২০১৬ সাল থেকে Citizenship Act of 1955 বা নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর সংশোধনী হিসাবে Citizenship Amendment Bill (CAB), 2016 ভারতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু বিরোধিতার জেরে সংসদীয় কমিটির কাছে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও সামান্য কিছু পরিবর্তনের পর ইউনিয়ান ক্যাবিনেট ২০১৯-এর ৪ ডিসেম্বর সপ্তদশ লোকসভায় পুনরায় উত্থাপন করে এবং ৯ ডিসেম্বর Citizenship Act of 1955 বা নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর সংশোধনী হিসাবে Citizenship Amendment Bill (CAB)’ 2019 লোকসভায় পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ।[1][2] লোকসভায় ৭ ঘণ্টা ধরে চলা প্রবল বিতর্কের পর বিলটি ৩১১-৮২ ভোটে লোকসভার বেড়া টপকে যায়।
কিন্তু তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকারী বিলটি যেভাবে লোকসভার গণ্ডী টপকালেও রাজ্যসভায় বারবার আটকে যাচ্ছিল, একই আশঙ্কা ছিল এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯-এর ক্ষেত্রেও। দেশময় তীব্র বিরোধিতার মধ্যেও পরিশেষে ২০১৯-এর ১১ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত ভোটাভুটিতে ১২৫-৯২ ভোটে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯ (CAB 2019) রাজ্যসভাতেও শাসকদল বিজেপি-র সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তার প্রধান সহযোগী দল শিবসেনার সহযোগিতা ছাড়াই উত্তীর্ণ হয়।[6][7][8] রাজনাথ কোবিন্দ সাক্ষর করার পর তা Citizenship Amendment Law (CAA), 2019 বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯ হিসাবে সংবিধানের অঙ্গ রূপে স্বীকৃতি লাভ করে।[9] কিন্তু এটিকে ভারতের শরণার্থী ও উদ্বাস্তু সমস্যার এক বহু প্রতীক্ষিত সমাধান সূত্র রূপে প্রণয়ন করার চেষ্টা হলেও দেশময় শুরু হল রাজনৈতিক বিরোধিতা, উত্তর-পূর্ব ভারত ফেটে পড়ল প্রাদেশিক বিক্ষোভে আর সারা দেশ জ্বলে উঠল সাম্প্রদিক হিংসায় যার জেরে দিল্লীর শাহীনবাগের অবরোধকে কেন্দ্র করে ঘটে গেল মর্মন্তুদ দাঙ্গা।
উপযুক্ত অনুবিধি (Rules) রচনার অভাবে এই আইনটি কার্যকর করা না গেলেও এই পরিস্থিতিতে ভারতের নাগরিকত্ব এবং নাগরিত্ব আইন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। দরকার হয়ে পড়েছে নাগরিকত্ব সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণারও।
প্রথমে কতগুলি মৌলিক প্রশ্নোত্তরে নাগরিকত্ব কী এই পর্বটি বুঝে নেওয়া যাক।
নাগরিকত্ব নির্ধারণের জন্য দুটি পরিচিত নীতি রয়েছে। একটিতে ব্যক্তির নাগরিকত্ব স্বীকৃতি পায় জন্মস্থানের নিরীখে, অন্যটিতে রক্তসম্পর্কের চিহ্ন অনুযায়ী। ১৯২৮ সালে মতিলাল ‘নেহরু কমিটি’র সময় থেকে ভারতীয় নেতৃত্ব জন্মস্থানকেই নাগরিকত্ব নির্ধারণের নীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, অন্য ধারাটি পরিত্যক্ত হয়েছে ভারতে ‘শখ-হুন-মোগল-পাঠান এক দেহে লীন’ হওয়ায় এর উপমহাদেশীয় চরিত্রের জন্য। ভারতের সংবিধানে ‘নাগরিকত্ব’-এর কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই; কিন্তু দ্বিতীয় খণ্ডর (Part – II) ৫ থেকে ১১ নং অনুচ্ছেদ বা ধারায় (Article) কারা নাগরিকত্বের আওতায় পড়বেন, তার কিছু নির্দেশিকা আছে। সংবিধানের অন্য সংস্থানগুলি ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকর হলেও এই ধারাগুলি লাগু হয়ে যায় সংবিধান গ্রহণের লগ্ন থেকেই, অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে।
এরপর ১৯৫৫ সালে সংসদে প্রণীত হয় নাগরিকত্ব আইন। এই এক আইন যা ১৯৫৫ সালে পাস হওয়ার পর পাঁচবার সংশোধিত হয়েছে – ১৯৮৬, ২০০৩, ২০০৬, ২০১৫ ও ২০১৯ সালে। মূল আইনআনুসারে নাগরিকত্ব লাভের উপায় ও তার গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীগুলোর দিকে একবার তাকানো যাক।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের বিষয়টি আছে নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ৩নং ধারায়। যে কোনও ব্যক্তি ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ এবং ১ জুলাই ১৯৮৭ তারিখের মধ্যে ভারতে জন্মগ্রহণ করলে তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হবেন [ধারা ৩(১)(ক)]। ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পূর্বে ভারতে জন্ম হলে এবং তাঁর মা-বাবার যেকোনো একজন ভারতীয় হলে তিনি ভারতীয় হবেন [ধারা ৩(১)(খ)]। ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ বা তার পর ভারতে জন্ম হলে তিনি তখনই ভারতীয় নাগরিক হবেন যদি তাঁর মা-বাবা উভয়ই ভারতীয় নাগরিক হন অথবা উভয়ের একজন ভারতীয় ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হন [ধারা ৩(১)(গ)]।
১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনের ৩নং ধারায় বর্ণিত জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিকত্বের যে ব্যাপকতা ছিল, কংগ্রেস আমলে ১৯৮৬ সালের সংশোধনীতে অনেক সংকুচিত হয়ে যায়। এই সংশোধনীতেই শর্ত আরোপ করে বলা হয়, যাঁরা ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর থেকে ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বরের আগে জন্মেছেন তাঁরা ভারতে জন্মালেও, জন্মকালীন সময়ে তাঁদের বাবা বা মা-কেও ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। (Act No. 51 of 1986, w.e.f. 01-07-1987)। এই সংশোধনীটি গৃহীত হয় আসামে লাগাতার অশান্তির জেরে ১৯৮৬-তে রাজীব গান্ধী ‘আসু’-র সঙ্গে আসাম চুক্তি সাক্ষর করার পর। এর ফলে ‘jus soli’ বা কোনও ভূমিতে জন্মানোর দরুণ ‘জন্মগত অধিকার’ যা সংবিধান ও মূল ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনে ছিল, তা কার্যত নস্যাৎ হয়ে যায়।
২০০৩ নাগাদ এনডিএ সরকার বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের কথা মাথায় রেখে এই আইনকে অবশ্য আরও কঠোর করে তোলে। এখনকার আইনে যাঁরা ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বা তার পর জন্মেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির জন্য হয় তাঁদের বাবা-মা উভয়কেই ভারতের নাগরিক হতে হবে অথবা যে কোনও একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে ও অন্যজন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হওয়া চলবে না (Act No. 4 of 2004, w.e.f. 03-12-2004)। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা নাগরিকত্বের জন্য কোনও পদ্ধতিতেই আবেদন করতে পারবে না। Post truth যুগে একটি মিথ্যাচার করা হয়, যে মূল নাগরিকত্ব আইনে নাকি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর বিষয়টি ছিল না। কিন্তু ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইনেই “illegal migrant” সংজ্ঞায়িত করা আছে এইভাবে: যারা (১) পাসপোর্ট-ভিসা বা অন্য অনুমতিপত্র ছাড়া অন্য দেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে অথবা (২) বৈধভাবে প্রবেশ করেছেন কিন্তু বৈধতার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ভারতে থেকে গেছে।[The Citizenship Act, 1955, 30th December, 2(b) page-3] নেহেরুর আমলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এইসব অবৈধ অভিবাসীদের হয় তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে নতুবা জেলে রাখা হবে। তবে বলা বাহুল্য এই কঠোর সংশোধনীর ফলে কার্যত জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের পরিসর আরও কমে যায়। প্রাধান্য পায় রক্তসম্পর্কের মাধ্যমে নাগরিকত্বের নীতি।
পুনরায় কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ সরকারের সময় ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে Bombay High Court একটি রায় দিয়ে বলে জন্মের সংশাপত্র, পাসপোর্ট এমনকি আধার কার্ড এককভাবে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়, যদি না মা-বাবা ভারতীয় নাগরিক হয়ে থাকে। আবার ২০১২-তে Bombay High Court রায় দিয়েছিল, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে জন্মানো ব্যক্তি ভারতে প্রবেশ করলে তাকেও নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত, যেহেতু ভারত পুরো কাশ্মীরকেই নিজের অন্তর্ভুক্ত মনে করে। এই বিচিত্র স্ববিরোধ কিন্তু কংগ্রেস শাসনেই তৈরি হয়েছিল; কিন্তু তার দায়ভার আজ বিজেপি সরকারকে নিতে হচ্ছে।
উত্তরাধিকারসূত্রে বা বংশানুক্রমে নাগরিকত্ব (Citizen by Decent):
নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র ৪ নং ধারায় বর্ণিত আছে ভারতের বাইরে জন্মানো ব্যক্তির বংশানুক্রমিক নাগরিকত্ব। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১০ ডিসেম্বের ১৯৯২-এর মধ্যে ভারতের বাইরে জন্মানো কেউ ভারতীয় হবেন যদি জন্মের সময় তার পিতা ভারতীয় নাগরিক হন এবং ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২ থেকে ভারতের বাইরে জন্মানো কেউ ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে যদি জন্মের সময় তার মা বা বাবার কোনও একজন ভারতীয় নাগরিক হন। ৩রা ডিসেম্বর ২০০৪-এর পর বিদেশে জন্মানো মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে হলে জন্মের এক বছরের মধ্যে বা কেন্দ্র সরকারের বিশেষ অনুমতিক্রমে এক বছর পরে হলেও ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে আবেদন পঞ্জীকৃত হতে হবে। সেই সঙ্গে তার মা-বাবাকে অন্য দেশের পাসপোর্ট নেই, সেই মর্মে ঘোষণাপত্র দিতে হবে।[15]
এই ধারাও ২০০৩ সালে সামান্য সংশোধন করা হয়। ভারতের বাইরে জন্ম নেওয়া কারও মা-বাবার একজন ভারতীয় হলেই সে এখনও ভারতীয় নাগরিকত্বে দাবিদার থাকল। কিন্তু ২ ডিসেম্বর ২০০৪ এর পর ভারতে জন্ম নেওয়া সন্তানকে ভারতীয় নাগরিক হতে হলে হয় মা-বাবার একজন ভারতীয় নাগরিক ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হওয়া আবশ্যক [ধারা ৩(১)(গ)]। নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৩(১)(ক) এবং ৩(১)(খ) বাতিল করে শুধু ৩(১)(গ)-কে বলবৎ করার দাবিতে আবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে বিবেচনাধীন [Writ Petition (Civil) No. 311 of 2015]। অনেকের মতে উক্ত ধারায় [ধারা ৩(১)(গ)] জন্মসূত্রে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তির সৃষ্টি হতে পারে।
নিবন্ধীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব (Citizenship by Registration):
নাগরিকত্ব আইনের ৫ নং ধারা অনুযায়ী নথিভুক্তিকরণের মাধ্যমে বৈধভাবে নাগরিকত্ব লাভ করা যায় নিম্নলিখিত উপায়ে:
(১) 5(1)(a) ধারা অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিক নয় এমন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যদি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হয়ে থাকে, তাহলে ভারতে ৭ বছর থাকার পর নথিভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করতে পারবে। এর মধ্যে আবেদনের ঠিক আগে অন্তত ১২ মাস একটানা ভারতে থাকতে হবে।
(২) কেউ অবিভক্ত ভারতের বাইরে থাকলে যে কোনো সময় আবেদন করতে পারেন।
(৩) কোনও ব্যক্তি কোনও ভারতীয়কে বিয়ে করে ভারতে এসে ৭ বছর সাধারণ বৈধভাবে বসবাসের পরও আবেদন করতে পারেন।
(৪) ভারতীয় নাগরিকের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা বিদেশে জন্মালেও ভাতীয় নাগরিকত্ব লাভের অধিকারী।
(৬) বিদেশে থাকা পূর্ণবয়স্ক স্বাবলম্বী ব্যক্তির মা-বাবার কেউ পূর্বে স্বাধীন ভারতের নাগরিক হয়ে থাকলে এবং ঐ ব্যক্তি আবেদন করার এক বছর আগে থেকে ভারতে বসবাস করলে নাগরিক হিসাবে নথিভুক্তির জন্য আবেদন করতে পারেন।
(৭) পূর্ণবয়স্ক স্বাবলম্বী ব্যক্তি ৫ বছর যাবৎ overseas citizen of India কার্ড হোল্ডার হলে এবং শেষ ১২ মাস ভারতে থাকলে নিবন্ধীকরনের মাধ্যমে পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদন করতে পারে। ২০০৩-এর সংশোধনীর (Act No. 4 of 2004, w.e.f. 03-12-2004) আগে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হওয়ার শর্ত ছিলনা এবং উক্ত সময়সীমা ৭ বছরের পরিবর্তে ৫ বছর ছিল। উপরন্তু পাকিস্তান সহ কমনওয়েলথ দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে ৫ বছর বসবাসের শর্ত ছিল না। তখন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীসহ যে কেউ সহজেই নথিভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করতে পারতেন। এমনকি বিদেশী আইনে (Foreigners Act) অনুমতিপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের জন্য শাস্তি ভোগ করলেও নথিভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে আইনত কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু ২০০৩-এ আরোপিত এই শর্ত উদ্বাস্তুদেরও ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভে অসুবিধার সৃষ্টি করেছে, বলা বাহুল্য।
স্বাভাবিক-করণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব (Citizen by Naturalisation):
কোনও বিদেশী ভারতে ১২ বছর বসবাস করলে যার মধ্যে আবেদন করার ঠিক আগে অন্তত এক বছর ভারতে থেকে থাকলে এবং আবেদন করার পূর্ববর্তী ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারত বাস করে থাকলে এই পদ্ধতিতে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে। সঙ্গে ধারা ৬(১) দ্বারা কিছু শর্ত পালনীয়, যেমন কোনও অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার রেকর্ড থাকা চলবে না ইত্যাদি।
২০১৯-এ সংশোধনীর আগে এই ছিল মোটামুটি চেহারা। ১৯৮৭ ও ২০০৩-এর সংশোধনী দ্বারা ভারতে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব লাভে যে কাঠিন্য তৈরি হয়েছিল, তা দূর করার চেষ্টাতেই ২০১৯-এর নতুন নাগরিকত্ব আইন।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৯ (Citizenship Amendment Bill, 2019)
(১) এখানে শরণার্থীদের জন্য স্বাভাবিকরণের যে মেয়াদ ১২ ও ১১ বছর ছিল, তা থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৬ ও ৫ বছর করা হয়েছে।
(২) অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত আইন বহাল রাখলেও বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে উৎপীড়িত বা উৎপীড়িত হওয়ার আশঙ্কায় ("persecution or fear of persecution") আগত হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এমনকি খ্রিস্টান শরণার্থীদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে গণ্যই করা হবে না।
(৩) নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-র ৫ নং ধারা অনুযায়ী নিবন্ধীকরণ (Registration) ও ৬ নং ধারা অনুযায়ী স্বাভাবিক-করণ (Naturalisation) – এই দুই ভাবে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারে।
(৪) এ ধরনের অভিবাসীদের জন্য পাসপোর্ট আইন ও বিদেশী আইনেও ছাড় দেওয়া হয়েছে দুটি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে। শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত মামলা থাকলেও তা শিথিল হয়ে যাবে বিল কার্যকর হলে।
(৫) আসাম চুক্তি অনুযায়ী যেখানে ভারতে আসার সর্বশেষ তারিখ স্থির হয়েছিল ১৯৭১-এর ২৩ মার্চ, অর্থাৎ তার পরে কেউ যে কারণেই ভারতে আসুক, তাকে নাগরিকত্ব তো দূর আশ্রয়ও দেওয়া হবে না, সেখানে নতুন আইন ভারত আগমণের ভিত্তিবর্ষ বাড়িয়ে ২০১৪-র ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত করেছে।[17] এরপর কেউ এলে ভারত সরকার আইনত আর দায়িত্ব নিতে দায়বদ্ধ নয়। কিন্তু ১৯৭১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত যে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের উপযুক্ত নিয়মের মেনে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
(৬) উত্তর-পূর্ব ভারতের ষষ্ঠ তফশিল (Sixth Schedule) ভুক্ত জায়গাগুলি এই আইনের বাইরে রাখা হয়েছে।
এই বিলের সঙ্গে আমাদের দেশ নেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কতখানি সঙ্গতি আছে, বোঝার জন্য গান্ধীজী ও নেহেরুর দুটি উক্তি স্মরণ করা যাক।
“হিন্দু ও শিখ যাঁহারা ওখানে আছেন তাঁহারা যদি সেখানে থাকিতে না চাহেন, তাহা হইলে যেকোনও ভাবে ভারতে আসিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের প্রথম কর্বব্য হইবে তাঁহাদের জন্য জীবিকার সংস্থান করা ও জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলা।” [মহাত্মাগান্ধী রচনাবলী, খণ্ড-৮১, প্রচার বিভাগ, ভারত সরকার][18]
“ভারতে আগত যেসব উদ্বাস্তু পূর্ববঙ্গে প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছুক নন, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। পুনর্বাসনের সমস্যাটিকে জাতীয় সমস্যা গণ্য করতে হবে।” [পণ্ডিত নেহেরু ভাষণ সংকলন, ১৯৪৯-৫৩, ৫৪, প্রচার বিভাগ, ভারত সরকার]
শরণার্থী ও ধর্মীয় পীড়নের শিকার বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় ও নাগরিকত্ব দেওয়ার অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান কল্পেই ২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের চেষ্টা। কিন্তু সেই চেষ্টা নিয়ে দেশময় আগুন জ্বলে উঠল। তারপরেও আইনটি প্রত্যাহৃত হয়নি। অথচ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে উপযুক্ত বিধি রচিত না হওয়ায় আইন প্রণীত হয়েও বিকল হয়ে রইল।
তথ্যসূত্র: