Photo by Ian Macharia on Unsplash
টগবগে পুরুষতন্ত্রে কতগুলো বিষয় তিনশো পঁয়ষট্টি দিন চব্বিশ ঘণ্টাই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু প্রতিনিয়ত সমানাধিকার, সমান পারিশ্রমিক, গার্হস্থ হিংসা প্রতিরোধ, যৌন নির্যাতন, নৃশংস খুন, নাবালক ধর্ষক, নাবালিকা ধর্ষিতা – ইত্যাদির আলোচনা ফাটা রেকর্ডের মতো বেজে চলেছে; কিন্তু যেটা সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক সমাধান তার কথা কারও মাথায় আসে না বা এলেও প্রতিক্রিয়ার ভয়ে প্রকাশ করে না। পণপ্রথার নিন্দা করা হয়, বধূনির্যাতন আটকাতে ৪৯৮ ধারার মতো আইন প্রণীত হয় যার অপপ্রয়োগ নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই, কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর বদলে জামাইবরণ করলেই যে বধূ নির্যাতন ও হত্যার সমাধান হয় – তা পুরুষ তো দূর অধিকাংশ শিক্ষিত কর্মরত মহিলাও মানতে চায় না; কারণ যুগ যুগ ধরে মূলস্রোতের সমাজে যেটা দেখে এসেছে সেটাই মানানসই, উল্টোটা বেমানান। তাই মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অস্তিত্ব নিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কিঞ্চিত অবিশ্বাস ও মস্করা দুটোই আছে। অনেকেরই অভিমত এর অস্তিত্ব একমাত্র ‘অ্যামাজন’-এর মতো কিংবদন্তী ও কল্পনাবিলাসে। তা আছে কি নেই সেই আলোচনায় প্রবেশের আগে এর সংজ্ঞা ও স্বরূপটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
সাদামাটা ভাষায় মাতৃতন্ত্র বলতে বুঝি সেই সামাজিক ব্যবস্থা যাতে মহিলারা প্রাথমিক ক্ষমতার অধিকারী। পারিবারিক সিদ্ধান্ত থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সমাজে নৈতিকতা নিরূপণের দায়িত্ব মূলত থাকবে মেয়েদের হাতে। সর্বোপরি বংশপরিচয় ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার বাহিত হয় নারী-অনুক্রমে, পুরুষানুক্রমে নয়। পরিবার প্রধান হয় মা বা গৃহকর্ত্রী। Oxford English Dictionary (OED) অনুযায়ী "Matriarchy is the form of social organization in which the mother or oldest female is the head of the family, and descent and relationship are reckoned through the female line; government or rule by a woman or women."[2] অর্থাৎ বংশ পরিচয় থেকে সমাজ শাসন সর্বত্র নারীই অগ্রণী। অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বে (cultural anthropology) মাতৃতন্ত্রের সংজ্ঞা হল, "culture or community in which such a system prevails" or a "family, society, organization, etc, dominated by a woman or women." [2]
নৃতত্ত্ব ও নারীবাদে আরও সূক্ষ্মতর সংজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি নারীপ্রধান সমাজগুলি প্রকৃতই মাতৃতান্ত্রিক কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্য নেই বা কম এমন যে কোনও সমাজকেই প্রায়শ মাতৃতান্ত্রিক বলে চিহ্নিত করা হয়। যেমন নৃতাত্ত্বিক পেগি রিভস্ সানডে (Peggy Reeves Sanday) উভয় লিঙ্গের সমানাধিকার আছে অ-পিতৃতান্ত্রিক যে কোনও সমাজকেই মাতৃতান্ত্রিক বলে সনাক্ত করেছেন[3], বিশেষ করে মিনংবাকাউ প্রজাতির উদাহরণ থেকে। কিন্তু অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মিনাংবাকাউ সমাজকে মাতৃতান্ত্রিক বলার পক্ষপাতী নন। অধিকাংশ নৃতাত্ত্বিকদের দাবি সম্পূর্ণভাবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের নিদর্শন কোথাও নেই; বরং দেখা যায় মাতৃবংশানুক্রমিক (matrilineal), মাতৃ অবস্থানকেন্দ্রিক (matrilocal) বা মাতৃকেন্দ্রিক (matrifocal) সমাজ[1]। এই শব্দগুলোর বাংলা পরিভাষা নিজেকেই তৈরি করতে হল যেহেতু কোনও সমাজে মেয়েদের সামান্য স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার বা একাধিক বিয়ের অনুমোদন থাকলেই বাংলায় নারীপ্রধান বা মাতৃতান্ত্রিক এই দুটি শব্দ প্রযুক্ত হয় এবং শব্দদুটিকে সমার্থক মনে করা হয়। নারী প্রধান্য ব্যাপারটা আমাদের অপছন্দের হলেও সেটা অনুধাবনে তেমন অসুবিধা নেই। তবে মাতৃতন্ত্রের সঙ্গে বাকি শব্দগুলির প্রভেদ বুঝতে তাদের সংজ্ঞা জানা জরুরি।
কিন্তু সেই সমস্ত নারীসুলভ পেশা যার জন্মই হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক কুপ্রভাবে, যেমন বেশ্যাবৃত্তি (prostitution or women's auxiliaries),তাদের সমাজকে কখনও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলা যাবে না[4]। মাতৃতন্ত্রের আবশ্যিক অনুষঙ্গ মেয়েদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা, যা পুরুষানুরঞ্জক যৌন পেশায় থাকতে পারে না।
সমাজ-নৃতাত্ত্বিক হেইডি গটনার অ্যাবেনড্রথ (Heide Göttner-Abendroth)[5] মনে করেন পিতৃতন্ত্রে পুরুষরা নারীর ওপর আধিপত্য চালায় বলেই মাতৃতন্ত্র মানে পুরুষের ওপর স্ত্রীর আধিপত্য – এই ভাবনাটা ঠিক নয়। তাঁর মতে মাতৃতন্ত্র হল অনেক সাম্যবাদী সমাজ যার ভিত্তি নারী পুরুষের সমানাধিকার। তাই বলে তুলনায় সাম্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর মাতৃতন্ত্রকে এক করে দেখাটাও ঠিক নয়। সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা সমাজ রাজনীতিতে নারীর নিয়ন্ত্রণ পুরুষ আধিপত্যের বিপ্রতীপ নয়, বরং একটা সমান্তরাল ব্যবস্থা। একই সুর আরও অনেকের বক্তব্যে।
বারবারা লাভ (Barbara Love) ও এলিজাবেথ শ্যাংকলিন (Elizabeth Shanklin) লিখেছেন, "by 'matriarchy,' we mean a non-alienated society: a society in which women, those who produce the next generation, define motherhood, determine the conditions of motherhood, and determine the environment in which the next generation is reared."[6] অর্থাৎ যে পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম দেবে, সেই মায়ের জাতই স্থির করবে মাতৃত্বের শর্ত ও অপত্য পালনের উপযুক্ত পরিবেশ। পিতৃতন্ত্রে মাতৃত্বকে যতই মহিমান্বিত করা হোক কার্যত তা পায়ের বেড়ি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মাতৃতন্ত্রে তা নয়। বরং মাতৃত্বকে স্বাভাবিক ভাবে স্বীকার ও বরণ করে নেওয়ার মধ্যেই সামাজিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত, কারণ মাতৃত্বলাভের জন্য যেটুকু যন্ত্রণা তা প্রকৃতি নির্ধারিত, সমাজ তথা পরিবার প্রদত্ত নয়, এবং সেই যন্ত্রণাও সৃষ্টি-গৌরবের।
সাংবাদিক মার্গট অল্ডার (Margot Alder) বলেছেন, মেয়েরা মূলস্রোতের সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী অবদমিত থাকায় কোথাও সামান্য ক্ষমতাভোগের সুযোগ পেলেই তাকে মাতৃতন্ত্র বলে দেখার প্রবণতা রয়েছে আমাদের। তিনি আবার সমাজবাদের (Socialism) মধ্যে মাতৃতন্ত্রের বীজ উপ্ত দেখেছেন। কারণ শ্রেণিহীন (classless) ও প্রাক্শ্রেণি (pre-class) সমাজে "where women and men share equally in production and power" সমানাধিকারের জায়গা অধিক প্রশস্থ্[7]। তবে ইতিহাস সাক্ষী, তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে মেয়েদের কখনও ক্ষমতার শিখরে দেখা যায়নি, তারা রয়ে গেছে কমিউনিজ়ম প্রচারে সহযোগী কিছু পদে। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালে কেরালার কমিউনিস্ট সরকার সি. অচ্যুতামেননের মুখ্যমন্ত্রীত্বে মাতৃবংশানুক্রম বিধানসভায় আইন করে অবৈধ ঘোষণা করে দেয়[26]। সুতরাং অল্ডারের এই সমীকরণ তাত্ত্বিক দিক দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য শোনালেও বাস্তবায়নের রূপকাররা পুরুষতান্ত্রিকতাতেই আচ্ছন্ন।
মাতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত পণ্ডিতেরও অভাব নেই। তাদের মতে পিতৃতন্ত্রই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী[8]। উনিশ শতকে ওয়েস্টার্ন স্কলারশিপের প্রকল্প (Western Scholarship’s hypothesis) অনুযায়ী প্রাগৈতিহাসিক আদিম পরিবার কেন্দ্রিক সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। এই ধারণা বিংশ শতকে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ (second-wave feminism) পর্যন্ত বলবৎ ছিল। বহু আধুনিক নারীবাদী সাহিত্য (feminist literature) মাতৃতন্ত্রকে সমাজের প্রয়োজন হিসেবে যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি নারী প্রাধান্যকে বিরূপ মন্তব্যও কম নয়। জেমস্ পিপলস্ ও গ্যারিক বেইলি James Peoples ও Garrick Bailey –এ ব্যবহার করেছেন নারী প্রাধান্য বা "female dominance" পদটি[9]। আমাদের পুরুষপ্রধান সমাজ পদে পদে নারী প্রাধান্যের অস্তিত্বকে কখনও প্রশ্ন ও বিদ্রূপ করেছে, কখনও বা তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে অরাজকতা স্বেচ্ছাচার থেকে ডাইনিবিদ্যা ইত্যাদি নানা ধরণের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য, বাস্তবের সঙ্গে যার কোনও মিল নেই।
আর অন্যদিকে নারীবাদীদের মধ্যে যেন প্রতি মুহূর্তে রয়েছে বুঝিয়ে দেওয়ার, কৈফিয়ত দেওয়ার তাগিদ – মাতৃতন্ত্র মানে পুরুষ পীড়ন নয়, শুধু সমানাধিকারের দাবি। The Matriarchal Studies school-এর প্রণেতা গটনার অ্যাবেনড্রথ (Göttner-Abendroth) অ-পুরুষতান্ত্রিক (non-patriarchal) সমাজ পর্যবেক্ষণ করে মাতৃতন্ত্রকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করেছেন “sharing of power equally between the two genders” বলে[10]। একই ব্যাখ্যা ডিয়েন লিবো (Diane LeBow)র, "matriarchal societies are often described as ... egalitarian ..."। পুরুষতন্ত্রের কাছে মাতৃতন্ত্র্রের হয়ে সাফাই দিতে গিয়ে নৃতাত্ত্বিক রুবি ররলিক (Ruby Rohrlich) আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, "the centrality of women in an egalitarian society." [11]
অথচ এই নারীকেন্দ্রিকতার মধ্যে নিন্দের তো কিছু নেই। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র (centre of gravity) যখনই পুরুষের দিকে ঝোঁকে নারী ও শিশুকে দমন পীড়ন বা অধিনস্থ করে রাখার প্রবণতা তখনই জন্ম নেয়। কিন্তু নারীর দিকে ঝুঁকে থাকলে পুরুষরাও সমানাধিকার ভোগ করে, শিশুগুলিও যত্নে নিরাপদে প্রতিপালিত হয়। “মাতৃতন্ত্র” (matriarchy) বলতে আক্ষরিক অর্থে যদি পিতৃতন্ত্রের (patriarchy) বিপরীতে একটি ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়, যার দ্বারা পুরুষের ওপর নারীর প্রধান্য, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ সূচীত করার কথা, তাহলে বাস্তবে ঠিক তেমন বিপরীত মেরুর সমাজ সত্যিই কোথাও পাওয়া যায় না। তাই মেয়েরা যেখানে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ভোগ করে, বিশেষত পরিবারের মাথা যদি মা হয়, তাহলে অনেকের পছন্দ মাতৃকেন্দ্রিক (matricentric বা matrifocal) শব্দটি। মজার ব্যাপার পুরুষ গবেষকদেরও অনেকে আবিষ্কার করেছেন, নারীশাসিত সমাজ অনেক লিঙ্গসাম্যবাদী যেখানে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই নিরাপদ থাকে, অথচ তেমন সমাজকে হয় ‘মাতৃতান্ত্রিক’ বলে মানতে নারাজ, নয়তো মাতৃতন্ত্রের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান। তাহলে কি নারী প্রধান্যে পুরুষ অবদমিত থাকলে তাঁরা মাতৃতন্ত্রের অস্তিত্ব স্বীকার করতেন, নাকি তেমন সমাজ সমর্থন করতেন, সমানাধিকারটাই যেখানে মেনে নিতে আমাদের এত অসুবিধা?
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী ১৮৮৫ সালে প্রথম matriarchy শব্দটা ব্যবহৃত হয়। মাতৃতন্ত্রকে গাইনার্কি (gynarchy), গাইনোক্রেসি (gynocracy), গাইনোকোক্রেসি (gynecocracy) বা গাইনোসেন্ট্রিক (gynocentric) এই শব্দগুলো দিয়েও বোঝানো হয় যাদের সাধারণ অর্থ নারী ও পুরুষের ওপর নারীর শাসন ('government by women over women and men')[12] [13]। এই নামকরণ রীতিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হল androcratic সমাজ। প্রসঙ্গত অ্যান্ড্রোজেন হরমোনটির প্রভাবেই পুরুষ মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বিকশিত হয়। অপরাধপ্রবণ নারীদের শরীরেও পুরুষ হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় সচরাচর বেশি হয় বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভিমত। অর্থাৎ নামকরণের মাধ্যমেও নিতান্ত অসচেতনভাবেই পুরুষ শাসিত সমাজ পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে অপরাধপ্রবণতার সম্পর্কটি স্বীকার করে ফেলেছে।
এখন কোথাও রানীর শাসন হলেই তাকে গাইনোক্রেসি বলা হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। যেমন রানী প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালকে (১৫৩৩-১৬০৩ খ্রীঃ)[14] অনেকেই গাইনোক্রেসি বা তাচ্ছিল্য করে ‘পেটিকোট গভর্নমেন্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাঁর মন্ত্রীসভা ও অন্যান্য রাজপদে পুরুষদেরই আধিপত্য এবং তিনি সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন একটি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে থেকেই, নারীতন্ত্র বা প্রকৃত নারীশাসন কিন্তু প্রতিষ্ঠা পায়নি। ঐতিহাসিক পওলা লুসি সালিংগি (Paula Louise Scalingi)-র মতে রানীর শাসনকালকে তাই গাইনোক্রেসি বলা যায় না[15]। পুরুষদের আনুগত্য ও অনুরাগের সহযোগিতায় রানীর ক্ষমতায়ন অনেকটা মক্ষীরানীর মতো (queen bee syndrome) যেখানে অন্যান্য মেয়েরা বিকশিত হতে পারে না, ঝাঁকের শ্রমিক মৌমাছি রয়ে যায়।
সাংবাদিক মার্গট অলডার (Margot Adler) সম্ভবত মাতৃতন্ত্রের সবচেয়ে ভালো তাত্ত্বিক সংজ্ঞা দিয়েছেন, “matriarchy is a realm where female things are valued and where power is exerted in non-possessive, non-controlling, and organic ways that are harmonious with nature."[16]। মাতৃতন্ত্র মানে নারীর আধিপত্য ও পুরুষের বশ্যতা নয়, এটি একটি সুস্থ ও প্রকৃতির সঙ্গে সু-অভিযোজী সমাজব্যবস্থার ধারণা।
পৃথিবীর ইতিহাসে হাতে গোনা কয়েকটি আংশিক নারী শাসিত বা নারীকেন্দ্রিক সমাজ ছিল বা আজও আছে। যদিও কোনটি বাস্তবে ছিল আর কোনটি অনুমান সেটা স্পষ্ট নয়, তবে তার মধ্যেই যে কয়েকটির হদিশ পেয়েছি, দিলাম। মূলত মাতৃবংশানুক্রম দ্বারাই এই সমাজগুলোকে সনাক্ত করা হয়েছে। সেগুলো প্রকৃতই মাতৃতান্ত্রিক কিনা তা বেশির ভাগ তা স্পষ্ট নয়।
ইওরোপের জার্মানিয়া (Germania)-তে নাকি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল – "the nations of the Sitones a woman is the ruling sex."। সিটোন জার্মানিয়ার অংশ। তাছাড়া অনেকের অনুমান আমাজনের কিংবদন্তীর উৎস দক্ষিণ আমেরিকা নয় ইওরোপ মহাদেশের ‘সিথিয়া’ যা বর্তমানে রাশিয়ার ভূখণ্ড। ঐতিহাসিকদের পর্যবেক্ষণ সারমাটিয়ান (Sarmatians) বা অধুনা ইউক্রেনীয়রাও আসলে আমাজনীয় নারী উপজাতি (Amazonian women tribe)। রাহুল সাংকৃত্যায়ন সম্ভবত তাঁর “ভোলগা থেকে গঙ্গা” বইতে যে ভোলগা তীরবর্তী আদিম মাতৃতান্ত্রিক পরিবারকেন্দ্রিক সমাজের ছবি এঁকেছেন তার ঐতিহাসিক সূত্র এখানেই পেয়েছেন।
দেবীমূর্তি দেখে The Cambridge Ancient History (1975) সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে প্রাচীন প্রাচ্যে হয়তো বা মাতৃতন্ত্র ছিল – "the predominance of a supreme goddess is probably a reflection from the practice of matriarchy which at all times characterized Elamite civilization to a greater or lesser degree")। খুব অস্পষ্ট কথা। প্রাচ্য বলতে পূর্ব এশিয়া ছাড়াও মধ্য প্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়ার কথা বলা হয়েছে কিনা তা এই উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট নয়।
বিস্ময়করভাবে আজ এশীয় দেশগুলো যেখানে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের জন্মভূমি হয়ে নারী নিগ্রহের অন্যতম পীঠস্থান, সেই এশিয়ার একাধিক দেশে সমাজ ছিল নারীকেন্দ্রিক।
ব্রহ্মদেশ বা অধুনা মায়ানমারে মাতৃতন্ত্র নিছক অনুমান নয়, উনবিংশ শতাব্দীতেও দেখা গেছে। জর্জেন বিশ (Jorgen Bisch)-এর মতে পাডং (Padaungs) এবং অ্যান্ড্রিউ মার্শাল (Andrew Marshall)-এর মতে ‘কায়াও’ (Kayaw) সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। এই মেয়েরা আবার কুঁড়ের বাদশা পুরুষ নিয়ে ঘর করত। ব্রহ্মদেশ মানেই যে নারী পরিচালিত সমাজ তা কিন্তু নয়। গলার বাহ্যিক সৌন্দর্যায়নের জন্য ধাতব কড়া পরিয়ে লম্বা করা আর যাই হোক নারীর স্বাধীনতা সূচক নয়।
যে চিন আজকে কন্যাশিশু হত্যা গৃহবধূ নিগ্রহে ভারতকে টেক্কা দেয়, সেই চিনের ‘মসুও’ (Mosuo) সংস্কৃতিকে মাতৃতান্ত্রিক মনে করা হয়। ‘স্বামী’ তো দূর ‘পিতা’ জাতীয় শব্দও মসুও অভিধানে নেই। মেয়েরা বিয়ে করে না, নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে ইচ্ছামতো প্রেমিক বাছাই করে গোপন সান্ধ্য অভিসারে আমন্ত্রণ জানায় বা নিজেরা পছন্দের পুরুষটির কাছে চলে যায়। বিয়ের বালাই নেই, এমনকি যুগ্ম সহবাসেরও তেমন চল নেই। মসুও সমাজে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের পদ্ধতিকে “walking marriages" বলেও আখ্যায়িত করা হয়। চিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে তিব্বতের কাছাকাছি লুগু হ্রদের (Lugu Lake) কিনারে ইউনান ও সিচুয়ান প্রদেশে (Yunnan and Sichuan provinces)৪০,০০ জনসংখ্যার ছোট্ট নারী সাম্রাজ্য। ‘মসুও’রা নিজেরাও তেমনটাই প্রচার করে; এতে করে নাকি পর্যটন শিল্প প্লাবিত হয়। সত্যিই তো, কী বিদঘূটে ব্যাপার, কৌতুহল নিরসন করতে ছোট। পর্যটকরা তো সেলুলার জেল, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, লম্বা গলার মেয়ে – যেখানে যা ‘দর্শনীয়’ সব গেলে। ‘মসুও’ সমাজে কিন্তু মা বা নারীর প্রাধান্য শুধুমাত্র পরিবারে অর্থাৎ সম্পত্তির উত্তরাধিকার, পরিবার প্রধানের পদ বা পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই জাতীয় বিষয়ে; রাজনৈতিক ক্ষমতা পুরুষদের হাতেই। সুতরাং সংজ্ঞা অনুযায়ী মাতৃতান্ত্রিক নয়। তবে পরিবারের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকে মেয়েদের হাতে। সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। আর এই কারণে বিদেশি পর্যটকরা ধরেই নিয়েছে মসুও রমনীরা ফোকটে বা কম পয়সায় যৌনতার জন্য সুলভ। মাঝখান থেকে একদা কিছুটা বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলটি ভরে উঠেছে হোটেল, ক্যাসিনো এমন কী নিষিদ্ধপল্লীতেও! অর্থাৎ মাতৃকেন্দ্রিকতার গোড়ায় কুঠারাঘাত।
দিক্বিজয়ী সিকন্দরকে বিস্মিত করা এই দেশ ইদানিং গণধর্ষণের সংখ্যা ও পদ্ধতিগত ভয়াবহতায় সারা বিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত। সেই দেশে মাতৃতন্ত্র ইয়ার্কি নয়।
মণিপুরের উপজাতি সমাজ নাকি মাতৃতান্ত্রিক বা অন্তত মাতৃবংশানুক্রমিক (matrilineal)। প্রচলিত এই বিশ্বাস আবার অনেক নৃতাত্ত্বিক খারিজ করে দিয়েছেন। সেখানেও পরিবারে প্রাধান্য ও সম্পত্তির সুরক্ষা ছাড়া মেয়েরা রাজনৈতিক ক্ষমতা বা সমাজ পরিচালনার অধিকার মোটেই ভোগ করে না। এর ঐতিহাসিক কারণ হল মণিপুর রাজ্যের সুরক্ষা ও প্রসারণের জন্য রাজবংশের তথা অন্যান্য পুরুষরা লাগাতার যুদ্ধ ও সীমা সংঘর্ষে লিপ্ত থাকত। আর সেজন্যই বাড়ির ভেতরটার দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব মেয়েদের ভাগে পড়ে। তা যুদ্ধ তো সারা ভারতবর্ষ এমনকি সারা বিশ্বজুড়েই করছে পুরুষরা কারণে অকারণে, তবু নারী ঘরকন্নার দায়িত্ব পেলেও কর্তৃত্ব কোথায় পায়? বরং যুদ্ধের বা মামুলি গোষ্ঠী সংঘর্ষের জেরেও বারবার লাঞ্ছিত রক্তাত্ত হয়। তাই বেপরোয়া পুরুষতন্ত্রের চেয়ে এটা মন্দের ভালো। পাশের রাজ্য ত্রিপুরাতেই জনজাতির পুরুষরা বাঙালি বিদ্বেষের রোমহর্ষক প্রকাশ ঘটিয়েছিল বাঙালি মেয়েদের জননাঙ্গে অস্ত্র প্রবেশ করিয়ে, গর্ভবতীদের পেট চিরে। মণিপুরেরও বর্তমান বাস্তব হল, বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনে ‘মনোরমা দেবী’রা যখন তখন সেনা বা আধাসেনার হিংস্র লালসার শিকার হয়, শর্মিলা চানুকে প্রায় দুই দশক অনশনে থাকতে হয়। সুতরাং এই মাতৃপ্রধান্য যে কতটা ভঙ্গুর ইতিহাস তার দৈনিক সাক্ষী।
মেঘালয় ইত্যাদির মাতৃপ্রধান সমাজ সম্পর্কেও একই কথা খাটে। মেঘালয়ের উপজাতি যেমন গারো খাসি জয়ন্তীয়া ইত্যাদি সমাজে মায়ের বংশধারা অনুযায়ী নারী পরম্পরায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার বাহিত হয়। বাড়ির সর্ব কণিষ্ঠ কন্যাই সধারণত সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় ও মা-বাবা দাদু দিদা ভাই বোন সহ গোটা পরিবারের দেখভালের দায়িত্বও তাকেই সামলাতে হয়। ভারতের অঙ্গরাজ্য হলেও এদের ভাষাকে ভাষাবিদরা টিবেটো বর্মন (Tibeto-Burman) বলে অভিহিত করেছেন। বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে সাধারণত সম্বন্ধ করে স্থির হয়। কিন্তু যে মেয়েরা সম্পত্তির সরাসরি উত্তরাধিকারী নয় তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ জটিল। গারো সম্প্রদায়ের এই দিদিকুলের বিয়ের আয়োজন বেশ মজার। হবু বরকে বিয়ের প্রস্তাব শুনে পালাতে হবে। কনের বাড়ির লোকজন তাকে পাকড়াও করে নিজেদের গ্রামে নিয়ে আসবে। এই ধারাধরির খেলা ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ না কনে পক্ষ ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়, কিংবা বর বাবাজীবন পাত্রীর কাছে সেবা ও আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি আদায়ের পর রাজি হয়। মানে এখানেও স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য ও সেবাই সমাজের আদর্শ ও চিরাচরিত চাহিদা। তবে বিয়ের পর যেহেতু ছেলেরা মেয়ের বাড়ি গিয়ে সংসার করে, তাই মেয়েদের সুরক্ষা বিঘ্নিত হয় না। না পোষালে ছাড়ান কাটান নিয়ে কোনও সংস্কার নেই যেহেতু বিয়েটা বাধ্যতামূলক চুক্তি নয়। অর্থাৎ কাউকেই অবাঞ্ছিত সম্পর্কের জুলুমবাজি সহ্য করতে হয় না।
ভারতে অন্তর্ভুক্তির পর থেকে বৃহত্তর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আবেশে সেখানকার পুরুষদের মধ্যে স্ত্রীর বাড়িতে নারী শাসিত থাকা নিয়ে চাপা অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। আদিবাসী উন্নয়ন আধিকারিকরা নিজেদের বিশ্বাস ও পছন্দমতো সরকারি সুবিধা দানের শর্ত হিসেবে গারো সমাজের চিরাচরিত মাতৃ পরিচয়ের ঐতিহ্য ছেড়ে পিতৃপরিচয় নিতে বাধ্য করছে। এতে করে মেঘালয় সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক জনজাতির পুরুষদের মধ্যে নারীর অভিভাবকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ও হতাশা জন্ম নিচ্ছে যার প্রতিক্রিয়ায় তাদের মধ্যে মাদকাসক্তি প্রবলতর হচ্ছে। যদিও পুরুষ নিগ্রহের ঘটনা, মানে ভারতের অন্যত্র নারী নির্যাতনের যা রূপ, তেমন কিছুই কখনও ঘটে না; তবু অবদমিত পুরুষরা গোপনে সভা সমিতি গড়ে তুলছে। হয়তো গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারতীয় সেনা ও আধাসেনা মাঝে মধ্যেই যে লাগামছাড়া তাণ্ডব চালায়, তার ফলে মেয়েদের ধর্ষণ অবমাননা ও অত্যাচার করাটা পুরুষালি অধিকার হিসেবে দেখতে শুরু করেছে এই সব মাতৃকেন্দ্রিক সমাজের পুরুষরাও। সম্ভবত সেই দিন বেশি দূরে নেই যেদিন ধর্ষণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত বলে সেখানকার পুরুষরা ‘নির্যাতিত পুরুষ’ সংগঠন খুলে বসবে।
অন্যদিকে মাতৃকেন্দ্রিক পরিবারে সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব মেয়েদেরই সামলাতে হয় বলে পুরুষরা সংসারে শ্রম দিলেও অনেকটাই ঝাড়া হাত-পা, আর মেয়েদের অবস্থা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। দায় দায়িত্ব পরিশ্রম আর বরেদের নেশায় ক্লান্ত গারো মেয়েদের কেউ কেউ আবার নদীর ওপার নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, যেন মূলস্রোতের ভারতীয় পিতৃতন্ত্রে মেয়েরা কিছুটা হাল্কা থাকতে পায়।
কেরালায় ভারতের নারী-পুরুষের অনুপাত (sex ratio) সবচেয়ে ভালো। এর জন্য আপাতভাবে উচ্চ সাক্ষরতার হার দায়ী মনে হলেও কেরালার মাতৃকেন্দ্রিক ঐতিহ্যের অবদানও কম নয়, যদিও এই মাতৃবংশানুক্রম ক্রমশ পিতৃতান্ত্রিক চাপে অবলুপ্তির দিকে। মূলত ‘নায়ার’ (Nayre) গোষ্ঠীর মধ্যে মায়ের অধীনে যৌথ পরিবারে দেখা গেলেও মাতৃবংশানুক্রমিক ব্যবস্থা পূরাতন কেরালার প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিল মনে করা হয়। ১৮৯১-এর জনগণনা অনুযায়ী ৫ লক্ষ ৩০ হাজার পরিবারের মধ্যে ৫৬% ছিল মাতৃবংশানুক্রমিক (matrilineal) ও ৪৪% ছিল পিতৃবংশানুক্রমিক (patrilineal)। কিন্তু বর্তমানে মাতৃবংশ পরিচয় বহনের অস্তিত্ব প্রায় নেইই। তার কারণ নিজস্ব কয়েকটি মাতৃকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর তুলনায় ভৌগোলিকভাবে কেরালার বেশিটাই প্রখর পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি দ্বারা ঘিরে রয়েছে, যেগুলো মাতৃকেন্দ্রিক সমাজগুলিকে খেয়ে ফেলেছে।
তাছাড়া এই মাতৃবংশানুক্রমটা আদৌ নারী নির্ধারিত ছিল না। যুদ্ধ বিগ্রহে মত্ত পুরুষরা সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারীদের সুরক্ষিত করতেই এই ব্যবস্থা চালু করে। বিয়ের পর নিজের মায়ের বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মেয়েদের নিজেদের নয়, পরিবার ও আরও স্পষ্ট করে বললে পুরুষদের দ্বারা নির্ধারিত। সারা জীবন একই সঙ্গীর সঙ্গে দাম্পত্যের বাধ্যবাধকতা ছিল না ঠিকই, তবে কখন কোন সম্পর্ক শেষ হবে এবং নতুন সম্পর্ক কার সঙ্গে শুরু হবে সেটাও পিতৃতান্ত্রিক স্বার্থেই নির্ধারিত হোত। উচ্চবর্ণের ‘নাম্বুদিরি’রা চিরাচরিত পিতৃতন্ত্র অনুসরণ করলেও নায়ারদের মায়ের দায়িত্বে যৌথ পরিবার ব্যবস্থার সুযোগ নিত। তাদের প্রথম পুত্রটি নিজেদের সম্প্রদায়ে বিয়ে করে ঘরে যৌতুকসহ বৌ আনলেও বাকি ভাইরা অনেকেই নায়ার মহিলাদের বিয়ে করত যাতে ভবিষ্যতে সন্তানের দায়িত্ব নিতে না হয় এবং সুযোগ বুঝে সম্পর্ক চুকিয়ে দায়মুক্ত হতে পারে। অন্যদিকে নাম্বুদিরি পরিবারের মেয়েরা পাল্টি ঘরের অভাবে অবিবাহিতা থেকে যেত। অনেক সময় নিম্মবর্ণের মহিলাদের বাধ্য করা হোত নিজেদের বরকে ত্যাগ করে উচ্চবর্ণ পুরুষের ঘরণী হতে। সুতরাং তলিয়ে অনুসন্ধান করলে মাতৃবংশানুক্রমিক যৌথ পরিবারে মেয়েরা অর্থনৈতিক সুরক্ষা ভোগ করলেও মাতৃকেন্দ্রিকতা ছিল নেহাতই প্রতীকি। [International Women’s Day 2017: Kerala and myth of matriarchy bu Gita aravumudan]
শিক্ষার হারে ভারতের গর্ব এই রাজ্যটি কিন্তু সাম্যবাদী সরকারের শাসনকালে নারী প্রধান্যের এইটুকু প্রতীকও আইন করে মুছে ফেলে। মাতৃবংশানুক্রমিক তথা মাতৃ অবস্থানকেন্দ্রিক (matrilineal/matrilocal) পারিবারিক ব্যবস্থা কেরালা বিধানসভা ১৯৭৫ সালে Joint Family System (Abolition) Act, 1975 দ্বারা আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কেরালার রমনীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ার পুরস্কার স্বরূপ কেরালীয় নারীদের ব্যক্তি স্বাধীনতাই আইন করে খর্ব করা হয়েছে।
তারপরেও দেখা যায় মেঘালয়ের তুলনায় কেরালায় মহিলাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বেশি হয়েছে। লোকসভার চেয়ে বিধানসভায় কেরলীয় নারীর প্রতিনিধিত্ব বেশি। তবে সব মিলিয়ে এখানেও মহিলারা রাজনীতিতে সংখ্যালঘু। আম্মু জোশেফ (Ammu Joseph) নামে সাংবাদিক অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তালিমনাডু, কেরালা ও মহারাষ্ট্র – এই পাঁচটি রাজ্যে মেয়েদের মধ্যে গণমাধ্যমের ভিত্তি (Media Foundation amongst women) সমীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন মালয়ালম মিডিয়ায় সাংবাদিকদের মাত্র ১% নারী। এই তথ্যটি যদিও কয়েক দশকের পুরোনো, তবে চিত্রটার নাটকীয় পরিবর্তন যে ঘটেনি তা উত্তোরোত্তর নারী নির্যাতনের আবহে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। অবশ্য যেসব রাজ্যে রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য সেইসব রাজ্যের তুলনায় কেরালায় এখনও নারীশিক্ষা (female literacy)ও সর্বশিক্ষার (general literacy) হার এবং লিঙ্গানুপাত (sex ratio) সবকটাই উন্নততর।
দাক্ষিণাত্যে কর্নাটক রাজ্যের কন্নড় জেলাতেও নাকি মাতৃবংশধারার হদিশ পাওয়া গেছে। কিন্ত মায়ের প্রাধান্য ঐ জন্মদান ও পরিবার সৃজনেই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া বরপণের ব্যাপকতা ও প্রাবল্য অন্য কথা বলে। ভারতবর্ষে সনাতন বিশ্বাসে প্রকৃতি ও পৃথিবীকে মা কল্পনা করা হলেও তাতে মিশেছে ‘বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা’-র হিংসাত্মক ভেজাল। তাই যতই দেশমাতৃকা, শক্তিপুজো, প্রকৃতির উপাসনা করা হোক সেগুলো মেয়ে ভোলানো লজেঞ্জচুষ রয়ে গেছে, বাস্তবে তার প্রবল বৈপরীত্য।
নৃতাত্ত্বিক Peggy Reeves Sanday -এর অনুমান মিনাংকাবাউ (Minangkabau) সমাজে বংশ পরিচয়, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি মা থেকে কন্যা পরম্পরায় বাহিত। আনুমানিক ৪০ লক্ষ জনসংখ্যার এই জাতি সমাজ ও পরিবারে মায়ের ভূমিকাকে খুবই বড়ো করে দেখে। তবে এখানেও মা বা মেয়েদের ভূমিকা সাধারণত পরিবার প্রধানের; রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব পুরুষদেরই হাতে। অবশ্য বিবাহ, বিচ্ছেদ এইসব ব্যাপারে নারী-পুরুষ সমানাধিকার ভোগ করে। বিয়েতে মেয়েরা শয়নগৃহ লাভ করে। বরেরা সেখানে শোবার অনুমতি পেলেও সকালে উঠে তাদের চা জলখাবারের জন্য মায়ের বাড়িতে যেতে হয়। মাত্র ১০ বছর বয়সেই ছেলেরা মায়ের বাড়ি ছেড়ে পুরুষদের আবাসনে গিয়ে সংসার ও সমাজ জীবনে ব্যবহারিক দক্ষতা ও ধর্মীয় শিক্ষার তালিম নিতে শুরু করে। গোষ্ঠীপতি পুরুষরাই হয়, তবে নারীরা তাদের অযোগ্য মনে করলে পদচ্যুত করতে পারে। তলিয়ে দেখলে মাতৃকেন্দ্রিক নয় পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতেই মেয়েদের পারিবারিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও ক্ষমতা রয়েছে।
নৃতত্ত্ববিদ্ উইলিয়াম এস. টার্লি (William S. Turley) বলেছেন, “the role of women in traditional Vietnamese culture was determined [partly] by ... indigenous customs bearing traces of matriarchy”. সমাজবিজ্ঞানী পিটার সি ফান (Peter C. Phan) জানাচ্ছেন, "the first three persons leading insurrections against China were women ... suggest[s] ... that ancient Vietnam was a matriarchal society"। অর্থাৎ চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী ভিয়েতনামি সমাজ মাতৃতান্ত্রিক যেখানে মেয়েরা শুধু পরিবার নয়, গোষ্ঠীও শাসন করত বলে অনুমান। পিতৃতন্ত্রের সূচনা চিনা আগ্রাসনের হাত ধরে, যদিও এই পিতৃতন্ত্র ভিয়েতনামি পরিবারে মেয়েদের সম্মান ও অবস্থান পুরোপুরি ধূলিস্যাৎ করতে পারেনি, বিশেষ করে কৃষক ও নিন্ম বর্গের মধ্যে। সমাজবিদ চিরিস্কোটা (Chiricosta)-র বক্তব্য, "the presence of an original 'matriarchy' in North Vietnam and [it] led to the double kinship system, which developed there .... [and which] combined matrilineal and patrilineal patterns of family structure and assigned equal importance to both lines." অর্থাৎ তথাকথিত মাতৃতন্ত্রে কোথাও পুরুষ অবদমনের নজির নেই, আছে উভয় লিঙ্গের সমানাধিকার। চিরিস্কোটা আরও বলেছেন, “this 'matriarchal' aspect of the myth to differentiate Vietnamese society from the pervasive spread of Chinese Confucian patriarchy”।
ভিয়েতনামের ওপর চিনা আগ্রাসনে প্রবল বাধা আসে মহিলাদের তরফ থেকেই। দেশটার স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধ যেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লিঙ্গ সাম্যের অভিযানও ছিল। কীথ ওয়েলার টেলার (Keith Weller Taylor)-এর মতে ট্রাং (Trung Trac') ভগ্নীদ্বয়ের কাহিনী, তাদের মায়ের সমাধি যেখানে বাবার কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই, মাতৃতন্ত্রের খুব জোরালো প্রমাণ। ট্রাং ট্র্যাক (Trưng Trắc) ও তার ছোট বোন ট্রাং নি (Trưng Nhị) দুজনে মিলে একটা সেনাবাহিনী তৈরি করেছিল যার সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার এবং সাধারণ সৈনিক থেকে সেনাধিকারিক সব রকম পদেই মেয়েদের আসীন থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর এই নারী পরিচালিত বাহিনীই প্রবল পরাক্রমী চিনা শক্তিকে হারিয়ে দিয়েছিল। ৪০ সালে ট্রাং ট্র্যাক রানী হওয়ার পর নতুন রাজধানী গড়া হয়। আধুনিক ভিয়েতনামীদের চোখে ট্রাং ভগ্নীরা কিংবদন্তী বীরাঙ্গনা।
আমেরিকা বলতে সাধারণত যে দেশটার কথা বুঝি তা ভয়ানক রকম পুরুষ পক্ষপাতী (Male Chauvinist) হলেও এই মহাদেশেই মিলেছে আদর্শ মাতৃতন্ত্রের প্রমাণ।
সমাজবিদ অ্যালিস শেগেল (Alice Schlegel)-এর মতে উত্তর-পূর্ব আরিজোনার ‘হোপি’ (Hopi) গোষ্ঠীর নারী পরিচালিত সমাজ লিঙ্গসাম্যের আদর্শে পরিচালিত – "gender ideology ... one of female superiority, and it operated within a social actuality of sexual equality."। শেগেলের কাজের ভিত্তিতে লিবাও (LeBow) অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। তাঁর বক্তব্য হোপি নারীরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়াতেও অংশগ্রহণ করে। কিন্তু শ্রীমতী শেগেলের আফশোস বর্তমানে নারীর প্রতি হোপি সমাজের প্রতি এই সম্মানের মনোভাব ক্রমশ কমে যাচ্ছে; তবে সমাজ এখনও মাতৃবংশানুক্রমিক (matrilinial)। এই সমাজটিতে মেয়েদের উচ্চতর অবস্থান সম্পর্কে শেগেলের ব্যাখ্যা যে হোপিদের চিরাচরিত বিশ্বাস নারী হল বসুমাতার প্রতিনিধি – "life as the highest good ... [with] the female principle ... activated in women and in Mother Earth ... as its source"। সেইসঙ্গে প্রতিবেশী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ সংঘাতে লিপ্ত না থাকায় এদের স্থায়ী সেনাও ছিল না যার ফলে পুরুষালি শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়নি। রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিকতা বহুল (political and ceremonial) ব্যবস্থার পরিবর্তে সরল অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় মহিলারা পরিবার ও গোষ্ঠী উভয়ের কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিল। পুরুষকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কুটকচালি না থাকায় গোষ্ঠীমাতারাই (Clan Mother) জমি সংক্রান্ত বিবাদের মীমাংসা করত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার আগে থাকতে ছিল আইরোকিউ (Iroquois) সম্প্রদায়। অধুনা তাদের ৫-৬টি আদিবাসী এলাকাকে একত্রে Iroquois Confederacy or League বলা হয়। সেখানে শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল শান্তির বন্ধন (The Great Binding Law of Peace)। আইরোকিউদের সংবিধান রচনা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এমন কি যুদ্ধ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও মেয়েদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। লীগে মহিলা ও পুরুষ সদস্যের সংখ্যাও সমান হতে হবে। এই গোষ্ঠীর সদস্য জর্জ কানেটেণ্টিওর (George-Kanentiio)-র মতে যেহেতু প্রকৃতি নারীকেই সৃষ্টির ক্ষমতা দিয়েছে, তাই প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিকভাবেই তার নিয়ন্ত্রণও নারীর হাতে থাকার কথা। উপজাতিটির বংশ পরম্পরা চলে নারী অনুক্রমে। মায়েরা নৈতিক ও রাজনৈতিক (moral and political) নীতি নির্ধারক। দোষীর প্রাণদণ্ড হবে কিনা তাও মূলত নারীরাই ঠিক করে। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থেই মাতৃতন্ত্র (matriarchy) তথা নারী শাসন (gyneocracy)-এর বিরল নজির। কান্টেন্টিওর ব্যাখ্যা আইরোকিউদের মধ্যে ধরিত্রীমাতা (Mother Earth)-র ধারণা আছে যেখানে সকল প্রাণীকে পৃথিবীর ভাড়াটে আবাসিক হিসাবে দেখা হয়, মালিক নয়। মাতৃত্বকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ায় এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ততেও মেয়েদের সম্মতি বাধ্যতামূলক হওয়ায় সমাজ শান্তিপূর্ণ হিংসা রোহিত। আইরোকিউদের সরকার বা লীগ (League) আনুমানিক ১০০০-১৪৫০ খ্রীস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে যার সংবিধান ছিল মৌখিক। পরে ১৮৮০ নাগাদ লিখিত সংবিধান রচিত হয়। আমেরিকার কদর্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পরিবেষ্টিত হয়ে এই উপজাতি গোষ্ঠীর লীগ কীভাবে এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। এই সমাজের প্রতিনিধি কানেটেন্টিও (George-Kanentiio)-র বর্ণনা থেকে উঠে আসে তাদের মাতৃ শাসিত সমাজ শুধু সন্তানের যে জন্ম দিচ্ছে সেই মাতৃ জাতিকেই নয়, সমাজের মূল উৎপাদক অর্থাৎ কৃষিজীবীদেরও প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার দুটোই দেয়।
মূল ধারার পুরুষপ্রধান সমাজ কিন্তু সন্তানের উৎপাদক জননী ছাড়াও খাদ্য পানীয়েরও প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক উৎপাদক কৃষক শ্রণিকে শুধু বঞ্চিত নয়, কঠোরভাবে দমন করে, অত্যাচার করে, শৃঙ্খলিত করে রাখে। এই উদাহরণ থেকে বুঝতে পারছি নতুন প্রজন্মের উৎপাদক আর জীবনধারণে অপরিহার্য খাদ্যবস্তুর উৎপাদকদের দুর্দশার মধ্যে এই সম্পর্ক খুঁজে পাওয়াটা আমার কষ্টকল্পনা নয়; যোগসূত্রটা উপ্ত ছিল, আবিষ্কার করেছি মাত্র।
‘ব্রিব্রি’ একটি ছোট গ্রাম্য সম্প্রদায় যার জনসংখ্যা মাত্র ১৩,০০০ এবং বসবাস কোস্টারিকার লিমন (Limón) প্রদেশের তালামানকা (Talamanca) ক্যান্টনে। অন্যান্য মাতৃবংশকেন্দ্রিক সমাজের মতো এরাও গোষ্ঠী গঠন করে থাকে, যেখানে গোষ্ঠীগুলো আসলে মায়ের বংশের স্বজন তথা লতায়পাতায় জ্ঞাতিগুষ্টি নিয়ে তৈরি। জমির মালিকানা মেয়েদের নামেই হয়। ব্রিব্রিদের পবিত্র পার্বণে কাকাও (cacao) নামের খাদ্য-পানীয় তৈরির অধিকার শুধু মেয়েদেরই।
‘নাগোভিসি’ সম্প্রদায়ের বাস পশ্চিম নিউ গিনির সাউথ বোগেইনভিল (South Bougainville) অঞ্চলে। নৃতাত্ত্বিক জিল ন্যাশ (Jill Nash)-এর মতে নাগোভিসি সমাজ আসলে দুটি মাতৃবংশধারায় বিভক্ত (matrilineal moieties) যেগুলো পরবর্তী ধাপে মাতৃগোষ্ঠীতে (matriclans) বিভাজিত। সমাজিক নেতৃত্ব থেকে উৎসবে পৌরহিত্য মেয়েরাই করে থাকে। মেয়েদের কাছে সবচেয়ে গর্বের ও জোরের জায়গা হল নিজেদের মালিকানার জমি। যত্নেরও। বিয়ের পর মেয়েরা বাগান করা আর যৌনতাকে সমান গুরুত্ব দেয়। বিয়েটা প্রাতিষ্ঠানিক নয়। যদি কোনও পুরুষ কোনও নারীর সঙ্গে সহবাস করে ও তার বাগানের কাজে সাহায্য করে, তাহলে তাদের বিবাহিত ধরে নেওয়া হয়।
নারীবাদ আর নারী সমকামিতা এক নয়। তবে লেসবিয়ান রাষ্ট্রপ্রধানের নেতৃত্বে দেশে নারীর মর্যাদা রক্ষা ও ক্ষমতায়নের গৌরবোজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সমকামী নারী সমাজ নিঃসন্দেহে নারী প্রধান হলেও আমি মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃকেন্দ্রিক মনে করি না, যেহেতু পরিবার ও মাতৃত্ব ব্যাপারটাই সেখানে নেই। আবার কোনও সমাজে মেয়েদের পুরুষ বেশে শাসনকর্তার ভূমিকায় থাকাটাও নারীমুক্তির নিদর্শন নয়।
গত চার বছর ধরে আইসল্যান্ড World Economic Forum’s Global Gender Gap Index –এই সূচকটির শীর্ষে, তাদের মহিলা-বান্ধব (female-friendly) আইনকানুনের জন্য। ২০১০-এ নগ্ননৃত্য প্রদর্শনীগৃহগুলো (strip clubs) নিষিদ্ধ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী জোহানা সিগুরদারদোটির (Johanna Sigurdardottir) স্পষ্ট বলেছেন, “I guess men will have to get used to the idea that women are not for sale”। মহিলা নিজে বিশ্বের প্রথম লেসবিয়ান রাষ্ট্রপ্রধান যার পার্লামেন্টে ৪০% আসনে মহিলা প্রতিনিধি। মেয়েদের অধিকারের দাবিতে আইসল্যান্ডে সরবতার শুরু এক বিশেষ ঘটনা দিয়ে। ১৯৭৫-এর ২৪ অক্টোবর সে দেশে ৯০% মহিলা রান্না-বান্না, ঘরকন্না থেকে বাচ্চার দেখাশুনো এই জাতীয় যাবতীয় কাজ করতে অস্বীকার করে। গোটা দেশ স্তব্ধ হওয়ার জোগাড়। আইসল্যান্ড সরকারের পরবর্তী নারীবাদী তথা মানবতাবাদী পদক্ষেপ হতে চলে চলেছে সমস্ত আন্তর্জালকীয় ও মূদ্রিত মাধ্যমে পর্ণোগ্রাফি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া। বাস্তবায়ন যখনই হোক, সিদ্ধান্তটি নেওয়ার জন্য প্রণাম না জানিয়ে পারা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তগত যৌন পছন্দ স্বাভাবিক থেকে বিচ্যুত হলেও সেই বিচ্যুতি দ্বারা সমাজ কলুষিত করেননি, বরং সংস্কারের পথে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন।
আমেরিকা জুড়ে প্রায় ১০০টি ব্যতিক্রমী নারী বসতি (off-the-grid female-only colonies) আছে যেখানে Y ক্রোমোজোমযুক্ত কারও প্রবেশের অনুমতি নেই। অবশ্য “Welcome to America’s Womyn’s Lands” পর্যটকদের উদ্দেশ্যে লেখা কিনা জানি না। পুরোপুরি লেসবিয়ান সমাজ। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে যখন বেশ কিছু বিদ্রোহী মহিলা ফ্লোরিডার সেন্ট অগস্টিন (St Augustine, Florida) সমুদ্র সৈকতে একটি শিবির করে। বর্তমানে বৃহত্তম Womyn’s Lands-গুলোর একটির দেখা মেলে আলপাইন গ্রামের আলাবামা শিবিরে। এখানে ১৩ জন ৫০-৮০ বছর বয়সী মহিলাকে সহাবস্থান করতে দেখা গিয়েছিল। দিনের বেলা ক্ষেতে কাজ করা আর রাতে গোল হয়ে বসে কবিতাপাঠ গান দিয়ে ভরে তোলে নিজেদের সমাজ পরিত্যক্ত জীবন। আর তারপর বাইবেল অনুসারী মূলস্রোতের চোখের বাইরে চলে যায়। বলাবাহুল্য নারীপ্রধান হলেও একেও মাতৃকেন্দ্রিক সমাজ বলা যায় না। মেয়েরা পরস্পর বিকৃত কামের সম্পর্কে জড়িয়ে হয়তো নিজেদের মতো আছে, কিন্তু পরিবার প্রধানের ভূমিকা পালন বা কোনওরকম পারিবারিক জীবন তারা যাপন করছে না। জিন ক্লোনিং না করলে এমনিতে সন্তান জন্মের প্রশ্ন নেই, তাই তার মাধ্যমে পরিচয় উত্তরাধিকার ইত্যাদি সংবাহিত হওয়ারও উপায় নেই। মাতৃতন্ত্র পুরুষকে সমাজচ্যুত করতে বা মেয়েদের যৌন প্রবৃত্তি বদলে ফেলে সমকামী হতে বাধ্য করে না। তবে পুরুষালি আগ্রাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে যদি এমন জীবন বেছে নেয় কিছু নারী, তা হলে তাকে বেআইনিও বলা যায় না।
উত্তর আলবেনিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে একটি প্রজাতির মধ্যে উত্তরাধিকারী ও পরিবার প্রধান হিসেবে পুরুষ সদস্য না পেলে পরিবারের একটি মেয়ে, সচরাচর কিশোরীকে (usually a teenager) সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এজন্য তাকে ‘সতীত্বের প্রতিজ্ঞা’ (vow of chastity) নিতে হয় এই বলে, যে বাকি জীবনটা সে পুরুষ সেজে কাটাবে। এই মেয়েরা চুল ছোট করে কেটে, পুরুষদের ব্যাগি প্যান্ট শার্ট পরে এমনকি কণ্ঠস্বরেও পুরুষালি গম্ভীরতা এনে মেষ পালক কিংবা ট্রাক চালকের কাজ নিয়ে থাকে। এটাকে বলপূর্বক কৌমার্য রক্ষা (system of sworn virgins) বলা হয়। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো প্রথা। অনেক মেয়েই অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। তবে এর ফলে সম্বন্ধ করে বিবাহ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার হারানো ইত্যাদি অবনমন থেকে মুক্ত থাকতে পারে যেগুলো অন্যান্য আলবেনিয়ান মেয়েদের জন্য ওগুলো বরাদ্দ থাকে কিনা।
সামান্য স্বাধীনতা ও পারিবারিক নিরাপত্তা মেয়েদের জন্য কত দুর্লভ এবং তার জন্য কী মূল্য দিতে হয় এই সমাজটি তার করুণ উদাহরণ; অথচ নারীবাদ ও মাতৃতন্ত্রের নিদর্শন হিসেবে আলোচিত। নারীর এই শর্তসাপেক্ষ কর্তৃত্ব তো আসলে পুরুষেরই উচ্চাবস্থান সূচীত করছে।
তাত্ত্বিক কচকচি দিয়ে ভূমিকা শুরু করলেও উপসংহারে তাই কয়েকটি প্রশ্নচিহ্নই পড়ে থাকে – পিতৃতন্তান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদে মাতৃতন্ত্র কি একেবারে অবলুপ্তির পথে? আর এই অবলুপ্তিই ক্রমশ সামাজিক ও প্রকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনছে না তো? সভ্যতার ইতিহাসে পুরুষ প্রাধান্য আমাদের অসংখ্য যুদ্ধ, সংঘাত, নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা, অশান্তি, অপরাধের রমরমা, রুচি-বিকৃতি, প্রাকৃতিক দুষণ ও কার্যত অসভ্যতা উপহার দেওয়া ছাড়া কোন স্বর্গ রচনা করেছে? সভ্যতার এই পুরুষ শাসিত অগ্রগতি প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই এই বিপত্তি?
তথ্যসূত্র: