Image by Hassan T. from Pixabay
“যদি এটা সাপ আৰু এটা বঙালী দেখা পায়, প্ৰথমে বঙালীক হত্যা কৰক”, “অসম অসম ৰ বাবে” অনুবাদের প্রয়োজন আছে? বাংলাভাষারই তো বিচ্যুত রূপভেদ। “If you see a snake and a Bengali, kill the Bengali first", "Assam for Assamese" ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দেওয়াল লিখন।[1] সূত্র পুরোনো, তবে লেখাগুলো বর্তমান।
স্বাধীনতা ও দেশভাগের আগে ও পরে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের পর সবচেয়ে বেশি হিন্দু বাঙালী গণহত্যার বধ্যভূমি এই আসাম। মুসলিমদের অত্যাচারে পালিয়ে এসে বাঙালীদের একটা বড় অংশ র্যাডক্লিফের এপারেও পড়েছিল আরেক বধ্যভূমিতে নাম ‘আসাম’, যার একটা বৃহৎ অংশ বাংলার অঙ্গহানি করেই নির্মিত। নেহাত রাজ্য আসাম হলেও রাষ্ট্রের নাম ভারত আদি হিন্দুভূমি বলে যেখানে হিন্দু হওয়াটা মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত নয়। তাই জাতিগত নির্মূলীকরণ রাষ্ট্রীয় মদত বা সেনা সহায়তা পায়নি, বরং কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। অবশ্য আসাম তো ভিন্ন রাজ্য বলে স্বীকৃত, পশ্চিমবঙ্গের মরিচঝাঁপিতেই বা কী হয়েছিল? পশ্চিমবঙ্গ তো বাঙালী হিন্দুর নিজস্ব বাসভূমি, শেষ আশ্রয় বলেই তৈরি হয়েছিল। যাইহোক, এখানে আসামের পরিসরেই থাকি।
ঘটনা হল, আসাম রাজ্যের কোনও ঐতিহাসিক ভূমানচিত্র নেই। রাজ্যটা তৈরিই হয়েছে অহোম, স্বতন্ত্র পাহাড়ী রাজত্ব ও বাংলার একটা বড় অংশ কেটে জোড়তাপ্পি দিয়ে। এমন রাজ্যে মানুষের প্রব্রজন বা স্থায়ী-অস্থায়ী অভিপ্রয়াণ লেগে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবকিছুরই মাত্রা আছে। মাত্রাতাতিরিক্ত কিছু হলে স্থানীয়রা অপ্রসন্ন ও অসহিষ্ণু হতে পারে। তথাকথিত আসামে বাঙালীর যা সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছিল, তাতে তারাও আসামকে বাঙালী ভূমি বলে দাবি করতে পারত। করেনি। বরং রাজ্যের নাম ‘আসাম’ হওয়ায় ‘অহোম’রা কিছু জনজাতিকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের ‘অসমীয়া’ জাতি হিসাবে পরিচয় দেওয়ার সুযোগ পেল এবং আসামের জাতিগত মালিকানা দাবি করে বসল। মাত্রাতিরিক্ত সাম্প্রদায়িক প্রব্রজনে বাঙালীরাও অসহিষ্ণু হতে পারত, কিন্তু হয়নি। প্রব্রজীদের মধ্যে অনেক অসহায় হিন্দুও যে সামান্য বাঁচার আশায় সর্বস্ব খুইয়ে আসছে। সেই মমত্ববোধ অসমীয়াদের নেই, আছে বিদ্বেষ। চিন থেকে আগত মানুষগুলো ভারতের এক অংশর রাজত্ব করা ও কৌশলে নিজেদের সংখ্যা বাড়ানোর সুবাদে একটি জাতিসত্তার দাবিদার; তাদের জমির দখল চাই।
অসমীয়াদের বাঙালীবিদ্বেষের একটা কারণ যদি ঈর্ষা হয়ে থাকে, তাহলে আরেকটা কারণ আসামে বিপুল প্রবজন। এখানে জানতে হবে প্রব্রজনকারী দু’রকম — শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারী। যারা প্রাণ-মান বাঁচাতে সব খুইয়ে অথবা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে, তারা শরণার্থী; আর যারা তেমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছাড়াই অন্যদেশে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ঢোকে, তারা অনুপ্রবেশকারী। শরণার্থীদেরও বৈধ অনুমতিপত্র থাকে না, কারণ তারা প্রাণটুকুই সম্বল করে আসে। আরেকরকম প্রব্রজন হতে পারে যার নাম অভিপ্রয়াণ — জীবিকা বা খাদ্যের সন্ধানে দেশান্তরিত হয়ে পুনরায় স্বস্থানে ফিরে যাওয়া। এই অতি সহজবোধ্য ব্যাপারটা না বোঝা বা বুঝতে না চাওয়াটা আসলে জাতিবিদ্বেষ জিইয়েই জমি সম্পদ দখলে রাখার কৌশল; আবার সম্প্রদায়বিশেষের সম্প্রসারণে রাজনৈতিক মদত (Political Intellectual) বা কট্টর মৌলবাদকে প্রগতিশীলতার আবডালও বটে। অসমীয়রা সব প্রব্রজীকেই অনু্প্রবেশকারী হিসাবেই দেখে।
পূর্বতন পাকিস্তান ও আজকের বাংলাদেশ থেকে ৬০ বছর ধরে ক্রমাগত অনুপ্রবেশের ফলে আসামে বাঙালীর যে সংখ্যাধিক্য তাতে মার খাওয়া হিন্দু বাঙালীর চেয়ে মুসলিম বাঙালীর সংখ্যা কিছু কম নয়, বরং এতটাই বেশি যে বিধানসভা গঠনে এদের সমর্থন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
আসাম রাজ্য তৈরির সময় ইংরেজ শাসকরাই অর্থনৈতিক কারণে বাঙালী চাষীদের সেখানে নিয়ে আসে যাদের সিংহভাগ ছিল মুসলমান।[2] সুবিশাল উর্বর ভূমি, বিপুল বনসম্পদ কিন্তু চাষ করার মতো যথেষ্ট স্থানীয় মানুষ নেই। এটাই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির পরিব্রজী কৃষকদের আকর্ষণ করে, যাদের ৮৫%ই ছিল মুসলমান। চা বাগানের মালিক ও মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদের শ্রমিক প্রয়োজন ছিল। তারাও স্বাগত জানায় এদের।
প্রথম দিককার পরিব্রজীরা গোয়ালপাড়া জেলার মূলত নদীর চর ও সংরক্ষিত বনভূমিতে বসত গাড়ে।[3] তাদের বলা হত ‘মিয়া’ যেহেতু তাদের অধিকাংশ রংপুরের উত্তর-পূর্ব ও কিছু ময়মনসিংহ থেকে আগত মুসলমান। আবার বাংলা থেকে আসা বলে ‘বঙ্গাইয়া’ বা ‘বঙ্গালী’ যার অর্থ বাঙালী হলেও ব্যবহৃত হত বহিরাগত অর্থে।[4] অর্থাৎ কোনও শিক্ষাবলে বাঙালী ও বহিরাগত তখন থেকেই আসাম রাজ্যে সমার্থক।
এদিকে ১৯০৫-এ প্রথম বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই মুসলমান কৃষকরা আসামের উর্বরা ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা উপত্যকায় ক্রমান্বয়ে বসবাস শুরু করে। শুধু তাই নয় ১৯০৬-এ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর নবাব সেলিমুল্লাহ খুব স্পষ্ট করেই মুসলমানদের আসামে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে বলেছিলেন। আর উপ্যাধ্যায় লিখেছেন, “The All India Muslim League in its founding conference at Dacca on December 25-26, 1906 hatched a conspiracy to increase the Muslim population in Assam for improving its strength in the region. Census Superintendent C. S. Mullan in his Census report of 1931 validated this political conspiracy of AIML.”[5]
বস্তুত চাষাবাদের কঠিন কায়িক শ্রমে ব্রহ্মপুত্রের আদি অববাহিকাবাসীর অনীহার কারণেই সরকারি আমন্ত্রণে পূর্ববঙ্গের মুসলিম চাষীরা সেখানে বসত পেয়েছিল। আসামের দুর্গম বনভূমি ও চরাঞ্চল শষ্যশ্যামল হয়ে ওঠার পেছনে মুসলিম কৃষকদের অবদান অস্বীকারের জায়গা নেই। কিন্তু তার পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিসন্ধিটাও স্পষ্ট হতে স্থানীয়দের মনে জাতিবিদ্বেষের বিষবৃক্ষের চারা মহীরূহ হয়ে উঠল।
১৯৩৫-এ Government of India Act অনুসারে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন চালু হলে কংগ্রেস ১৯৩৬ সালে আসামের প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কংগ্রেস ৩৮টি আসন জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু উক্ত আইনে প্রাদেশিক প্রশাসকদের ক্ষমতা ছাঁটা মনে হওয়ায় কংগ্রেস প্রদেশ সরকার গঠন না করে বিরোধীর ভূমিকায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। গোপীনাথ বরদোলোই বিরোধী নেতা নির্বাচিত হন। আর কংগ্রেস ছাড়া অন্যান্য দলের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও ক্যাবিনেট গঠন করার সুযোগ পান মুসলিম লীগের মহম্মদ সাইদুল্লা। ক্ষমতায় এসেই যাঁর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় আসামে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ানো।[6]
একদিকে কংগ্রেসের উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা এবং গোপীনাথ বরদোলোইয়ের স্বচ্ছ ভাবমূর্তী, অন্যদিকে তৎকালীন আসাম সরকারের অপদার্থতা, বল্গাহীন অনুপ্রবেশ ঘটনো ইত্যাদির জেরে সইদুল্লার ক্যাবিনেট ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করে। অতঃপর ২১ সেপ্টেম্বর গোপীনাথ বরদোলোইকে সরকার গড়তে আবাহন করেন রাজ্যপাল।[7][8]
মুখ্যমন্ত্রী বরদোলোইয়ের অন্যতম কীর্তির মধ্যে পড়ে ভূমি রাজস্ব (Land Tax) বন্ধ করা ও আসামের মাটিতে মুসলিমদের অবাধ অনুপ্রবেশ রুখে স্থানীয় মানুষদের অধিকার সুরক্ষিত করা।[7] কিন্তু অনুপ্রবেশে সেই রাশ টানাই অসমীয়াদের মধ্যে জাতি বিদ্বেষ উস্কে দিয়েছিল বলে অনেকের অভিমত।[8]
তবে সেই সরকারের স্থায়ীত্ব বেশিদিন ছিল না। ১৯৩৯-এ ভারতীয় নেতাদের অমতে ইংরেজ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনা নিয়োগ করার প্রতিবাদে কংগ্রেস দেশ জুড়ে সরকার প্রদেশ সরকার থেকে পদত্যাগ করে। ফলে কংগ্রেস হাই কম্যান্ডের নির্দেশে ও গান্ধীজীর অনুরোধে ১৯৪০ সালে বরদোলোইকেও পদত্যাগ করতে হয়। তিনি গ্রেপ্তরাও হন যদিও অসুস্থতার জন্য বছর ঘোরার আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলে বরদোলোই সহ কংগ্রেসের সব নেতারাই গ্রেপ্তার হন।
কিন্তু এই সুযোগে ব্রিটিশ সরকারকে যুদ্ধে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাইদুল্লাহ্ পুনরায় মুখ্যমন্ত্রিত্ব পান। জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েই সাইদুল্লা ১৯৩৯ থেকে ৪১-এর মধ্যে পূর্ববঙ্গীয়দের জন্য এক লক্ষ বিঘা জমি বরাদ্দ করেন বিষ্ণুরাম মেধি ও অন্যান্য নেতাদের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। যুক্তি হিসাবে দেখানো হল কৃষিজীবি মুসলমান বাঙালীরা ‘Grow more Food’ প্রকল্পের জন্য জরুরি। ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় Lord Wavel, Viceroy's Journal, London Publication, December 22, 1943-এ বলেন "…The chief political problem is the desire of Muslim Ministers of Assam to increase the immigrations into uncultivated Government lands in Assam under the slogan of 'Grow more food' but what really is to 'Grow more Muslims'”[9][10] মাঝে কয়েক মাস বিরতির পর সাইদুল্লাহ্ আগস্ট ১৯৪২-এ পুনরায় ক্ষমতা লাভ করে ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ পর্যন্ত গদিতে আসীন থাকেন এবং আসামের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ক্রমশ সঙ্গীন করে তোলেন। আসামের কংগ্রেস নেতারা তো বটেই, সুভাষ চন্দ্র বোস এমনকি মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত এই অবারিত স্থানান্তরণে অসন্তোষ ব্যক্ত করেন।
গোপীনাথ বরদোলোই ১৯৪৪ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজ্য সরকারের তীব্র বিরোধীতা শুরু করেন। অন্যান্য নেতাদেরও সমর্থন পান। সাইদুল্লাহ্ রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি, মিটিং মিছিলে নিষেধাজ্ঞা, পরিযায়ী মুসলিম পুনর্বাসন ইত্যাদি ব্যাপারে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের জন্য নতুন সংবিধান ঘোষণা করলে পুনরায় কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচন হয়। কংগ্রেস ১০৮টির মধ্যে ৬১টি আসন জিতে পুনরায় সরকার গড়ে। গোপীনাথ বরদোলোই সর্বসম্মতিক্রমে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।[11] ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬-এ ক্যাবিনেট কমিশন (Cabinet Commission) গঠন করে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে শিমলা ও দিল্লীতে আলোচনায় বসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল রাজ্যগুলোকে ৩টি দলে (group) ভাগ করা হবে যেখানে বাংলা ও আসাম থাকবে তৃতীয় দলে। গোপীনাথ আশঙ্কা করলেন নতুন বিন্যাসে আসাম বাংলার দলভুক্ত হলে বাঙালীদের তুলনায় অসমীয়া প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। আসামের প্রতিবেশে যেহেতু মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ, তাই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। সাইদুল্লার আংশিক-পূর্ণ অ্যাজেন্ডা সম্পূর্ণতা লাভ করবে। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস প্রত্যাশিতভাবেই এই দল-বিন্যাসের প্রতিবাদ করে। বরদোলোই জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি, ক্যাবিনেট কমিটি ও ভারতের ভাইসরয়কে জানিয়ে দেন, আসাম নিজের সংবিধান নিজেই রচনা করবে এবং কোনও দলে যোগ দেবে কিনা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবে।[11] কিন্তু ক্যাবিনেট কমিশন দল-বিন্যাস বাধ্যতামূলক করে ঘোষণা করেন কোনও রাজ্য চাইলে পরে সংশ্লিষ্ট দল ছাড়তে পারে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় সাড়া না পেয়ে বরদোলোই এরপর আসাম জুড়ে গণবিক্ষোভ গড়ে তোলেন। শেষে জাতীয় কংগ্রেস বিষয়টা আসাম অ্যাসেম্বলিতে উত্থাপনের পরামর্শ দিতে অ্যাসেম্বলি স্থির করে, কোনও দলের অধীনে না গিয়ে আসামের ১০ প্রতিনিধি রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান নির্ধারণ করবে যা পরে ভারতের সংবিধান গঠনকারী জাতীয় কমিটির সঙ্গে মিলিত হবে।[11]
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে থাকতে আসামের কখনই আপত্তি ছিল না, কিন্তু বরাবর আপত্তি ছিল বাংলার অঙ্গ হিসাবে বা বাংলা বাংলার দলভুক্ত হয়ে থাকায়। জাতিসত্তার স্পষ্ট সংঘাত দেখা দিল তখন থেকেই। সুতরাং যারা অসমীয়াদের বাঙালী বিদ্বেষের জন্য বরদোলোইকে দায়ী করে, তারা হয়তো খুব ভুল বলে না। কিন্তু নিজস্ব জাতিসত্তা রক্ষার চেষ্টা তো অপরাধ হতে পারে না, অপরাধ হল জাতি বিদ্বেষ। এই বরদোলোইই কিন্তু দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালীর পুনর্বাসনে সাহায্য করেছিলেন।
জওহরলাল নেহেরু আসামের পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত এবং জিন্নাহ্ জেনেও বিশেষ অভিসন্ধি নিয়ে গ্রুপিং পরিকল্পনা কার্যকর করতে হাত মেলান। গোপীনাথ বরদোলোই গান্ধীজীকে অনুরোধ করেন হস্তক্ষেপের জন্য এবং পরে প্রবল বিরোধিতায় অনড় থাকেন। দেশ জুড়ে তখন অবিরাম চলেছে পাকিস্তানের দাবিতে হত্যালীলা। ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটন নতুন ভাইসরয় হবে জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও গান্ধীজীর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনার পর সমস্যার পাকাপাকি সমাধানের জন্য গ্রুপিং বা দল-বিন্যাস বাতিল করে দেশভাগের সিদ্ধান্ত নেন।[7] দেশভাগের জন্য ১৯৪৭-এর সিলেট রেফারেন্ডাম (Sylhet referendum, 1947) অনুযায়ী আসামের মুসলিম অধ্যুষিত অংশ সিলেটের একটা অংশ চলে যায় পূর্বপাকিস্তানে আর করিমগঞ্জ থেকে যায় আসামে।[12][13] কিন্তু সিলেটে হিন্দুপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও মৌলবী বাজার চলে যায় পাকিস্তানে।
আসাম বাংলার বাইরে আলাদা অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারায় শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভে যাওয়া থেকে বেঁচে যায়।[7] কিন্তু জিন্না ও তাঁর পাকিস্তানের আসামকে গ্রাস করার বাসনা বহাল থাকে যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ পায় উত্তরাধিকারসূত্রে। তাই ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ভারতের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ ও ইন্দিরা গান্ধীর বদান্যতায় প্রাণে বেঁচে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ মুজিবর রহমান প্রথমেই ভারতের কাছ থেকেই আসামকে দাবি করেন। ইতিহাসের চাকা কী আশ্চর্যভাবে ঘুরে যায়! এক সময় আসামের রাজস্ব ঘাটতির জন্য বাংলার অংশ কেটে আসামে জোড়া হয়েছিল, আর ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্পূর্ণতা আনার জন্য সে দেশটি আসামকে গ্রাস করতে চায়। এই অসমীয়া ও বাঙালীর অন্তর্ঘাত তো সহজে আরোগ্য লাভের বিষয় নয়। আর একদিকে অসমীয়া জাতিসত্তা ও অন্যদিকে বাংলাদেশের ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ – দুইয়ের টানাপোড়েনে সবচেয়ে বেশি ঘর পুড়েছে কিন্তু হিন্দু বাঙালীর যারা সবার সঙ্গেই সহিষ্ণুতার সঙ্গে সহাবস্থান করতে চেয়েছে।
স্বাধীনতার পরবর্তী গল্প কিন্তু তার পূর্ববর্তী ইতিহাসের ভিত্তিতেই রচিত। একটু পিছিয়েই শুরু করতে হচ্ছে। আসামের প্রধানমন্ত্রী (Prime Minister of Assam) মহম্মদ সাইদুল্লার আমল থেকে আসামে প্রবিষ্ট এই মুসলমান বা তথাকথিত ‘বাঙালী’রা কিন্তু পরবর্তীতে পাকিস্তান গঠনের অন্যতম দাবিদার হয়ে ওঠে, অথচ দেশ ভাগ হওয়ার পরেও পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যায় না, আসামের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে। ওদিকে ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালীর তরঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের মতো আসামকেও সামলাতে হয়েছিল। সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় আসামে মুসলিম জনসংখ্যা তখন অনেকটা কমেই যায়। আসরে নেমে পড়েন মইনুল হক চৌধুরী, যাঁর ভূমিকা সামান্য আলোচনার দাবি রাখে।
কাছাড় জেলার সোনাবারিঘাটে জন্মানো মইনুল শিলচর গৌহাটি ও সিলেটে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে স্নাতক হন। কলেজের ছাত্র ইউনিয়ানের নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানকে হারিয়েও দেন। পরে ১৯৪৬ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (Aligarh Muslim University) থেকে ইতিহাসে এমএ করেন। সেই সময় মইনুল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন, যার ঘোষিত অনুপ্রেরণা সুভাষচন্দ্র বসু ও মৌলানা আবুল কালাম আজ়াদ হলেও তিনি সদস্যপদ নেন মুসলিম লীগের।[14] বলা বাহুল্য লীগের কাছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল আসলে বকলমে পাকিস্তান দাবির আন্দোলন।
সাংগাঠনিক গুণে মইনুল মুসলিম লীগের যুব সংগঠনের সেক্রটারিও হন। ১৯৪৭-এ আইনের ডিগ্রীও লাভ করেন। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জিন্নার সাথে, হয়ে ওঠেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব। জিন্নার কাছে মইনুল বরাক উপত্যকা নিয়ে আলোচনা করেন।[14] অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, বরাকের বাঙালী সংখ্যাধিক্য নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ছিল মূল প্রতিপাদ্য।
১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় মইনুল দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন ভারতে থাকবেন না পাকিস্তানে চলে যাবেন। জিন্না আশ্বাস দেন, "wait for ten years, I shall present Assam on a silver plate to you" (Politics of Alienation in Assam by Bhawani Singh, 1984, Page 72)।[15][16][10]
ভিন্নতর সূত্র জানাচ্ছে মইনুলের জবাবি পত্রে আছে, “Qued-e-azam, wait for next thirty years. I shall present Assam to Pakistan on a silver plate”(স্বরাষ্ট্রমন্ত্র সূত্র, সাপ্তাহিক বর্তমান থেকে প্রাপ্ত)।[17] ১৯৪৮-এ জিন্না মারা গেলেও কংগ্রেস পরে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে দেয় সেই মইনুলকে ক্যাবিনেট মন্ত্রী বানিয়ে,[18] যিনি স্বাধীনতার পর ভারতে মুসলিম লীগ নির্বল হয়ে গেলে ফকরুদ্দিন আহমেদের সৌজন্যে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। মুসলিম লীগে থাকতে যেটুকু অপূর্ণ ছিল, কংগ্রসে যোগ দিয়ে তা পরিপূর্ণ করা গেল। ১৯৪৮-এ শিলচর বার অ্যাসোসিয়েশন-এর সদস্য হয়ে মইনুল পেশা জীবন শুরু করেন।
স্বাধীনতার পর নয়া আসামের রূপকার গোপীনাথ বরদোলোই সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক দিকে পাকিস্তান আর অন্যদিকে চিনা আগ্রাসন থেকে আসামকে রক্ষা করে ভারতের অঙ্গীভূত রাখেন। শুধু তাই নয়, বাংলা থেকে আসামের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হলেও দেশভাগের পর লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী আসামে ছুটে এলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করেন বরদোলোই।[10][19] তাতে অসমীয়া জনগণ যে প্রসন্ন হয়নি বলা বাহুল্য। যারা ভাষার প্রশ্নে আসামের আদি বাঙালীদেরই বহিরাগত ‘বঙ্গালী’ বলত, তারা এখন বাঙালীকে বহিরাগত বলার যথেষ্ট কারণ পেয়ে গেল।
ওদিকে ১৯৫০ থেকে সক্রিয় রাজনীতির সৌজন্যে মুইনুল হকে শিলচর পৌরসভা বোর্ডে প্রভাব বাড়তে থাকে তাঁর। ১৯৫২ সালে আসাম আইনসভার (Assam Legislative Assembly) সদস্যপদ এবং ক্রমে ১৯৫৭ নাগাদ আসাম বিধানসভার ক্যাবিনেট মন্ত্রিত্বও লাভ করেন। দায়িত্ব পান কৃষি মন্ত্রকের অর্থাৎ যে দায়িত্ব পেলে কৃষক আমদানির ছলে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধির কাজটা গুছিয়ে করা যায়।[14] বারবার নির্বাচনে জিতে ১৯৬৭ সালে চতুর্থবার বিধায়ক হওয়ার পর বিমলা প্রসাদ চালিয়ার সঙ্গে মতানৈক্যের জেরে মন্ত্রিত্ব থেকে বঞ্চিত হন। অবশ্য ক্ষতি কিছু হয়নি; ১৯৭২-এ জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সম্মানজনক অভিষেক হয়ে যায় এবং জাতীয় হজ কমিটির (Haj Committee) চেয়ারম্যান মনোনীত হন।[14]
অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের বাঙালীরই অনুপ্রবেশ ক্রমশ বাড়ছিল। ১৯৬৪-তে কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা (Bimala Prasad Chaliha) বেআইনি অনুপ্রবেশ রুখতে নেহেরুর একপ্রকার বিরুদ্ধে গিয়ে Prevention of Infiltration from Pakistan (PIP) Act 1964 আনেন, কারণ আসামের জনসংখ্যার অনুপাত, চরিত্র ও নিজস্ব সংস্কৃতি সবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিল।"Prime Minister Jawaharlal Nehru wanted the Assam Chief Minister, Bimala Prasad Chaliha to go easy on deportations and even stop them. Chaliha refused, saying that the problem was so critical that Assam's demography and culture would be permanently changed."[20] কিন্তু মুসলিম নেতারা বাঙালী মুসলমানদের অসমীয়া ভাষা শিখে মূল জনস্রোতে আত্মগোপনের পরামর্শ দেয়। শেষ পর্যন্ত ২০ জন মুসলিম এমএলএ সরকার ফেলে দেওয়ার হুমকি দিলে চালিয়া PIP আইনকে ঠাণ্ডাঘরে পাঠাতে বাধ্য হন। চৌধুরীর সঙ্গে চালিয়ার মতবিরোধের কারণটা বোঝাই যাচ্ছে। যারা বাংলাদেশে প্রস্থান করেছিল তারা আবার আসামে ফিরে জাঁকিয়ে বসে। মাঝখান থেকে আক্রোশে শুরু হয়ে যায় ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন যার লক্ষ্য ও শিকার ছিল কিন্তু অধিকাংশত হিন্দু বাঙালীরা।
এদিকে বরাক ও সমগ্র আসামে মুসলমান বাঙালীর দাপট দেখে ১৯৭১-এ সার্বভৌম বাংলাদেশের ‘কৃতজ্ঞ’ প্রধানমন্ত্রী মুজিবর রহমান বায়না ধরলেন আসামকেও তাঁর চাই। "Without the inclusion of Assam the East Bengal economy could not be balanced"। মরূভূমির উট আর সদাগরের সেই গল্পের মতো। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের মতোই অনুপ্রবেশ নীতিও বজায় রাখল বাংলাদেশ। রাজ্যসভার ৭২তম Report of the Committee of Petitions, ২২ মার্চ, ১৯৮২ অনুসারে: ".... a total of 2,20,690 Pakistani infiltrators were detected in the state during the period 1950-1961 and another 1,92, 339 were spotted in the following decade. During the Bangladesh War of Liberation (1971) a total of 1,00,000 immigrants stayed behind even after Independence of their country… The prime factor responsible for this abnormal growth (of Muslims) was the geo-political ambition of Pakistan over Assam."[21] (Page 2 of the Report).
অসমীয়াদের হিন্দু বাঙালীর ওপর ঈর্ষা ও ক্ষোভ তো বহু পুরোনো, তৎসহ শরণার্থীর পাশাপাশি মুসলিম অনুপ্রবিষ্টের ভিড়ে আসামের জনমানচিত্রে ওলট-পালট টের পেয়ে বাঙালী বিদ্বেষ ক্রমশ উগ্রতর হিংস্রতর হতে থাকে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত ‘বঙ্গাল খেদা’ ও অসমীয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র শিক্ষাদান ও সরকারি ভাষা করার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হয়নি, কাছাড়ে বাংলার মান্যতা মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার বাঙালীদের প্রব্রজন তবু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর শরণার্থীর স্রোত বাঁধ ভেঙে দিল। তখন শুধু বাঙালী নয়, বহু মুসলমান প্রব্রজীও নিছক অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে নয়, আশ্রয়প্রার্থী হিসাবেও আসতে লাগত। অসমীয়া ও আসামের উপজাতিগুলির হিংস্র আক্রোশের নিশানা শুধু হিন্দু বাঙালীরা নয়, মুসলমানরাও হতে শুরু করল।
আসামে স্থানীয় মুসলিমও কিছু আছে যেমন গৌরিয়া (গৌড়ীয়), মারিয়া ও দেশী। এদের সংখ্যা বাংলা-মূলের প্রব্রজী মুসলিমদের তুলনায় নগন্য। তাই পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনার বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের ফলে মুসলিম জনসংখ্যার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি নিয়ে একটা উদ্বেগ কাজ করেছে, যারা স্থানীয় জনজীবন ও জনবিন্যাসে বেশ চাপ ফেলছিল। জনবিন্যাসগত অনুপ্রবেশই (Demographic Invasion) বিশাল রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ১৯৭৯-৮৫-এ ‘আসাম আন্দোলন’ (Assam Movement (1979–1985)) রূপে আত্মপ্রকাশ করে।[22] ২০০১ সালে আসামের ৬টি জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়, ২০১১ সালের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯টিতে।[23] কারও কারও দাবি মুসলিম সংখ্যাধিক্য তারপর থেকে নাকি সামান্য কমেছে, যদিও তার নিশ্ছিদ্র প্রমাণ নেই।[24]
১৯৬৩ থেকেই ভোটার তালিকায় বিদেশীদের নাম ঢুকে পড়ছে বলে অভিযোগ ছিল।[25][26] ১৯৭৯-এ মঙ্গলদই লোকসভা কেন্দ্রের খসড়া ভোটার তালিকায় যথেষ্ট সংখ্যক অনাগরিকের নাম দেখা গেল।[27] মোরারজি দেশাই ও চরণ সিং – পরপর দুজনের সরকার পড়ে যাওয়ার পর লোকসভা উপ-নির্বাচনের আয়োজন করতে হয়। তখন দেখা যায় মঙ্গলদই কেন্দ্রের সর্বশেষ খসড়া তালিকাতেও ৭২% ভোটার সন্দেহভাজন।[25] এখম কে নাগরিক কে অনাগরিক, কে সন্দেহভাজন কে সন্দেহের ঊর্ধ্বে, তা নির্ধারণের ভিত্তি কী ছিল, তা সম্ভবত কেউ জানতে চায়নি। AASU তালিকার আমূল সংশোধন চেয়ে ১৯৮০-র লোকসভা নির্বাচন বয়কটের ডাক দিল।[28][29] সরকারের পক্ষে আন্দোলনকারী নেতাদের দাবি মেনেওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ তাতে রাজনৈতিক ক্ষবক্ষতিও যুক্ত ছিল।[30] সুতরাং আন্দোলন ক্রমশ অর্থনৈতিক ও নানা সামাজিক অবদমনের মাধ্যমে জাতিগত সংঘাতের চেহারা নিল।
১৯৭৯ সালে আসাম আন্দোলনের সূত্রপাৎ করে ‘All Assam Students Union’ (AASU) এবং ‘আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ’ (AAGSP) যারা জনপ্রিয়তা পায় বাংলা বিহার ইত্যাদি প্রদেশ থেকে অনুপ্রবিষ্টদের তাড়ানোর জিগির তুলে। ১৯৭৯-র আসাম অস্থিরতা সাক্ষী আসু ও অন্যান্য সংগঠনের ডাকা ঘনঘন বন্ধ্, হরতাল, কার্ফিউ, বাঙালী হত্যা। মালিগাঁওয়ের এক বছর ২০-২২-এর যুবক তার নিজের ছোটবেলার বাঙালী বন্ধুকে প্রকাশ্য রাস্তায় ছুরি মেরে জাতির প্রতি কর্তব্য সারে।[31] নিহত ছেলেটির অপরাধ, ভারতীয় সেনার বিমানবাহিনীতে যোগদানের যোগ্যতা অর্জন, অসমীয়া জাতিসত্তার অনুপ্রেরণা, ঈর্ষা, ঈর্ষা এবং ঈর্ষা। দাস কলোনিতে পাথর নিক্ষেপ, মালিগাঁও ও গৌহাটির মধ্যেকার পেট্রোল পাম্প জ্বালিয়ে দেওয়া – যেকোনও ভাবে বাঙালী হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে নিঃস্ব করে তাড়িয়ে দেওয়া।[31]
কামরূপ জেলার গড়েশ্বরের ২৫টি গ্রামে হিংসার কবলে পড়ে। বিচারক মেহরোতার অধীনে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ৯ জন বাঙালী খুন হয়, একজন বাঙালী মহিলা আক্রান্ত হন, আর বাঙালীদের কমপক্ষে ৪০১৯টি কুটির ও ৫৮টি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। গৌহাটির জেলাশাসক বাঙালী হওয়ায় তাঁকে বাড়িতে ঢুকে ১০০ জনের একটি দল হামলা করে ছুরি মারে।[32] পুলিসের ডিআইজি (Deputy Inspector General) বাঙালী হিন্দু, তাই তিনিও ছুরিবিদ্ধ হলেন।[32] গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজ থেকেও বাঙালী (হিন্দু) ছাত্রদের জোর করে বার করে দেওয়া হল।[33] হাজার হাজার বাঙালীকে পুনরায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত আসামে দফায় দফায় কখনও ‘বঙ্গাল খেদা’, কখনও ‘আসাম আন্দোলন’-এর নাম করে ৫ লক্ষের ওপর বাঙালী হিন্দুকে আসাম রাজ্য থেকে উৎখাত করা হয়েছে।[34] সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান, কোনও বাঙালী নিজের আদি বাসভূমিতে ফিরে যেতে পেরেছে কিনা খবর নেই।
তুমুল হিংসায় উত্তাল এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ইতি হয় ১৯৮৫ সালে ভারত সরকারের তরফ থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ও AASU-AAGSP নেতৃবৃন্দের মধ্যে ‘আসাম চুক্তি’ (Assam Accord) সাক্ষরিত হওয়ার পর।[35][36] হিন্দু বাঙালীরা মার খাচ্ছিলই। ৭ই ফেব্রুয়ারি খয়েরবাড়িতে ৫০০র বেশি হিন্দু শরণার্থীকে মেরে ফেলে, যারা আদৌ জনসংখ্যায় চাপ ফেলেনি, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়া মুসলমানদের সঙ্গে জমি বিনিময় করে বসত গড়ে ছিল। কিছুদিন পর ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে নেইলি গণহত্যায় ২১৯১ জন বাংলাদেশী অধিকাংশত মুসলিমের প্রাণ যায়। কেন্দ্র সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় এবং একপেশে আসাম চুক্তি সাক্ষরিত হয়।
এই ৬ বছরে কত বাঙালীর প্রাণ গেছে লেখাজোকা নেই, তবে আসু-র সূত্রানুযায়ী ‘অনুপ্রবেশমুক্ত আসাম’-এর দাবিতে ৮৬০ জন (আধিকারিক সূত্র ৮৫৫) জন আন্দোলনকারীও নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। আসামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এই উগ্র প্রাদেশিক আন্দোলনকে ভারতের ঐক্য ও নিরাপত্তার সঙ্গেও জুড়ে বলেছেন, “The people of Assam took part in the six year-long movement to protect the state from illegal immigrants and 860 of them died to protect the unity and integrity of India. The Assam Movement is a shining example of the united efforts of the indigenous people of Assam to protect the nation. The immortal sacrifice of the martyrs will continue to inspire the greater Assamese community and the nation forever,”[37]
১৯৮৫-র ১৫ই আগস্ট নতুন দিল্লীতে ভারত সরকার ও আসাম আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে সাক্ষরিত আসাম চুক্তি বা সঙ্গতি (Assam Accord, 1985) ছিল একটি Memorandum of Settlement (MoS) বা নিষ্পত্তির স্মারকলিপি। [38] ‘আসাম সঙ্গতি’ বা ‘আসাম চুক্তি’র প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য ছিল: ২৫শে মার্চ ১৯৭১-এর পরে আসামে আগত বিদেশীদের যথাক্রমে সনাক্ত, অপনয়ন ও চূড়ান্ত পর্বে বহিষ্কার করা হবে। এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ হল আসামের স্থানীয় মূলনিবাসী (indigenous people) কারা। যারা বহুদিন ধরে এমনকি ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক শাসনের আগে থাকতে আসামে বসবাস করছে, তারা হল মূল নিবাসী। আরও কিছু বিশদ যথাস্থানে উপলব্ধ। বেশ মজার ব্যাপার। যে রাজ্যটা তৈরিই হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের ফলশ্রুতিতে বাংলার বিরাটাংশের জমি কেটে অহম ও ছোটছোট পাহাড়ী রাজত্বের সঙ্গে জোড়তাপ্পি দিয়ে, সেখানকার অর্ধেকেরও কম জনসংখ্যার প্রতিনিধিরা স্থির করছে মূলনিবাসীর শর্তাবলী যেখানে ‘বাঙালী’ মাত্রই বহিরাগত।
সুতরাং বাঙালী হত্যা বন্ধ করতে কার্যত বাঙালীর আরেক সর্বনাশের দলিলেই সাক্ষর হয়েছে। পরের বছর ১৯৮৬-তে ভারতের নাগরিকত্ব আইনের প্রথম সংশোধন হয় আসাম চুক্তির সৌজন্যেই।[38][39][40] ২০১৯-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA-19) নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাম চুক্তির বিশদ আবার আসবে। আপাতত ১৯৮৫-তে চুক্তি সাক্ষর হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির কথা বলি।
আরও মজার ব্যাপার, ১৯০৬-এর পর মূলত ময়মনসিংহ থেকে আসামে যাওয়া মুসলমান কৃষকরা বনভূমি সাফ করে ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উর্বর জমি দখল করে চাষাবাদ করলেও[41] তাদেরকে অসমীয়া অণু-জাতিসত্তার সম্প্রদারণবাদীরা বিদেশী হিসাবে দাগায়নি, সংঘাতও করেনি, যেহেতু তারা হিন্দু বাঙালীদের সঙ্গে সংস্রব রাখেনি।[42] বস্তুত সম্ভ্রান্ত অসমীয়ারা তাদের স্থাপনায় উৎসাহই দিয়েছিল। দেশভাগের পর অসমীয়া অণু-জাতিসত্তাবাদীদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল ব্রিটিশ আমল থেকে চা বাগান শ্রমিকদের ওপর বাঙালী নিয়ন্ত্রণ ও সামগ্রিকভাবে বাঙালীর সমৃদ্ধিকে তছনছ করে দেওয়া।[43] জনসংখ্যা ও সাংস্কৃতিকভাবে তো বাঙালীরা তাদের চেয়ে এগিয়েই ছিল,[44] তার ওপর দেশভাগের পর থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশে বাঙালী জনসংখ্যা শুধু আরও বাড়ছেই না, তাদের ভোটাধিকারও জন্মে যাচ্ছে।[45]
বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের মতামত ও তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ মুসলিম সংখ্যাধিক্য, সাম্প্রদায়িক অভিপ্রায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও শেষমেশ হিন্দু বাঙালীদের প্রতি হীনমন্যতাজাত অসূয়াই আসাম রাজনীতি ও সমাজের নীতিনর্ধারক। বাঙালীকে জব্দ করবে বলেই অসমীয়া তথাকথিত হিন্দুরা মুসলমানদের প্রশ্রয় দিয়েছে, দাঙ্গায় ব্যবহার করেছে, আর যখন মুসলিমদের জন্য নিজেরা বিপন্ন বোধ করেছে, উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলেছে এবং সেই চিন্তাপ্রকাশ দ্বারা বাঙালীদের বিভ্রান্ত করতেও সফল হয়েছে। আর এই কারণেই বরাক থেকে ব্রহ্মপুত্রের বাঙালীরা লাগাতার র্যাডক্লিফের উভয় পারে মুসলিমদের হিংস্রতার বলি হয়েও তাদের সঙ্গে নিয়েই ভাষাগত ঐক্য গড়ার অলীক স্বপ্ন দেখছে। এর সমাধান কী তা এখানে লেখা সম্ভব নয়, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় বাঙালী হিন্দু সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে উঠলে বিচিত্র কিছু নয়, সেটাই স্বাভাবিক, বাঁচার শর্ত। বরং হয়নি কেন, সেটাই বিস্ময়।
তথ্যসূত্র:
Other sources: