড়ি কুত্তা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। রোজই শোয়। ওদের চুলোটাও বড়। এখনও পুরো ঠান্ডা হয়নি হয়ত। সোনি নিজের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে হরকিষণদের বারান্দায় উঠল।
হরকিষণরাও মাঝে মাঝে দয়া পরবশ হয়ে সোনির কাছে ধূপ কেনে। কিন্তু এখন সময় নয়। সোনির হাতেও ধূপের প্যাকেট নেই। সে রাতটুকুর জন্য আশ্রয় চায়। কাল সকালে মা দরজা খুললেই নিজের পসার হাতে নিয়ে আবার বেরোবে ও। বেরোনোর আগে ছাতু মাখার সাথে একটু লাল চাও চাইবে সৎ মায়ের কাছে। গলায় কষ্ট বর্ননাতীত। সেই সাথে জ্বরের আনচানানি। পেট শুধু চুঁই-চুঁই করছে না, রীতিমতো বায়ু জন্মে ব্যথা করছে। বমি পাচ্ছে।
হরকিষণদের উষ্ণ দাওয়ায় উঠেই মনটা ভরে গেল সোনির। ভেতরের সব দেখা যায় এমন কাচের দরজা। দেওয়ালটাও স্বচ্ছ। ভেতরে পরিপাটি করে সাজানো টেবিল চেয়ার। টেবিলে আস্ত মুরগা তন্দুর করা। পাশে পেঁয়াজ, মিরচা, দাল তড়কা, সিমাই, কেক সব থরে থরে সাজানো। ঘরের মধ্যে এক জায়গায় আগুন জ্বালানো। পাশে বিছানা পাতা, সেখানে গরম কম্বল। ঘরে কেউ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে এক্ষুণি কেউ এসে বসবে। সোনি যদি একটু ভিক্ষা চায়, পাবে না খেতে? আর একটু গরমে বসতে? ঐ দরজাটা ঠেলে তো মনে হচ্ছে যে কেউ ঢুকতে পারে।
সোনি হাত দিয়ে ঠেলল। খুলল না। টানল। খুলল না। আওয়াজ হল ক্যাঁচ ক্যাঁচ। দেখল ঘরের ভেতরকার সব দৃশ্য মিলিয়ে গিয়ে কাঠের মামুলি দরজা। এই দরজাই তো সে রোজ দেখে। দেওয়ালও ইঁট-সিমেন্টের। হ্যাঁ, এমনটাই তো সে রোজ দেখে।
মম্মি, তুমি বেঁচে থাকলে আমি এই অসুখের সময় তোমার কাছে শুয়ে থাকতাম। তুমি আমায় ভুখা রেখে দুয়োর বন্ধ করতে দিতে না। নানীর কাছেও যেতে পারি না, মম্মি। দেওয়ালিতে নতুন জামা পাইনা। সারা বছর সর্দি-কাশি, নাকে গলায় এত তকলিফ। পাপা ডাগ্ডার দেখায় না। মম্মি আমার এই বুখার, পেটে খিদে। বুকেও ব্যথা করছে। নতুন মা একটা লিট্টি দিতে চেয়েছিল, পাপা সেটাও কেড়ে নিল মা। একটু দুধ চাইলাম পেলাম না। কাল আবার পাঁচ প্যাকিট আগরবাত্তি বেচে টাকা আনতে বলেছে। আমার তো ওঠারই শক্তি নেই। কথাও বলতে পারছি না। উ হু হু হু...ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। মম্মি, আজ নাকি কাল ক্রিসমাস। আমার বয়সী বাচ্চারা সেজেগুজে আজ ট্রি সাজাচ্ছে। তাদের সান্তাক্লস কত তোফা দেবে। সবাই তো কিরেস্তান নয়, তবু তোফা পায়। সান্তা নাকি বাচ্চাদের ভালোবাসে। মম্মি আমি কি বাচ্চা নই? সান্তা শুধু আমির লোকের বাচ্চাদের উপহার দেয়? আমাকে তো একবারও দিতে পারে। একটা সুইটার, মাফলার – ব্যাস্ আর কিছু চাইনা। নানীর দেওয়া সুইটার ছিঁড়ে গেছে, ছোটও হয়ে গেছে। এই পাতলা ওড়নিতে কি ঠান্ডা কাটে? ঠান্ডাতে পায়ের আঙুলগুলো কখনও জ্বালা করে, কখনও অসাড় মনে হয়। এক জোড়া মোজা চাইলে দেবে না আমায় সান্তা? হর সাল তো চাই না শুধু একবার, একবার? চটিটাও ছেঁড়া। আর পরা যায় না। রমেশভাইয়ার মা কমলী চাচী তার পোতির পুরোন একজোড়া জুতো দিয়েছিল। আমার পা-ই ঢুকল না তাতে। সান্তাকে একজোড়া জুতো দিতে বলবে মম্মি? সান্তা রাগ করবে না তো? সব বার তো চাই না। শুধু এইবার! ধূপ বিক্রির সব টাকা পাপা নিয়ে নেয়। নিজের জন্য একটা রুমালও কিনতে পারি না। মম্মি, নানীকে বল না আমায় রাখতে। মামীকে মানাতে। আমি সব কাজ করে দেব। শুধু শীতে একটু জামা জুতো, দো টাইম খাবার। একটু ওষুধ! নানী, আমায় নিয়ে যাও....
অকস্মাৎ দেখতে পেল সোনি কোথাকার এক দরজা খুলে নানী বেরিয়ে এল। “কৌন আয়ী হেয় দেখ সোনি”।
“মম্মি!?”
“জা মাম্মিকে পাস জা। উসকে সাথ সান্তা ভি আয়া হেয়। তেরে লিয়ে রোটি, দাল, আচার, পিঁয়াজ অউর কেক ভী লায়া হেয়। অউর দূধ ভী। সাথমে নয়ী সালওয়ার সুট, লাল সুইটার, টোপি, মাফলার, মোজে ভি লায়া হেয়। এক জোড়া জুতা ভী। জা বচ্চি, সান্তাসে মাঙলে জো চাহিয়ে। অউর আপনি মম্মিকে পাস জা”।
“মম্মি,মম্মি !!”
“এ জয়নাল, কিত্থে গয়া বে? তনু লেড়কী হামারে ইঁহা দম তোড় দী। তনু ঘরমা মরনে দি জগহা ভি নাই মিলা কা?”
“কৈসে মিলব? সৌতেলী মা আওত নাই? ছোরী তো থী হি দুখিয়ারী। ভিখ্মাঙ্গা, দুসরোকী টুকরো পর পলনেবালী। বাপনে দুসরী শাদি কা কী, সৌতেলী মা নে লড়কীকো ঘর সে নিকাল বাহার কী !”
জয়নাল বুক চাপড়ে এমন কাঁদল, পাড়া প্রতিবেশী সহানুভূতিতে গলে গেল। হাজার হোক, বাপের প্রাণ। সৎ মা না এলে মেয়েটাকে এমন বেঘোরে মরতে হত না। সবই নিয়তি। কমলী চাচী খানিক পরে চোখের জল মুছতে মুছতে এসে নাতনির একখানা পুরোন সোয়েটার আর একজোড়া হাওয়াই চপ্পল এনে মৃতদেহের পাশে রাখল।
সৎ মা দূর থেকে চোখের জল আঁচলে ঢেকে একখানা কম্বল হাতে দাঁড়িয়ে রইল। গতরাতে তার স্বামী সদর দরজা বন্ধ করার ঘন্টাখানেক পর চুপি চুপি ঐ কম্বলখানা নিয়ে বাইরে এসে ডাক দিয়েছিল,“সোনি, লে কম্বল ওঢ়লে। এক লিট্টি ছুপাকে রখ্খী হুঁ। কিধর গয়ী? আ কে খালে, অউর কম্বল ওঢ়কে সো জা। কাল রাত কো ছুপকে সে দূধ ভী দুঙ্গী”।
কম্বলটা জয়নালের খুব প্রিয়। একটু তুলে তুলেই ব্যবহার করে। স্বামীর সামনে দিয়ে গিয়ে সৌতেলী মেয়ের মৃতদেহের ওপর সেটা রাখতেও সৌতেলী মার সাহস হচ্ছে না।
N.B. Totally Different Story but initially inspired by Children version of “Little Match Girl” (English)
দ্রষ্টব্য: হিন্দী সংলাপে হিন্দী বানানরীতি আনুযায়ী অনেক সংলাপে ঈ-কার বা দীর্ঘ উ-কার ব্যবহৃত হয়েছে বাংলায় প্রচলিত ই-কারের বা উ-কারের পরিবর্তে। যেমন ‘দুধ’ উচ্চারণ অনুযায়ী হিন্দীতে ‘দূধ’। তাছাড়া “যা” ক্রিয়াটি হিন্দীতে “জা” লেখা হয়। ‘জো’-র ক্ষেত্রেও তাই। অন্যত্র আধুনিক বাংলা বানানরীতিই অনুসৃত হয়েছে। এরপরেও আলোচনার অবকাশ থাকতে পারে। আশাকরি বানানের কারণে রসচ্যূতি ঘটবে না।]