Image by Gerd Altmann from Pixabay
মানুষ নিজের জন্মগত লিঙ্গ পরিচয় মেনে নিতে না পারলে যে মনোকষ্টে ভোগে, তার নাম লিঙ্গ-পরিচয় সংকট (Gender Identity Disorder) বা ‘লিঙ্গপরিচয়গত অতৃপ্তি’ Gender Dysphoria বলে। এই ব্যাপারে বিশদ আলোচনা আমার গত মাসের প্রবন্ধে আছে। সেখানে আরও দেখেছি রূপান্তরকামী মানুষ মাত্রেই যে লিঙ্গান্তরণ করতে চাইবে, তার কোনও মানে নেই। একটা বড়ো অংশই বিশেষত জন্মগত পুরুষরা নিজের যৌনাঙ্গের শল্যচিকিৎসা বা কোনোরূপ পরিবর্তন না করিয়ে যখন যেমন ইচ্ছা নারী অথবা পুরুষে ভোল বদলানোর স্বাধীনতা চায়। অনেক প্রকৃত রূপান্তরকামী তাই ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটা পছন্দ করে না, নিজেদের ‘ট্রান্স সেক্সুয়াল’ বলে। ট্রান্সজেন্ডার ও ট্রারন্সসেক্সুয়াল পদদুটির মধ্যে সম্পর্ক যেমন আছে, সূক্ষ্ম পার্থক্যও আছে।
‘Transgender’ পদটির আওতায় লিঙ্গ-পরিচয়গত সংকটে ভোগা তথা অপ্রচলিত লিঙ্গাভ্যাসকারীরা সকলেই পড়ে। তাদের কেউ নিজেদের যৌনাঙ্গ অবিকৃতও রাখতে পারে। কিন্তু ‘Transsexual’ বা লিঙ্গান্তরণকামী মানুষরা হল Transgender বা রূপান্তরকামী গোষ্ঠীরই সেই সুনির্দিষ্ট অংশ (Transsexual is a subset of Transgender), যারা বাস্তবিকই চিকিৎসার সাহায্যে এক লিঙ্গ থেকে অন্য লিঙ্গে রূপান্তর বা transition ঘটিয়ে নিজেদের জেন্ডার ডিস্ফোরিয়ার সমাধান চায়। যেমন জন্মসূত্রে কোনও পুরুষ নারীতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট এক বা একাধিক নারীকরণ শল্যচিকিৎসা (Feminizing surgery)-র সাহায্য নিতে পারে। যেমন শিশ্নবিযুক্তি (Penectomy), অণ্ডকোষ বিযুক্তি (Orchiectomy) ও যোনিকারক অস্ত্রোপচার (Vaginoplasty), যেগুলো একত্রে জননাঙ্গের Feminizing Genitoplasty বা নারীকরণ অস্ত্রোপচার বলা হয়। উল্টোদিকে জন্মসূত্রে নারী পুরুষে রূপান্তরিত হতে চাইলে সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক পুরুষীকরণ শল্যচিকিৎসা (Masculinizing surgery)-র শরণাপন্ন হয়। যেমন গর্ভবিযুক্তি (Hysterectomy), ডিম্বাশয় বিযুক্তি (Oophorectomy) এবং ভগাঙ্কুর ও যোনি থেকে যথাক্রমে Metoidioplasty ও Phalloplasty পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে পুরুষাঙ্গ রচনা।
ইচ্ছুক ব্যক্তির প্রথমেই লিঙ্গান্তরণেচ্ছা বা transsexualism পরীক্ষা করা হয়, যার মানে তার মধ্যে বাস্তবে সম্পূর্ণ লিঙ্গান্তরিত হওয়ার ইচ্ছা সত্যিই আছে কিনা, থাকলে কতটা। কারণ এই ধরনের চিকিৎসায় যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে। তাই প্রথমে মানসিক কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে
লিঙ্গ পরিচয়গত অতৃপ্তি বা সংকট বা ডিসফোরিয়া থাকলে দুটো রাস্তা খোলা। এক তার জন্মগত লিঙ্গে ফিরে যেতে মানসিক উপদেশ বা কাউন্সেলিং। যদি তার পরেও লিঙ্গান্তরণ ঘটিয়ে বিপরীত পরিচয়ে যেতে চায়, তাহলে রয়েছে হরমোন থেরাপি ও অস্ত্রোপচার, যা আগের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল কারও মধ্যে কতটা তীব্র জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া আছে। ডিস্ফোরিয়া গুরুতর হলে লিঙ্গান্তরণ করিয়ে নেওয়াই সেরা সমাধান।[1]
১৮ বছরের পর পরিণত বয়সেও কারও বীপরীত লিঙ্গের উপসর্গ দেখা গেলে তার মধ্যে প্রকৃতই জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া আছে ধরে নেওয়া যায়। লিঙ্গান্তরণের চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে তখন সুবিধা হয়। জেন্ডার ডিসফোরিয়ার Biological Treatment বা জৈবিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসাও করা হয় যদিও WPATH Standards of Care অনুযায়ী তা বাধ্যতামূলক নয়।[3] কতগুলো সরকারি নির্দেশিকা পালন করতে হয় শুধু।
চিকিৎসার অঙ্গ হল: ১. মানসিক স্বাস্থ্যে সহায়তা ও কাউন্সেলিং, ২. লিঙ্গান্তর (cross-sex) হরমোন থেরাপি, ৩. বাচিক ও ভাষা শিক্ষা যাতে পরিবর্তিত লিঙ্গের মানুষদের অনুরূপ কথা বলতে পারে, ৪. রোম অপসারণ, ৫. সমবয়সী ও অনুরূপ উপসর্গে ভোগা মানুষদের সাথে মেলামেশা, ৬. পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতা করার পরামর্শ। ট্রান্স মহিলা ও ট্রান্স পুরুষ ভেদে চিকিৎসা ভিন্ন ভিন্ন হয়।[2][3]
পুরুষ নারীতে রূপান্তরিত হতে চাওয়া রূপান্তরকামী নারী (Trans Women) তাদের স্ত্রী-কারক হরমোন (Feminising hormones) ইসট্রোজেন ও প্রজেস্টেরোন প্রয়োগে যে পরিবর্তন ঘটে সেগুলি হল: ১. পুরুষ প্রত্যঙ্গ দুটির আয়তন হ্রাস, ২. পেশি হ্রাস, ৩. পশ্চাদ্দেশের মেদ ও আকার বৃদ্ধি, ৪. স্তনের সামান্য বৃদ্ধি, ৫. মুখ ও দেহের রোম হ্রাস বা নরম হয়ে আসা। কিন্তু পরিপূর্ণ রূপান্তর আনতে দরকার শল্য চিকিৎসা যার মধ্যে আছে: ১. স্তন স্থাপন (Breast Implants), ২. অণ্ডকোষ অপসারণ (Orchidectomy), ৩. লিঙ্গ অপসারণ (Penectomy), ৪. অস্ত্রোপচারে যোনি রচনা/নির্মাণ (Vaginoplasty), ৫. অস্ত্রোপচারে যোনিমণ্ডল রচনা বা ভালভা নির্মাণ (Vulvoplasty) এবং ৬. অস্ত্রোপচার দ্বারা অনুভূতি সমেত ভগাঙ্কুর নির্মাণ (Clitoroplasty)। ৭. কেউ কেউ কণ্ঠস্বর পরিবর্তক অস্ত্রোপচার বা voice modifying surgery করিয়ে নেয়, যেহেতু হরমোন প্রয়োগে কণ্ঠস্বর বদলায় না।
যেসব নারী পুরুষ হতে চায় বা রূপান্তরকামী পুরুষ (Trans Men) তাদের পুরুষ-কারক হরমোন (Masculinising hormones) দেওয়া হয় যাতে – ১. দেহে ও মুখে রোম বৃদ্ধি পায়, ২. পেশি বৃদ্ধি পায়, ৩. ক্লিটোরিস যা নারী অঙ্গের সবচেয়ে সুখানুভূতিপ্রবণ অংশ আকারে বাড়ে, ৪. মাসিক ঋতু বন্ধ হয়, ৫. কাম তাড়না (libido) বাড়ে, ৬. কণ্ঠস্বর খানিকটা ভারী হয়ে আসে। এখানেও পরিপূর্ণ রূপান্তর আনতে অস্ত্রোপচার করতে হয় যার মধ্যে আছে — ১. উভয় স্তন অপসারণ (Bilateral Mastectomy), ২. জরায়ু অপনয়ন (Hysterectomy), ৩. ফ্যালোপিয়ান টিউব-সহ ডিম্বাশয় অপসারণ (Salpingo-Oophorectomy), ৪. যোনি বা ভগাঙ্কুর থেকে অস্ত্রোপচার দ্বারা শিশ্ন সৃষ্টি (Phalloplasty or Metoidioplasty) ও শিশ্ন-স্থাপন (Penile Implant), ৫. অণ্ডকোষ সৃষ্টি ও স্থাপন (Scrotoplasty)। ফ্যালোপ্লাস্টিতে লিঙ্গ তৈরি করা হয় যোনি, হাতের ভেতর দিক ও তলপেটের কোষ-কলা নিয়ে; আর মেটয়ডিওপ্লাস্টিতে তা তৈরি হয় ক্লিটোরিস থেকে।
লক্ষ্যণীয় নারী থেকে পুরুষ হতে গেলে তার মধ্যে যৌনাকাঙ্খা বাড়ানো হয়, টেস্টোস্টেরন হরমোন মেয়েদের মধ্যেও লিবিডো বাড়িয়ে তোলে। অর্থাৎ পুরুষের খাই খাই করাটা এক প্রকার প্রকৃতির ষড়যন্ত্র। আর একটা ব্যাপার হল স্ত্রী-অঙ্গের সব চেয়ে সুখানুভূতিপ্রবণ অংশ ক্লিটোরিসকে অনুভূতি বজায় রেখে সাধারণত পুরুষাঙ্গে রূপান্তরিত করা হয়। স্বাভাবিক যৌন মিলনে নারী দেহের এই অংশটি কিন্তু বেশির ভাগ উপেক্ষিতই থেকে যায়, যার ফলে অধিকাংশ নারী মিলনের সময় রতিতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যায়, যদি না এই অংশটিকে আলাদা ভাবে উদ্দীপিত করা হয়।
যদি শরীরে উভয় লিঙ্গের উপস্থিতি থাকে তাহলে শারীরিক ও মানসিক প্রবণতার ভিত্তিতে হরমোন বা শল্য চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত ও সহজ। কিন্তু পরিপূর্ণ নারী পুরুষ হতে চাইলে বা পরিপূর্ণ পুরুষ নারী হতে চাইলে তখন এত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা যাচাইয়ের প্রশ্ন। তাছাড়া এই জাতীয় রূপান্তরণের জন্য যে হরমোন প্রয়োগ করা হয় তাতে ক্যান্সার, হৃদরোগ, বৃক্কের জটিলতা সহ একাধিক শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। খোদার ওপর খোদগারি করলে যা হয়। কিন্তু খোদা যদি নারীকে এক তরফা কষ্ট দেওয়ার বিধান সৃষ্টির পরেও নারী পুরুষের মানসিক সংগঠনে এত জটিলতা ঠেসে দিয়ে থাকেন, তখন সেই যন্ত্রণার উপশমে মানুষকেই অবতীর্ণ হতে হয়।
পুরুষ নারী হতে চাইলে শুধু স্ত্রী হরমোন প্রয়োগই যথেষ্ট হয় না, নিতে হতে পারে অ্যান্ড্রোজেন রোধক anti-androgen যা কঠোরভাবে পুরুষালি হরমোন ও তার প্রভাবকে দমন করে। তাছাড়া মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে ক্ষরিত হয় GnRH (gonadotropin-releasing hormone) যা পিটুইটারি গ্রন্থিকে LH (luteinizing hormone) ও FSH (follicle-stimulating hormone) উৎপাদনে উদ্দিপিত করে। এই দুটি হরমোন রক্তবাহিত হয়ে সংশ্লিষ্ট স্ত্রী ও পুরুষ দেহের যৌনাঙ্গে উপযুক্ত যৌন হরমোন ও স্টেরয়েড ক্ষরণ ঘটায়। সুতরাং পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরকামীদের কেবল ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন দিলেই কাজ হাসিল হয় না, অন্যদিকে নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরকামীদের শুধু টেস্টোস্টেরন কি অ্যান্ড্রোজেন দিলেই চলে না। তাই পিটুইটারি ক্ষরিত হরমোনের স্বাভাবিক কাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে দরকার হয়ে পড়ে GnRH analogues. এই কৃত্রিম হরমোনের দামও যথেষ্ট।
নিতান্ত অপরিহার্য না হলে এই জাতীয় চিকিৎসার শরণাপন্ন না হওয়াই শ্রেয়। এই রূপান্তরণের বিশেষ করে হরমোন চিকিৎসার নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি হল :- :[4]
১. নারীতে রূপান্তরিত পুরুষদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ ইস্ট্রোজেন প্রয়োগের ফলে শরীরে রক্ত জমে যাওয়ার বা তঞ্চন প্রবণতা বেড়ে যায় যাকে pro-thrombotic effect of estrogens বলে। এর ফলে গভীর শিরায় থ্রম্বোসিস (Deep Venous Thrombosis or DVT) বা ফুসফুসীয় ধমনীতে রক্ত তঞ্চন (Pulmonary Embolism or PE) হতে পারে। হঠাৎ করে এক পা ফুলে ব্যথা করা এর অন্যতম উপসর্গ। তাছাড়া বুকে ব্যথা, হাঁফ ধরা, উদ্বেগে ধড়ফড় করা ইত্যাদি তো আছেই। ইস্ট্রোজেন বড়ি ইথিনাইল এস্ট্রাডিয়ল (ethinyl estradiol) যা গর্ভ নিয়ন্ত্রণের জন্য অধিকাংশত ব্যবহৃত হয়, তার অনেক বিরূপ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
২. পুরুষ হরমোন নিরোধক Antiandrogens প্রয়োগের ফলে দেহের লোম মুখের দাড়ি গোঁফ নির্মূল হয় না, তবে কমে যেতে পারে বা নরম হয়ে যেতে পারে।
৩. যে যৌনতার তাগিদে রূপান্তর, সেই যৌন ক্ষুধা অনেকটাই কমে যেতে পারে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হলে। অবশ্য তাতে করে পুরুষের যৌন দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে কিনা সে কথা বলা যায় না। লিবিডো বজায় রাখতে ট্রান্স ওম্যানরা কেউ অল্প পরিমাণ টেস্টোস্টেরন ব্যবহার করে, কারও প্রয়োজন হয় স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রোজেন বা প্রজেস্টেরন। এর ফলে যৌনাঙ্গে ও রেচনতন্ত্রে নানাবিধ জটিলতা হতে পারে।
৪. ত্বকের বাহির্ভাগ পাতলা, অতিরিক্ত স্পর্শকাতর, রং ফিকে হয়ে যাওয়া, চুলকুনি বা অস্বস্তি ইত্যাদি হরমোন চিকিৎসার অন্যতম প্রতিক্রিয়া।
৫. তৈলগ্রন্থি (Sebaceous gland) কমে যাওয়ায় ত্বকের তেল উৎপাদন কমে যায় যার ফলে তৈলাক্ত ত্বকের ব্রণ ফুসকুড়ি নিয়ন্ত্রিত হলেও স্বাভাবিক বা শুষ্ক ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে যায়। তেল ক্রীম লোশন ঠিকমতো প্রয়োগ না করলে অসুবিধা হতে পারে।
৬. ত্বক পাতলা হয়ে ও ত্বকে পিগমেন্ট কমে যাওয়ায় রৌদ্রদাহর (sunburn) সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৭. ইস্ট্রোজেন প্রয়োগের ফলে পিত্তথলির (gallbladder) অসুখ হতে পারে। সেই সাথে যকৃতের কাজকর্মও (liver function) বিঘ্নিত হতে পারে, টক্সিসিটি বা বিষক্রিয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই ট্রান্সজেন্ডার মহিলাদের নিয়মিত liver function test করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৮. ট্রান্সজেন্ডার মহিলাদের শরীরে prolactin হরমোন তৈরির সম্ভাবনা তৈরিহয়, যার প্রভাবে স্তনবৃন্ত থেকে দুধ ঝরার উপসর্গ দেখা দিতে পারে। শুধু তাই নয় প্রোল্যাক্টিন মাত্রা খুব বেশি হলে মাথা ধরা, মাথা ঘোরা, বমি ভাব, মেজাজ খিঁচড়ে থাকা, বিমর্ষতা ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে পারে।
১০. ইসট্রোজেন প্রয়োগের ফলে ইনসুলিনের কাজ ব্যাহত হয়ে Type-2 ডায়াবেটিসও হতে পারে।
১১. মানসিক কিছু সমস্যাও হতে পারে হরমোন প্রয়োগের ফলে। তবে রূপান্তরকামীরা এমনিতেই মানসিক দিক দিয়ে ভিন্ন গোত্রের, তাই তাদের জটিলতা ওষুধেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াজাত কিনা বোঝা মুশকিল।
১৩. তবে ডিপ্রেশন লিঙ্গান্তরণের একটা সাধারণ প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা গেছে। মেজাজ (mood) পরিবর্তনের জন্য Progestin হরমোনগুলি বিশেষত Medroxy-progesterone acetate-কে দায়ী মনে করা হয়।
১৪. মাইগ্রেনের সমস্যাও হতে দেখা গেছে।
আবার এই জাতীয় চিকিৎসা করে শারীরিক, মানসিক ও যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতির দাবিদারও কম নয়। একটি সমীক্ষা দাবি করছে: লিঙ্গ পুনর্বিন্যাসের পর ৮০% জেন্ডার ডিসফোরিয়ায় কষ্ট পাওয়া মানুষ লিঙ্গ পরিচয় সংকট কাটাতে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি করেছে। (95% CI = 68–89%; 8 studies; I2 = 82%); ৭৮% জানিয়েছে তাদের মানসিক উপসর্গের উন্নতি হয়েছে (95% CI = 56–94%; 7 studies; I2 = 86%); ৮০% জানায় জীবনের মান উন্নত হয়েছে (95% CI = 72–88%; 16 studies; I2 = 78%); এবং ৭২% বলে যৌন ক্ষমতার তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়েছে (95% CI = 60–81%; 15 studies; I2 = 78%)। তবে সমীক্ষকদের এটাও সন্দেহ এই ধরনের চিকিৎসকেরা সাফল্যটাই বেশি করে তুলে ধরবে। আবার যারা নিজেদের রূপান্তরিত ভূমিকায় সমাজে মানিয়ে নিতে পেরেছে তারা ডাক্তারদের কাছে ফলো-আপ চিকিৎসার জন্য খুব বেশি যোগাযোগ করে না, কিন্তু যাদের সমস্যা হয় তারাই নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।[5]
তবে স্ত্রী হরমোন চিকিৎসার কিছু প্রভাব মন্দ নয়। যেমন —
১. স্ত্রী হরমোন ও অ্যান্টি অ্যান্ড্রোজেন প্রযুক্ত হলে ত্বক, স্বেদ ও পস্রাবে পুরুষালি গন্ধ অনেকটা পেলব হয়ে যেতে পারে, বদলে হাল্কা সুঘ্রাণ তৈরি হতে পারে।
২. ত্বকের নীচে ফ্যাট যুক্ত অ্যাডিপোজ কলা জমে দেহের গড়ন গঠন নরম ও পেলব হয়ে যায়, বিশেষত উরু, পয়োধর ইত্যাদি অংশ। আবার বাড়তি অ্যাডিপোজ তথা চর্বি জমলে ত্বকে তার প্রসারণ চিহ্ন অর্থাৎ stretch mark দেখা দিতে পারে।
৩. তাছাড়া ইস্ট্রোজেন এমন যৌন হরমোন যা অস্থির ক্ষয় রোধ করে, এমনকি পুরুষ দেহেও।
শুধু হরমোন থেরাপি করালে কিছু পরিবর্তনের অভিমুখ চাইলে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। কেউ নিজের আদি জন্মগত লিঙ্গে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে সব ফেরত হয় না হয়তো, তবে কিছু কিছুর পুনর্বিন্যাস সম্ভব। যেমন – ১. যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া, ২. শরীরে চর্বির বিন্যাস, ৩. হ্রাসপ্রাপ্ত পেশির বিকাশ, ৪. ত্বকের পরিবর্তন, ৫. লোম হ্রাস, ৬. দেহের গন্ধ ও স্বেদ উৎপাদনের বদল, ৭. শিরার প্রকটতা হ্রাস ইত্যাদি।
শল্য চিকিৎসা দ্বারা অঙ্গহানি ঘটালে বলা বাহুল্য তা স্থায়ী রূপান্তর, যার দিক উল্টে আগের রূপে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। জটিল অস্ত্রোপচার দ্বারা যৌনাঙ্গের রূপান্তর ঘটালেও তা পূর্ববর্তী রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই দুরূহ এবং রোগীর স্বাস্থ্যের পক্ষেও অত্যন্ত ধকল সাপেক্ষ। তবে অঙ্গহানি না ঘটালে অসম্ভব কিছুই নয়; যা আপাতভাবে স্থায়ী রূপান্তর তারও বিপরীত রূপান্তর সম্ভব।
টমাস বেটি (Thomas Beatie) ছিলেন জন্মগত নারী যিনি ২০০৯ সালে উভয় স্তনাপসরণ ( double mastectomy) করিয়ে আপাতভাবে নারীচিহ্ন মুছে ফেলে পুরুষীকরণ অস্ত্রোপচার করান।[6] কিন্তু জরায়ু ও ডিম্বাশয় বাদ দেননি। [7][8][9] বিয়ে করেন যে মহিলাকে তিনি সন্তানধারণে অক্ষম বলে নিজেই গর্ভধারণের সিদ্ধান্ত নেন কৃত্রিম নিষেক (artificial insemination) দ্বারা। [9][10] টেস্টোস্টেরন নেওয়া বন্ধ করে নারীত্বে ফিরে যান এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের এমন এক যুগান্তকারী সাফল্যের নিদর্শন রেখে তিনি বাস্তবে গর্ভবতী হয়ে ২০০৮ সালে প্রথম সন্তান[31] ও ২০০৯ সালে দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করেন।[12] কিন্তু মাতৃত্বের মতো প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা লাভের পরেও নিজেকে নিজের গর্ভজাত সন্তানদের পিতা ও তাঁর স্ত্রী ন্যান্সিকে তাদের মা মনে করেন।[7][1] স্ত্রীর সঙ্গে যদিও সন্তানদের আদৌ কোনও জেনেটিক বা গর্ভের সম্পর্কই ছিল না। মিডিয়া তুমুল হল্লা করে পুরুষের সন্তান প্রসব বলে তুমুল নাচানাচি করল।[14] মাও প্রাকৃতিক সত্য অস্বীকার করলেন প্রসবী পিতা হিসাবে অতুলনীয় রেকর্ডের মোহে। বেটি একজন আইনজীবী ও সক্রিয় রূপান্তকামী অধিকার (Transgender Rights) রক্ষা কর্মী, যিনি বিশেষ করে রূপান্তকামীদের উর্বরতা (transgender fertility) ও তাদের প্রজননাধিকার (Reproductive Rights).[15]
আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ, ২০২১ সালে নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত হয় রায়ান সান্ডারসন (Ryan Sanderson)। নিজের স্তনও বাদ দিয়ে ফেলে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে। কিন্তু আভ্যন্তরীণ স্ত্রী অঙ্গটি বজায় রাখে। টেস্টোস্টেরন চলা কালেই হঠাৎ আবিষ্কার করে সে গর্ভবতী। রূপান্তরের আগেই তার প্রাক্তন পুরুষ বন্ধুর সংসর্গে তার গর্ভসঞ্চার হয়েছিল।[16]
এগুলো, যা আপাতভাবে স্থায়ী রূপান্তরেরও অভিমুখ ফেরাতে পেরেছে। তবে এইসব দম্পতির সন্তান লাভ চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্য সূচিত করলেও নতুন মানুষটির পক্ষে কতটা মঙ্গলময় তাই নিয়ে আমার সংশয় আছে। সে একটু জ্ঞানগম্যি হলেই জানতে পারবে সে একটা অস্বাভাবিক সম্পর্কের ফসল যার মাতৃ-পিতৃ পরিচয় অজানা না হয়েও এক অতল রহস্য! গর্ভধারিণী ও প্রসবিনীকে সে হয়তো মা নয়, বাবার ভূমিকায় দেখে প্রাকৃতিক সত্য অস্বীকার করতে শিখবে! এই চ্যালেঞ্জগুলো পরীক্ষামূলকভাবেই ঠিক আছে, সামাজিকভাবে কিন্তু জটিল প্রশ্ন চিহ্ন।
লিঙ্গ পরিচয় অতৃপ্তি বা Gender Dysphoria-র বিপরীতে একটি শব্দ রচনা করা হয়েছে ‘Gender Euphoria’ (GE)। লিঙ্গান্তরণকামীরা বিপরীত লিঙ্গে রূপান্তরিত হ্ওয়ার পর নিজেদের অভীষ্ট লিঙ্গ পরিচয় ও দৈহিক পরিচয়ের বিভেদ ঘুচে যাওয়ায় যে পরিতৃপ্তি, পরিত্রাণ ও আনন্দ লাভ করে, সেই অনুভূতির নাম ‘জেন্ডার ইউফোরিয়া’।[17][18] বাংলায় হুবহু অনুবাদে ‘লিঙ্গাচ্ছ্বাস’ বললে বিভ্রান্তি, পরিবর্তে ‘লিঙ্গান্তরণোত্তর উচ্ছ্বাস’ বলা যায় কিনা বিবেচনা করা যায়।
ভাটিকান সিটির এক অপ্রকাশিত নথি অনুসারে রোমান ক্যাথলিক চার্চ যৌন রূপান্তর আদৌ সম্ভব বলে মানে না, এমনকি অপারেশন করে রূপান্তর ঘটানোর পরেও।[19] চার্চ একদমই এই রূপান্তর সমর্থন করে না এবং এই জাতীয় প্রক্রিয়াকে বিকৃতকরণ ("mutilation") ও অনৈতিক মনে করে।[20] একমাত্র লিঙ্গ পরিবর্তন না করে যদি যৌন সমস্যার চিকিৎসা করা হয়, তাহলে ভাটিকানের মত আছে।
রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে যুক্ত এক মনোবিদ পল আর. ম্যাকহউ (Paul R. McHugh) নিজের রচনায় প্রকাশ করেছেন,[21] Johns Hopkins University-র সাইকিয়াট্রি ও বিহেভিয়রাল সায়েন্স বিভাগে ডাইরেক্টর হিসাবে যোগদানের সময় সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট থেরাপির অবসান ঘটানোটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।[22] অনেক নারীবাদী লেখিকা ও লেখকরাও এর বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই জাতীয় চিকিৎসা সহায়তা বন্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন বলে লেখিকা জেনিস রেমন্ড (Janice Raymond)-কে অভিযোগ করা হয়।[23] সমকামী পুরুষরা নারীরূপ লাভ করে পুরুষের রেতঃমোচনে এমন বিকৃত আচরণ করে যা নারীর পক্ষে অত্যন্ত মর্যাদাহানিকর। যেসব দুঃসাহসী লেখিকা সাহসিকতার পরিচয় রাখতে পুরুষভজনায় লিপ্ত, তারা যদি নিজেদের ফেমিনিস্ট বলে দাবি করেও থাকে তাহলে তা হাস্যকর। সুতরাং প্রকৃত নারীবাদীদের পক্ষ থেকে এই ধরনের আপত্তি উঠে আসা আশ্চর্যের নয়। তাছাড়া এমন শখের খরচ সাপেক্ষ চিকিৎসা বেশির ভাগ সরকারি বা বেসরকারি চিকিৎসা বীমার আওতায় পড়ে না।
কানাডার কিছু প্রদেশে ও অধিকাংশ ইয়োরোপীয় দেশে SRT-এর জন্য বীমার ব্যবস্থা আছে কিন্তু তার শর্তাবলী আমেরিকার WPATH Standards of Care for the Health of Transsexual, Transgender, and Gender Nonconforming People-এর চেয়েও কঠোর। অন্যদিকে ইরান সরকার লিঙ্গ পরিবর্তন চিকিৎসার জন্য সহায়তা দেয় কারণ তার সাথে নাকি শরিয়তি বিশ্বাসের (Shi'ite Belief) বিরোধ নেই।[24]
এই দিক দিয়ে বিভিন্ন প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্র বলে পরিচিত গ্রন্থ যেমন ‘কামশাস্ত্র’ বা অনুগামী জয়মঙ্গলের রচনা ইত্যাদি পুরুষের রেতঃমোচনের জন্য সম্ভাব্য সবরকম উপায়ের আয়োজন ও সমর্থনে এত বিশদ বিবরণ দিয়েছে, যে গোটা পৃথিবী লিঙ্গ-বিকৃতির স্বীকৃতি খুঁজতে ভারতীয় পর্নোগ্রাফির দিকে তাকাচ্ছে। কামশাস্ত্র ছাড়াও পুরুষের প্রতি পুরুষের প্রেম ও যৌন আকর্ষণে ঐশ্বরিক মহিমা আরোপ করে একাধিক ভারতীয় সাহিত্য আছে। কৃষ্ণপ্রেম তো সমকামী ব্যভিচারের অন্যতম আবডাল। তৃতীয় প্রকৃতির অস্তিত্ব স্বীকারকেও সমকামিতা বা রূপান্তরকামিতার সমর্থন হিসাবে দেখানো হয়। এমনকি মানুষ থেকে গরু ভেড়া পাথর হয়ে যাওয়ার নিতান্ত রূপকথার মতো পৌরাণিক উপাখ্যানে যদি পুরুষ থেকে নারী বা নারীর পুরুষ হয়ে যাওয়ার মতো কল্পকাহিনী থাকে, তাকেও সমকামিতার না রূপান্তরকামিতার সমর্থনে উত্থাপন করা হয়ে থাকে।
বস্তুত এই জাতীয় চিকিৎসা কতটা জন্মগত সমস্যা সমাধানের জন্য জরুরি, আর কতটা লিঙ্গ বিকৃতি মেটানোর জন্য এমনকি দেহ ব্যবসার তাগিদে, তা নির্ণয় করা খুব মুশকিল। আমাদের দেশের হিজড়ে পেশার মতো থাইল্যান্ডে নারী রূপী পুরুষদের যৌন ব্যবসা বিশ্ববিখ্যাত। ওখানকার মেয়েদের তাই দেহব্যবসায় রীতি মতো প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হয়। অথচ কোনও নারী দেহোপসরিণী যদি দেখা যায় অক্ষতযোনি, তাহলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সে তো পুরুষের সুখের জন্য, সেই সুখ দিতে গিয়ে তার সামান্যতম সুখলাভ হোক তা অনেক পুরুষ খরিদ্দারেরই পছন্দ নয়। বিশদে আর গেলাম না। দেহ ব্যবসার জন্য স্ত্রী রূপ ধারণ করলে আর যাই হোক স্ত্রী জাতির সম্মান বাড়ে না। সুতরাং LGBT গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকরা যাই বলুক নৈতিক ছুৎমার্গটা থাকবেই, এবং সঙ্গত ভাবেই থাকবে।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে LGBT ছাপিয়ে যখন যার যা বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর লিঙ্গ পরিচয় অনুমোদন করা হয়েছে। এই উদারতার জোয়ারে ক্রীড়াজগতের অনেক ব্যর্থ পুরুষ ক্রীড়াবিদ লিঙ্গান্তরণ ঘটিয়ে নারী ক্রিড়াবিদ হিসাবে অংশগ্রহণের অধিকার চাইছে এবং পেয়েও যাচ্ছে। বলা বাহুল্য সারাজীবন নারী শরীরের নানাবিধ বিড়ম্বনা ভোগ ছাড়া ও পুরুষ হিসাবে শারীরিক ও সামাজিক সুবিধাভোগ করার পর ট্রান্স-মহিলাদের মহিলা হিসবে নথিভুক্তি বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছে। এই রূপান্তরিত নারীদের সঙ্গে ঋতুর উৎপাত, কম হিোগ্লোবিন ও অস্থিপেশি সংগঠনে প্রাকৃতিকভাবে পিছিয়ে থাকা প্রকৃত মেয়েরা শারীরিক সক্ষমতায় পেরে উঠছে না।
মহিলা খেলোয়াড়রা তাতে আপত্তি করলে তাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অথচ কোনও নারীর শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা গড়পড়তা নারীর তুলনায় একটু বেশি হলে তাকে নারীদদের ইভেন্টে বরখাস্ত করা হচ্ছে। কালো মেয়েদের দেহে স্বাভাবিকভাবেই টেস্টোস্টেরনের মাত্রা অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে বেশি বলে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে বেশি। অথচ পুরুষরা শরীরে মেয়েদের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই ১৫ গুণ টেস্টোস্টেরন বহনের অতিরিক্ত শক্তি ভোগ করে হঠাৎ কিছুদিন স্ত্রী হরমোন নিয়ে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা একটা সীমার মধ্যে রেখে নিজেদের সুবিধামতো নারী ঘোষণা করিয়ে নারী রূপে প্রতিযোগিতায় নামছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, লিঙ্গ-পুনর্বিন্যাসের জন্য আজকাল যৌনাঙ্গের অস্ত্রপচার করানোটাও জরুরি নয়। মানে পুরুষাঙ্গ নিয়েই পুরুষরা নারী পরিচয়ে নারীদের ক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই মোটের ওপর ট্রান্স নারী বা ছদ্মবেশী পুরুষ দ্বারা প্রকৃত নারীদের প্রতিস্থাপনের সুচতুর প্রক্রিয়া চলেছে।
২০২০-র টোকিও অলিম্পিকে ভারোত্তলক লরেল হাভার্ড (Laurel Hubbard) প্রথম নারী না হয়েও নারী ট্রান্স-উওম্যান হওয়ার সৌজন্যে মেয়েদের বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু ভার তুলতে না পারায় কোনও পদক জেনেনি।[25] তাই তেমন হৈচৈ হয়নি। আরও অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু চোখ খুলে যেতে বিতর্ক সৃষ্টি হয় এক পুরুষ সাঁতারুর লিঙ্গ-পরিচয় পাল্টে মেয়েদের সাঁতারে একচেটিয়া সাফল্যের পর।
২০১৮-য় পরপর কয়েকটি ইভেন্টে দ্বিতীয় হওয়ার পর উপলব্ধি করেন, তিনি আসলে মানসিকভাবে পুরুষ নন, নারী। তারপর লিঙ্গ-পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে তিনি রূপান্তরিত-নারী রূপে সাঁতারের পুলে একচেটিয়া সাফল্য পাচ্ছেন। এই নিয়ে মহিলা সাঁতারুরা প্রতিবাদ জানালে National Collegiate Athletic Association (NCAA) তাঁদেরই ভর্ৎসনা ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে লি্যা টমাসের সঙ্গে অন্যান্য ট্রান্স-নারীদের জন্য দরজা খুলে দিল। ২০২২-এ প্রবল তর্কাতর্কির পরে ২০২৪-এ প্যারিস অলিম্পিকেও যোগদানের সুযোগ পান এই নারী পরিচয়প্রাপ্ত পুরুষ অ্যাথলিট। লিয়া টমাস এখন বিতর্কিত নন, বরং ট্রান্স জেন্ডার অ্যাথলিটদের একটি ব্র্যান্ড।[26]
নিখি হিলট্জ় (Nikhi Hiltz) নামের এক নারী পরিচয়প্রাপ্ত পুরুষ অ্যাথলিট ২০২৪-এর প্যারিস অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে রীতিমতো লৈঙ্গিকভাবে প্রান্তিক মানে LGBT অধিকার রক্ষার প্রতিভূ বনে গেছেন।[27]
এভাবে চললে ক্রীড়াজগতে প্রকৃত নারী ক্রিড়াবিদ দুর্লভ হয়ে যাবে। টেক্সাসের লিয়া টমাস (Lia Thomas) পুরুষ হিসাবে পাঁচ বছর বয়স থেকে সাঁতার শিখছে ও প্রতিযোগিতায় নামছে।
বলা বাহুল্য ট্রান্স-ম্যান বা নারী থেকে পুরুষ হওয়া মানুষগুলো কখনোই এই সুযোগসন্ধান করে না, কারণ শারীরিকভাবে করলে ক্ষতিই। তাই পরুষরা নারীবাদী আন্দোলনের মাঝে এলজিবিটি আন্দোলনের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মেয়েদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতার পরিসরটুকুতেও থাকতে দেবে না।
এই নিয়ে বেশি বিশদে এখানে যাচ্ছি না। শুধু উল্লেখ্য, ক্রীড়াক্ষেত্রে এই দ্বিচারিতার সঙ্গে ওদেশের সমাজ ও শিক্ষা ক্ষেত্রেরও বেশ সাযুজ্য। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদেরও যেখানে যৌনশিক্ষা দেওয়া হয়, সেখানে মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকার নেই,[28] যাতে তারা গর্ভধারণ এড়াতে শুধু পুরুষের তৃপ্তিবিধানে বাধ্য থাকে। চমৎকার লিঙ্গবিপ্লব!
নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে হতাশা বা আপত্তি থাকলেই কারও জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া আছে বলে ধরে নেওয়া যায় না। নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি বহু ভারতীয় মহিলাই মেয়ে জন্মে সুখ নেই বলে পরজন্মে পুরুষ জীবন কামনা করেন ও সে কথা বলেনও। এইসব মহিলারা কিন্তু প্রচণ্ড পুরুষ প্রাধান্যে ও নারীর জন্য সমাজনির্ধারিত বিধিনিষেধে বিশ্বাসী এবং ভীষণরকম নারীবিদ্বেষী। চীনের মেয়েরা জন্মান্তরে বিশ্বাস করে কি না জানি না, তবে ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিকতার বলি হয়ে মায়েরা নিজের শিশু কন্যাকে হত্যা করতে পর্যন্ত পিছপা হয় না বা পারিবারিক চাপে বাধ্য হয়। বলা বাহুল্য নারী জন্ম নারীর কাছে এত রকম অসুখ ও যন্ত্রণার কারণ, এত রকম অত্যাচার অপামানের ঝুঁকি, যে নিজের নারীত্ব নিয়ে অধিকাংশ নারী মোটেই খুশি নয়। কিন্তু এটাকে কি লিঙ্গ-পরিচয়গত বিরোধ Gender Nonconformity বা অতৃপ্তি Gender Dysphoria কোনোটাই বলা যাবে? কখনই না। যতক্ষণ না কোনও নারী তার মেয়েলি বৈশিষ্ট্যগুলোর বিরোধিতা করছে, বা পুরুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিজেদের পুরুষ ভাবছে না, বা মেয়েদের প্রতি পুরুষালি আকর্ষণ বোধ করছে না, ততক্ষণ তার লিঙ্গপরিচয়গত অতৃপ্তি বা Gender Dysphoria আছে বলা যায় না। নিজের লিঙ্গ পরিচয়ে সন্তুষ্ট না হওয়ার কারণ প্রায় সব দেশের মেয়েদেরই কিছু না কিছু থেকেই থাকে, তবু তারা স্বাভাবিকতার আওতায় প্রাকৃতিক অনুশাসনে মেয়েই থাকতে চায়। পুরুষদের কারও কারও মধ্যেও স্বজাতির কুকীর্তির কারণে আত্মধিক্কারে পুরুষত্বের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে পারে। তাতে যদি সে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল কোমল স্বভাবের হয় তাহলে মঙ্গলই। কিন্তু নিজেকে নারী ভাবতে শুরু করে পুরুষ যদি অন্য পুরুষের প্রতি সমকামী আকর্ষণ অনুভব করে, তবে তারা স্পষ্টত ডিস্ফোরিক এবং চিকিৎসাযোগ্য।
তথ্যসূত্র: