কবিতা কোনটা, কেন কেউ কবি –
কাটছে না ধোঁয়াশা;
ছদ্মনামে লিখে তাই করি
স্বনামে প্রশংসা।
বলবে কি একে আত্মরতি
ঘৃণা উপহাস ভরে
ধারের বদলে ভারে কেটে যারা
কাব্যশাসন করে?
১৯৯৮ সাল। সদ্য বাণিজ্য প্রশাসনে স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরিসূত্রে ও ভালোতর চাকরির সন্ধানে কলকাতায়। গিয়েছিলাম এক কুলীন বাংলা পত্রিকার দপ্তরে বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতীম কবি ও গদ্যকারের কাছে কিছু কবিতা নিয়ে। অবশ্য কবিতার চেয়েও বেশি বুঁদ ছিলাম তাঁর গদ্যে। নারী চরিত্রগুলি যেন দর্পণের মতো আমাকে ধরে ফেলত, আর পুরুষ চরিত্ররা নতজানু হয়ে করে দিত অভিভূত। সংকোচবশত নিজের পরিচয় দিইনি। নিজেই নিজের বন্ধু সেজে দেখিয়েছিলাম নিজের কয়েকটি কবিতা। অবশ্য মানুষের মনস্তত্ত্ব যাঁর লেখার রসদ, তাঁর চোখে নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখতে পেরেছিলাম বলে মনে হয় না। যাইহোক, মতামত জানতে চাওয়ায় অত্যন্ত ব্যাজার মুখে একটায় উঁকি মেরে বললেন, “তোমার বন্ধুকে বোলো, যা খুশি লিখলেই কবিতা হয় না। কবিতা কাকে বলে আগে জানুক।” থতমত খেয়ে ফিরে আসার আগে যদি জানতে চাইতাম, “তাহলে আপনি বলে দিন, কবিতা কাকে বলে?” আমি নিশ্চিত, সদুত্তর পাওয়ার বদলে আর এক প্রস্থ মুখঝামটা জুটত।
উত্তরটা কোনও কবিরই জানা আছে বলে মনে হয় না, যদিও সবাই লেখেন। এক-এক জন রচয়িতা কবিতার এক-একটি রূপ নিজের মতো করে তুলে ধরতে পারে, কিন্তু কবিতার সাধারণ সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা কেউই কি নিরূপণ করতে পারে? আজ পর্যন্ত কি কোনও অভিধান, কোনও আকরগ্রন্থ, কোনও শব্দকোষ, বা কোনও সংস্থা কবিতার সংজ্ঞা দিতে পেরেছে? বা দিলেও সেই সংজ্ঞা কি সর্বজনীন, তার বাইরে কি কবিতা রচিত হয়নি বা হয় না? আমার তো জানা নেই।
“পৃথিবীর ইতিহাসে ছন্দোবদ্ধ পদাবলীর যে দিন প্রথম জন্ম, সেদিন থেকেই সাহিত্যের এই মায়াবী সন্তানটির দিকে মানুষের কৌতুহল এবং কৌতুক, স্নেহ এবং সন্দেহ, বৈরাগ্য এবং ব্যাকুলতার মাত্রা প্রায় সমান সমান”। পূর্ণেন্দু পত্রী ‘কবিতার ঘর ও বাহির’ বইটির শুরুতেই কবিতাকে সাহিত্যের ‘মায়াবী’ সন্তান বলে একাধিক প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন। কবিতা কাকে বলে? এর স্বরূপ কী? এর উদ্দেশ্য কী? উপজীব্যই বা কী হওয়া উচিৎ - বাস্তবের নির্যাস নাকি কল্পনার বিন্যাস? কবিতা পাঠক কেন পড়ে – চেনা অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখতে না অজানা অগোচরের নেশায় বুঁদ হতে? কবিতার সার্থকতা কি শুধু মায়াবী হয়ে থাকায়? তাই যদি হয়, নজরুল, সুকান্ত বা সরাসরি সামাজ-রাজনীতি সচেতন পদ্য রচয়িতারা – এঁরা কি তবে কবি নন? চে গুয়েভারার মতো সক্রিয় বিপ্লবীর হাতেও অন্তিম মুহূর্তে পাওয়া গিয়েছিল তাঁরই স্বরচিত কবিতার বই। পাবলো নেরুদাও বিশ্বাস করতেন কবিতা হল ‘social act’, যদিও তাঁর প্রেমের কবিতা প্রচুর। একবার নিজের স্ত্রী মাতিলদে উরুশিয়াকে উৎসর্গ করেই একশো সনেট রচনা করেন। অবশ্য প্রেম ব্যাপারটা ‘অসমাজিক’ কিছু তো হতে পারে না, অত্যন্ত সামাজিক বিষয়। তবু সমাজ সচেতনতায় প্রেয়সীর প্রতি প্রেম রোমান্স ব্রাত্য। তাই জন্যই হয়তো যে কবিকে রাজনীতি সচেতনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ছাড়া ভাবাই যায় না তাঁরই মন্তব্য, “The poet laureate of the masses is also the poet of the empty space....”।
অর্থাৎ কবিতার রূপ রস উদ্দেশ্য বিধেয় - কোনওটাই সুনির্দিষ্ট হতে পারে না। সচেতনভাবে সমাজমনস্ক এক কবি ডুবে যেতে পারেন ব্যক্তিগত আত্মকেন্দ্রিক অনুভূতির অতলে, আবার কঠোর বাস্তববাদী কবি হয়ে যেতে পারেন বেসামাল রকম ভাবপ্রবণ, অথবা লাভ করতে পারেন বিরলতম দর্শন। এটা স্ববিরোধিতা নয়। একাধিক সম্ভাবনা ও প্রবণতা যারা একই আধারে সহাবস্থান করে। কোনওটাই কারও চেয়ে খাটো বা শ্রেয় নয়। নেরুদা তাঁর আত্মকথনে এক জায়গায় লিখেছেন, “যে কবি বাস্তববাদী নন, তিনি মৃত। যে কবি শুধু বাস্তববাদী, তিনিও ততোধিক মৃত। যে কবি অযৌক্তিকতায় আচ্ছন্ন, তাঁর কবিতা বুঝবেন কেবল তিনি আর তাঁকে যারা ভালোবাসে। এটা দুঃখের। যে কবি তত্ত্ববাগীশ, তাঁকেও বুঝবে কেবল তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। এটাও দুঃখের।...”
একইভাবে কবিতা কাকে বলা হবে এর সংবিধানও কেউ রচনা করেছেন বলে জানা নেই। ছন্দ যদি কবিতার একটা পরিচিত আঙ্গিক হয়, ছন্দকে ভাঙা আর এক শিল্প, এমন কি ছন্দকে বৃদ্ধাগুষ্ঠ দেখানোও একটা স্বীকৃত শৈলী। ছন্দের শ্রেণিবিভাগ আছে। যেমন সংস্কৃত ছন্দগুলোর মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ কয়েকটি হল অনুষ্টুপ, মন্দ্রাকান্তা, বিদ্যুণ্মালা, ইন্দ্রবজ্রা, ভ্রমরবিলাসিতা, মাণবক, বংশস্থবিল, রথোদ্ধতা, শার্দুলবিক্রীড়িত ইত্যাদি। বাংলা ছন্দের মধ্যে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও দলবৃত্ত – এই বিভাজন ছাড়াও আরও নানা শ্রেণিভাগ আছে। এত কিছু জানার পর কবিতা লিখতে বসলে কবি নয়, প্রাবন্ধিক হয়ে যেতে হয়। যার অন্তরে ছন্দ আছে, সে তো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ছন্দিত পংক্তিতে ভাব ব্যক্ত করে। কিন্তু ছন্দ ছাড়াও তো কবিতা হয়। ছন্দহীনতার প্রকারসূচি রাখবে কে? ছন্দোবদ্ধ পদাবলী ছন্দানুশাসন দ্বারা শৃঙ্খলিত বলে উদ্যানের মতো সীমিত, আর ছন্দমুক্ত শব্দমালা অটবির মত বিস্তৃত – এমন তুলনাও হবে অতি সরলীকরণ। ছন্দ ছাড়া শব্দ সাজানো আধুনিক কবিতার একটা সাধারণ প্রবণতা হতে পরে, কিন্তু ছন্দহীনতাকে আধুনিকতার শর্ত মানা যায় না। সাম্প্রতিক কালেও বাংলায় ছন্দ নিয়ে অনেক নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, মুর্ছিত হচ্ছে অন্তমিল। অন্যদিকে তীক্ষ্ম শ্লেষে ভরপুর আপাত গদ্য আঙ্গিকে রচিত পংক্তিকেও অনেক সময় কবিতা বলে স্বীকার না করে উপায় থাকে না।
“কবিতার পংক্তি ছোট হবে কি বড়ো, সরু হবে কি মোটা, হলুদ হবে কি কালো, তার কোনও নিয়ম কানুন কেউ তৈরি করেছে নাকি? যিনি কবিতা লেখেন, শুধুমাত্র তিনিই এসব নির্বাচন-নির্ধারণের মালিক। তিনি নির্ধারণ করেন নিজের রক্ত এবং শ্বাস প্রশ্বাস দিয়ে, জ্ঞান ও অজ্ঞান দিয়ে। ...” পাবলো নেরুদা নিজের কবিতার সমালোচনার প্রত্যুত্তরে উদ্ধত ভঙ্গিতে এই যে কথাগুলো বলেছিলেন তাতে যে কোনও রচয়িতাকেই প্রশ্নাতীত স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে; অধিকার দেওয়া আছে নিজের রচনাকে সত্য ও মহান মনে করার। সেগুলো অন্য অনেকের ভালোলাগা কেড়ে নিতে পারলে, বুদ্ধি ও মননকে আবেদন করলে সার্থক, না হলে নয়। কিন্তু ‘কিছুই নয়’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার আগে একজন কবির "কবিতা" বলতে কী বোঝেন, নিজের সেই ধারণাটা নিরেট হওয়া দরকার; কারণ তাঁর লেখাও অনেকের কাছে 'কিছুই নয়' সাব্যস্ত হতে পারে। ... মস্ত পত্রিকা দপ্তরে আসীন সেই বিশ্ব বিখ্যাত সাহিত্যিক নিশ্চই নেরুদা পড়েছিলেন, আমার মতো অর্বাচীন পড়েছে যখন। অবশ্য একবার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর কাউকে পড়লেই যে মনে রাখতে বা মানতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? আর দিলেই বা মানতে হবে কেন?
কবিতা তাহলে কী? জনসনের উত্তর, “...কবিতা কী নয় সেটা বলে দেওয়াই তো সব চেয়ে সহজ। আলো কী সকলেই জানি, কিন্তু সেটা বলা আদৌ সহজ নয়।” আলোর বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা হয়তো জনসনের জানা ছিল না বলেই এই তুলনাটা করেছিলেন । কিন্তু ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। “.. যদি জিজ্ঞাসা করা না হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি জানি না।” তবে জনসনেরই ব্যাখ্যায়, “কবিতা হল মেট্রোলজিকাল কম্পোজ়িশন, আনন্দ ও সত্য এই দুটোকে এক সাথে মেলাবার শিল্প, যেখানে রিজ়নকে সাহায্য করার জন্য ডাক পড়ে ইমাজিনেশনের।”
কবিতার স্বরূপ ব্যাখ্যা এক এক কবি এক এক ভাবে দিয়েছেন। কেউ কেউ জোর দিয়েছেন বিষয়বস্তুর ওপর, কেউ বা ঝুঁকেছেন শিল্প ও সৌন্দর্যের প্রতি। এই মন্তব্যগুলোর মধ্যে মিল যত বিরোধও ততোধিক। যেমন কোলরিজ বলেছেন,
অন্যদিকে ফ্লবেয়ার দাবি করেছেন: “কবিতা জ্যামিতির মতোই নিখুঁত বিজ্ঞান।”
আমার মনে হয় দুজনেই বাড়াবাড়ি করেছেন এবং তাঁদের বক্তব্যের তাৎপর্য কী দাঁড়ায়, সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন না। সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ চয়ন কি কবিতা রচনায় সব সময় সম্ভব, নাকি সর্বোৎকৃষ্ট শব্দগুলো সব সময় কবিতাকে সর্বোৎকর্ষ দিতে সক্ষম? খুব সাদামাটা শব্দের উপযুক্ত মর্মস্পর্শী প্রয়োগও সার্থক শব্দ-শিল্প রচনা করতে পারে। শব্দগুলোর পারস্পরিক ব্যবহারই বলে দেয় পংক্তিগুলোকে কবিতা বলা হবে না গদ্য, ভালো কবিতা না ভালো নয়। আর কবিতাকে বিজ্ঞান বিরোধী হতেই হবে এটা তো আরও বড়ো গোঁয়ার্কিতুমি। সুতরাং কোলরিজের সমীকরণদু'টি এক ধরনের একপেশে অতিসরলীকরণ। তাছাড়া ছন্দের একটা বৈজ্ঞানিক রূপ থাকলেও তাকে কবিতার আবশ্যিক শর্ত বানানো যায় না। অন্যদিকে ফ্লবেয়ারের কবিতাকে বিজ্ঞান বলে দাবি করাটা তাঁর বা আরও কারও ব্যক্তিগত বিষয়বস্তু বা শৈলির বিবরণ হতে পারে, সার্বজনীন নয়। কবিতা বিজ্ঞান হলে তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকত।
মেকলের মতে, “..কবিতা বলতে আমরা বুঝি সেই শিল্প যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন; চিত্রকার রং নিয়ে যা করেন, এখানে শব্দ নিয়ে সেই কাজ”। এরই প্রতিফলন দেখি এডগার অ্যালেন পো’র ছোট্ট মন্তব্যে, “সৌন্দর্যের ছন্দোময় রূপ হল কবিতা”। কার্নাইলের ‘musical thought’-ও যেন কবিতার শিল্পিত সত্তাকেই স্বীকার করে।
মিলের কথায় যা “...চিন্তা এবং বাক্য যার মধ্যে আবেগ পেয়ে যায় শরীর”, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাকেই একটু অন্যভাবে বলেছেন, “সমস্ত জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সূক্ষ্ম আত্মা” অথবা “...প্রবল অনুভূতির স্বতোৎসার যার উৎস emotion recollected in tranquility..”। কবিতা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভাবটা এমন, যেন কবিতার ওপর আর কিছু থাকতে নেই।
তুলনায় রবার্ট ফ্রস্ট অনেক সোজা সাপটা ও অলংকাররোহিত, “...performance of words”। এরই প্রতিচ্ছবি দেখা যায় ম্যাথ্যু আর্নল্ডের বক্তব্যে: “simply the most delightful and perfect form of utterance that human words can reach” অর্থাৎ কবিতা হল শব্দের নান্দনিকতম ও নিখুঁততম কারুকাজ। এই নিখুঁততমের মধ্যে বাড়াবাড়ি নেই কারণ শব্দগুলোকে সর্বোৎকৃষ্ট বা নিখুঁত বলা হয়নি, তাকে নিয়ে শিল্পকলার প্রয়াসকে বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য কবি তাঁর পছন্দের শব্দগুলোর যথাসম্ভব সঠিক ও সুন্দর প্রয়োগে ব্রতী হবেন। রবার্টের performance of words-কেই আর্নল্ড আর একটু উচ্চাসনে বসিয়েছেন। বলা বাহুল্য কবি নিজের বক্তব্য বা ভাব প্রকাশের জন্য চয়িত শব্দগুলোর সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারেরই চেষ্টা করবে।
অ্যারিস্টটলের দাবি আবার বাঁধভাঙা, “কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়ো”। সম্ভবত বিষয় ভাবনার দিকে তাকিয়ে এই উক্তি; কিন্তু কবিতার মতো ব্যঞ্জনাধর্মী প্রকাশকে রূপকে দর্শনের সারাৎসার ভাবা গেলেও ইতিহাস কতটা বিধৃত হতে পারে, তা বোধগম্য নয়। সে কোনও সাহিত্যই তার সমসময়কে তুলে ধরে তখনই, যখন তা কোনও কাহিনী বলে। না হলে সে কেবল সমকালীন ভাষা শৈলির নিদর্শন হয়ে থাকে। এভাবে কবিতাকে অতিরিক্ত উচ্চাসনে বসিয়ে বোধহয় কবিরা নিজেরাই বন্দিত হতে চান, যেন তিনি যা বোঝেন যা পারেন তা সাধারণের সাধ্যের অতীত। সুতরাং কবিতার রচয়িতারা কবিতাকে অনাবশ্যক সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে বিরাট অতিরীন্দ্রিয় কিছু সাব্যস্ত করতে চান। অথচ বাস্তব হল, কবিতা সব থেকে সার্থক তখন, যখন তা জনমানসের হৃদয়ে দোলা দেয়, তাদের অন্তরের কথার শিল্পিত পরিব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায়। রোমান্টিক কবি কীটস্ও বিষয়বস্তুর ওপরই প্রাধান্য দিয়েছেন কিন্তু বাস্তবচিতভাবে: “১. কবিতাকে হতে হবে মহৎ এবং বাঞ্ছিত, যার যাতায়াত আত্মার ভিতরে, যা ভোলায় না বা চমকে দেয় না তার রূপে, দেয় বিষয়ে...। ২. কবিতা মুগ্ধ করে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হতে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা ক্রমশ ভেসে উঠছে স্মৃতিতে।”
কবিতা নিয়ে কবি ও পণ্ডিতদের মতামতের উপমা তুলনার শেষ নেই। অভেন যেখানে কবিকে কবিতার জনক হিসেবে দেখেছেন সেখানে এলিয়ট তুলে ধরেছেন স্রষ্টার সৃজন বেদনার কথাও, “কবিতা রচনা হল রক্তকে কালিতে রূপান্তরের যন্ত্রণা”। প্রথম জনের কাছে সম্ভবত কবিতা রচনা একটা পুরুষালি দক্ষতা; কিন্তু এলিয়টের ‘সৃজন বেদনা' বোধ কোথাও যেন সৃষ্টিকর্মে কবির নারীত্ব বরণকে নিজের অজানতেই ঠাঁই দিয়েছে। গদ্যই হোক কি পদ্য – রচয়িতার পরিশ্রম আন্তরিকতা ও যন্ত্রণা অনেকটা গর্ভধারণ ও প্রসব বেদনার সঙ্গে তুল্য; আর এটা বহু পুরুষ রচয়িতারও অনুভূতি।
কবিতার ভালো মন্দ নির্ধারণের প্রবণতাও দেখা যায় কারও কারও ব্যাখ্যায়। যেমন এলিয়ট এক জায়গায় বলেছেন: “অপরিণত কবিরা নকল করে, পরিণত কবিরা চুরি করে। খারাপ কবিরা যা নেয় তা বিকৃত করে, ভালো কবিরা তাকে নতুন করে দেয় বদলিয়ে..।" বোদলেয়ারের মতে “প্রত্যেক বড়ো কবি স্বভাবতই অনিবার্য রূপে সমালোচক। সেইসব কবির জন্য দুঃখিত, যারা নিয়ন্ত্রিত হয় শুধুমাত্র সহজাত প্রবৃত্তিতে। তারা অপরিণত। একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্যের কথা। কিন্তু একজন কবির মধ্যে সমালোচক জেগে না থাকলে আরও আশ্চর্যের।”
কখনও পরস্পর বিরোধী, কখনও বা পরস্পরের পরিপূরক নানান চিন্তাভাবনা উক্তিগুলো থেকে কবিতার কোনও মান্য সংজ্ঞা উঠে আসে না। তবে ভ্যালেরির একটি উক্তি সারা বিশ্বে খুব জনপ্রিয় হয়েছে, “কবিতার প্রথম পংক্তিটা আসে স্বর্গ থেকে, বাকিটা তুমি গড়ে তোল”। এখনে ‘প্রথম পংক্তি’ কথাটাও রূপক রূপে ধরাই সঙ্গত। কারণ ঠিক কোন লাইনটা স্বতোৎসারিতভাবে মাথায় জেগে উঠবে – প্রথমটা না মাঝেরটা নাকি শেষেরটা, তা কবিতা ও কবি ভেদে বদলে যেতেই পারে। আর বলা বাহুল্য, এটিও সংজ্ঞা নয়।
কবিতা সম্পর্কে বিদেশী কবিদের নানা ব্যাখ্যা-বিবৃতি পাওয়া গেলেও আমাদের দেশীয় কবিদের খুব বেশি কিছু বলতে শোনা যায়নি বা সেগুলো সংকলিত হয়নি। কবিগুরু ছোটগল্পের বর্ণনাও কবিতায় দিয়েছেন, কিন্তু কবিতাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন জানা জায়নি। আজকের তরুণ প্রজন্মের কয়েকজন কবিকে এই প্রশ্ন করেছি। তাদের কেউ কেউ বলেন, কবিতার সংজ্ঞা হয় না। তাহলে কেউ কোনও পংক্তি সমষ্টি ‘কবিতাই হয়নি’ বলে দেন কীসের ভিত্তিতে? কারও কাছে সদুত্তর নেই। এটা নেহাতই তর্কের মারপ্যাঁচ। এই পথ অবলম্বন করে যেকোনও লেখাকেই কবিতা হিসেবে স্বীকৃত করানো যায়, আবার ভালো লেখাকে দণ্ডিত করা যায়।
আর একটি মত জানাই যা জনৈক কবির ব্যক্ত করেছিলেন আমার প্রশ্নের উত্তরে; "যা গল্প বা অন্য কোনও সাহিত্য মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না অথচ কথাগুলো ব্যক্ত হতে চাইছে – সেটাই রূপ ধারণ করছে কবিতার।" এটা আপাতভাবে অনেকের মনঃপূত হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন তাই যদি হয়, তাহলে প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি – এগুলোকে কী বলা হবে, যারা আঙ্গিকে ছন্দোবদ্ধ পদ্য হলেও চরিত্রে এক একটি উপন্যাস। কাব্য হিসেবে যতজন পাঠ করে, কাহিনী হিসেবে পাঠক তার চেয়ে ঢের বেশি। একই কথা খাটে বাংলার চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য ও পদাবলী সাহিত্যের মতো উপাখ্যানধর্মী কাব্যগুলির ক্ষেত্রেও, এমন কি বাংলা কবিতায় অমিত্রাক্ষরতা নিয়ে যুগোত্তীর্ণ পরিক্ষা নিরীক্ষা চালানো মাইকেল মধুসূদনের কি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর বেলাতেও। আজকের গদ্য-কবিতার রচয়িতা যাঁরা সচেতনভাবে ‘দীক্ষিত’ পাঠক ছাড়া এলেবেলেদের জন্য লেখেন না বলে গর্ব করেন, তাঁরা কী বলেন? আধুনিক কাব্যরচনা জয় গোস্বামীর ‘নন্দর মা’-ও কি আদতে একজন বাস্তুহারা মানুষের কাহিনী নয়? প্রকরণ আধুনিক হলেও রচনার চরিত্র সনাতন। অতএব এই গদ্যহীনতার বিকল্প ধারণাও কবিতার সাধারণ সংজ্ঞা নয়, কারও ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি হতে পারে।
২০১০-এ সদ্য কবিতা সংকলন প্রকাশের পর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যচর্চার হালে পানি পেতে চাইছি, তখনই কবিতা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ফাজলামিটি করে ফেলেছিলাম। “যা পড়তে ইচ্ছে না করলেও লিখতে প্রায় সকলের ইচ্ছা করে, তারই নাম কবিতা।" আমার অপরিণত প্রয়াসের প্রতি মিশ্র প্ররিক্রিয়ার মধ্যে কবিতা আদৌ হয়েছে কিনা তাই নিয়ে অনেক তির্যক মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমার অকপট সাফাই ছিল: “আমার বক্তব্য প্রকাশের জন্য যে স্বতস্ফূর্ত ভাষা ও ভঙ্গি আমি বেছে নিয়েছি, আমার নিজের কাছে সেগুলো কবিতা বলেই মনে হয়েছে।" পরে দেখলাম এ যে নেরুদার দৃপ্ত ঘোষণারই বিনম্র রূপ। হরিপদ কেরানি আর আকবর বাদশা – স্বয়ং কবিগুরু লিখে গিয়েছিলেন!
আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই প্রশ্নটাই মাথা চাড়া দেয়, কবিতা কি তাহলে বক্তব্য প্রকাশেরই মাধ্যমবিশেষ? এর সমর্থনে স্মরণ করা যায় গ্যেটের “Poetry and Truth”-এর কয়েকটি লাইন – “ ছন্দ আর মিলকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি, কারণ ওদের দিয়েই কবিতা প্রথমত হয়ে ওঠে কবিতা। কিন্তু কবিতার পক্ষে যা সত্যিই গভীর এবং মৌলিকভাবে কার্যকরী, সবচেয়ে স্থায়ী এবং উন্নয়নমূলক, তা হল – কবিতাকে গদ্যে অনুবাদ করলে যা থেকে যায়। থেকে যায় সারাৎসার। পূর্ণ এবং পবিত্র। এটা না থাকলে কবিতা শুধুই এক চটকদার কাঠামো আর থাকলে ঐসব চাকচিকন সে লুকোতে পারলে বাঁচে। আমি কবিতার গদ্য অনুবাদকে মনে করি অনেক বেশি দরকারি এবং কার্যকর। বিশেষ করে তরুণ সংস্কৃতির কথা ভেবে।” কীটস্-এর দেওয়া সংজ্ঞার সঙ্গে এর একটা অন্তরঙ্গ সাজুয্য পাওয়া যায়। আর এই তাগিদ থেকেই কি রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদে (গদ্যরূপে?) হাত দেওয়া? অন্তত কারও কারও এমনই অনুমান।
কবিতা কী কেন কেমন এসবের মীমাংসা করার চেয়ে বরং তার বিবর্তনের ইতিবৃত্ত নিয়ে আলোচনা সহজ। এলিয়ট একবার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “...আমার তো মনে হয় না কাউন্টার রেভলিউশনের মতো কোনও কিছু আমার চোখে পড়েছে। ট্রাডিশনাল ফর্মের আওতা থেকে বেরিয়ে আসার পর একটা সময় আসে যখন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয় ট্রাডিশনাল ফর্মকে নিয়েই। তার মানে এই নয় যে আমরা হাঁটছি পিছন দিকে। আমরা একটা পুরোনো ফর্মকেই কতটা নতুন চেহারা দেওয়া যায় তারই চেষ্টা করছি। একে কি প্রতিবিপ্লব বলে?” অসাধারণ বিশ্লেষণ এবং মোক্ষম প্রশ্ন। তবে উত্তর যতটা ‘না’ ততটাই ‘হ্যাঁ’ হতে পারে।
ফিরে আসি পূর্ণেন্দু পত্রীতে যাঁর ‘ঘর ও বাহির’ বইখানি বর্তমান প্রবন্ধের অন্যতম অবলম্বন। সেখানে তিনি এলিয়টের উপরোক্ত উদ্ধৃতি দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, “বাংলা সাহিত্যের বেলায়ও কি এলিয়টের এই কথাটা সত্যি নয়? প্রত্যেক দশ বছর পর জন্ম নিচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দশকের কবি। কিন্তু মূলত একই শিকড়ের ডালপালা সবাই। জীবনানন্দের পর জীবনানন্দের পরিমণ্ডলে পার হয়ে যাওয়ার কাউন্টার রেভলিউশন দেখা দেবে কবে? দশ বছর তো পার হয়ে গেছে কবেই?” এই বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৮৩ সালে। তারপর আরও পাঁচ দশক উত্তীর্ণ। ‘হাংরি’ আন্দোলনও নতুন কিছু না, নজরুল সুকান্তকে এর অগ্রজ বলা যায়। উত্তরাধুনিক কবিতার যে সদম্ভ ঘোষণা ও চর্চায় মত্ত কিছু গোষ্ঠী, তাদের সঙ্গে পাঠকের যোগ কতটা, আর সেই যোগের স্থায়িত্ব কতদিন -- তা বিচারের সময় কিন্তু এসে গেছে। এই উত্তরাধুনিকতাকে কি প্রতিবিপ্লব বলা হবে?
এসব কচকচি সরিয়ে রেখে একটা সহজ পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করি। কবিতা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সমান্তরালে আরও একটি ভিন্নতর ধারণা হয়তো বলতে চায়, কবিতা আসলে এক উৎকর্ষের অনুভূতি। এই অনুভূতি সাহিত্য, এমনকি শিল্পের এমন কোনও চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কিংবা রচনার আত্মা যা গদ্যরূপে বা শিল্পরূপেও প্রতিমূর্ত হতে পারে। তাই কোনও কোনও মনোহর গল্প পড়ে, নাটক, চলচ্চিত্র বা চারুকলা দেখে মনে হয়, “এ তো কবিতা!” রূপায়নের সূক্ষ্মতা ও নান্দিকতারই রূপক যেন কবিতা। অন্যদিকে খাঁটি ছন্দে গাঁথা পদ্যও হয়ে যেতে পারে উপাখ্যান বা কাহিনী। তাই গদ্য ও পদ্যের সীমারেখাটা তাদের অন্তর্নিহিত চরিত্রই অনেক সময় এলোমেলো করে দিতে পারে।
প্রসঙ্গত ভালো গদ্য ও কাহিনী রচনা অনেক বেশি শ্রমসাধ্য ও কঠিন, আর তার পাঠকও বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের মুগ্ধতার অনুভূতি, সৌন্দর্য্যেরও উপমা হিসাবে আমরা কবিতার প্রতিই পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে এসেছি। মাত্র একুশ বছর বয়সে অকালপ্রয়াত যে তরুণ কবি সারাজীবন শুধু কবিতাই লিখে গেছেন, তাও এমন কবিতা যা অচলায়তান সমাজের রূঢ় বাস্তবকে তীক্ষ্ণ শ্লেষে ফালাফালা করে দেয়, তাঁর কাছেও কবিতা হল এক স্বপ্নীল বিলাসিতা, আর গদ্য যেন কঠিন বাস্তবের প্রতিমূর্তি। “ক্ষুধার জগতে পৃথিবী গদ্যময়” বলে ‘কবিতা’-কে অভিমান করে যিনি ‘ছুটি’ দিতে চেয়েছেন, সেই সুকান্ত কবিতার অভিব্যক্তিতেও কবিতার কাছেই আত্মসমর্পণ। এখানেই ‘সাহিত্যের এই মায়াবী সন্তানটি’ জিতে গেছে। কবিতার কাছে আমাদের প্রত্যাশাই সম্ভবত কবিতার স্বরূপের সর্বোত্তম নির্ণায়ক।
কবিতা কখনও মিথ্যে বলে না যতটুকু চিনি তাকে,
সবার হৃদয়ই উদ্বেল হতে পারে কবিতার ডাকে।
প্রধান সূত্র:
কবিতার ঘর ও বাহির: পূর্ণেন্দু পত্রী
অন্যান্য নির্দেশিকা: