WHO-র সংজ্ঞানুযায়ী স্ত্রী জননাঙ্গচ্ছেদ (Female genital mutilation or FGM) বা স্ত্রী সুন্নত (Female Circumcise) হলো চিকিৎসার প্রয়োজন ব্যতীত কোনোভাবে বহিঃস্থ স্ত্রী জননাঙ্গ সম্পূর্ণ বা আংশিক কেটে বাদ দেওয়া। "all procedures that involve partial or total removal of the external female genitalia, or other injury to the female genital organs for non-medical reasons." ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এটি পরিচিত ছিল স্ত্রী সুন্নত বা female circumcision নামে। চাহিদা পুরুষের হলেও এই হিংস্রতা মূলত মেয়েরাই আঁকড়ে আছে অন্ধ সংস্কারবশত, লাগাতার প্রচার চালিয়েও যা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি।
কিন্তু পুরুষকে সুন্নত করা আর নারীকে করা এক ব্যাপার নয়। লিঙ্গের বহিরাবরণ কিছুটা কেটে বাদ দিলেই পুরুষদের সুন্নত হয়ে যায়, যদিও ব্যাপারটা তাদের ক্ষেত্রেও সাময়িক যন্ত্রণাদায়ক। সাধারণত করা হয় খুব কচি বয়সে, ভালো করে যন্ত্রণাবোধ তৈরির আগেই। কিন্তু নারীর জননাঙ্গে বাড়তি চামড়াই নেই। অথচ সঙ্গম সুখ নষ্ট করার জন্য স্ত্রী অঙ্গ থেকেও স্পর্শকাতর অংশ কেটে বাদ দেওয়া বা তৎসহ সেলাই করে জুড়ে দেওয়ার উদ্ভট প্রথা চালু আছে প্রধানত আফ্রিকা মহাদেশের অনেকটা জুড়ে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের আনাচে-কানাচে।
মোট চার প্রকার স্ত্রীঅঙ্গ-বিকৃতি আছে। তাদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকমফের।
Type I অঙ্গহানির ক্ষেত্রে লক্ষ্য স্ত্রীঅঙ্গের স্পর্শকাতরতম অঙ্গ ভগাঙ্কুর (clitoris)। নিতান্ত বিরল ক্ষেত্রে (Type-Ia) শুধু ভগাঙ্কুর আবরণী (clitoral hood) কেটে বাদ দেওয়া হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই (Type-IIb) একই সঙ্গে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভগাঙ্কুর শীর্ষ (clitoral glans) এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৎসহ তার আশপাশের চামড়াও কেটে বাদ দেওয়া হয়। কতটা কী বাদ যাবে, সেটা জায়গা ও জাতিভেদে নির্ধারিত হয়।
Type II রীতিতে হিংস্রতার মূল লক্ষ্য আভ্যন্তরীণ যোনি ওষ্ঠ (inner labia)। কিন্তু তার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্লিটোরিস ও এমনকি বাইরের যোনি ওষ্ঠও কেটে বাদ দেওয়া হয়।
Type III হলো অন্যতম বীভৎস পদ্ধতি, যেখানে ভগাঙ্কুর, আভ্যন্তরীণ যোনি ওষ্ঠ সবটাই খেপে খেপে খুবলে খুবলে কেটে বাদ দিয়ে মূত্র ও প্রস্রাব নির্গমের জন্য মাত্র ২-৩ মিলিমিটার ব্যাসের সরু ফুটো রেখে বহিঃস্থ যোনি ওষ্ঠ সেলাই করে জুড়ে পুরো যোনিমণ্ডল (vulva) বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার নাম infibulations। গোদা বাংলায় ‘স্ত্রী-অঙ্গ সেলাই’ বলা যায়। নাম সেলাই হলেও কাটাকুটি কম করে সেলাই দেওয়া বিরল। বিয়ের পর যৌন সঙ্গমের জন্য যোনিছিদ্র সামান্য উন্মুক্ত করা হয়। বিয়ের রাতে এই কাজটা বিবাহিত পুরুষটি নিজের লিঙ্গ দ্বারা করতে অসমর্থ হলে নিজে বা কোনো বয়স্ক মহিলা ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তা সমাধা করে। পরে প্রসবের প্রয়োজনে আরও কিছুটা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে চিরে খুলে দেওয়া হয়। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার জিবুতি (Djibouti), এরিট্রিয়া (Eritrea), ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও দক্ষিণাঞ্চল ছাড়া সুদানের সর্বত্র নৃশংতম এই Type-III FGM-এর চল। ২০০৮ সালে করা এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, আফ্রিকার ৮ মিলিয়ন মহিলা এইরকম জননাঙ্গ বিকৃতি নিয়ে বেঁচে আছে।
United Nations Population Fund (UNFPA)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১০ সালে ২০% জননাঙ্গহানির শিকার মহিলারই যৌনাঙ্গে সেলাইও করা আছে।
Type IV হলো চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া খোঁচানো, ছুঁচ ফোটানো, কাটা, চাঁছা ও দগ্ধ করা – সবরকম বীভৎসতার সম্মিলিত রূপ। ("[a]ll other harmful procedures to the female genitalia for non-medical purposes" including pricking, piercing, incising, scraping and cauterization). এই পদ্ধতিতে প্রথমে অল্প কেটে (nicking), মানে ক্লিটোরিসের আবরণীটুকুকে কেটে প্রতীকী সুন্নত হয়। তারপর বাকি সব চেঁছে পুড়িয়ে যোনিতে গাছ-পাতা যা ইচ্ছা ঠুসে আঁট করে দেওয়া হয়।
ল্যাবিয়া বা ভেতরের যোনিওষ্ঠ চিরে বিস্তৃত করাও (Labia stretching)
Type IV FGM বলে ধরা হয়। দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকায় এমনটা করা হয় পুরুষমানুষকে অধিকতর যৌন সুখ দিতে। ৮ বছর বয়স থেকেই বাচ্চা মেয়েদের শেখানো হয় লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ও মালিশ করে নিজেদের পীড়ন করতে এবং বোঝানো হয় এমনটা না করলে তাদের সন্তান প্রসবে সমস্যা হবে। প্রথমে কোনো বয়স্ক মহিলা লাঠি ঘুরিয়ে কোমলাঙ্গের এমন দশা করে, যাতে তা পূর্বাবস্থায় ফিরে না আসে। তারপর সেই দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় মেয়েটার ওপরেই। আবার প্রার্থিত প্রসারণের পর থামতে হয়, নাহলে বেশি বেড়ে যাবে। WHO ২০০৫ এর বর্ণনা দিয়েছে, তা এক কথায় নারকীয়। বটসোয়ানা, লেসোথো, মালাওয়ি, মোজ়াম্বিক, নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজ়ানিয়া, উগান্ডা ও জ়িম্বাবোয়েতে এই বিচিত্র রীতি।
Image by https://teachmeobgyn.com
এছাড়া ১৯৯৫ সালে WHO প্রদত্ত সংজ্ঞায় নাইজিরিয়া ও নিগার দেশে প্রচলিত গিশিরি কর্তন (gishiri cutting) ও অ্যাঙ্গুরিয়া কর্তন (angurya cutting) এই দুটি পদ্ধতিকেও শামিল করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো ২০০৮ সালে সরানো হয় অপ্রতুল তথ্যের কারণে। স্থানীয় লোকেরা এইসব স্ত্রীরোগ চিকিৎসার অঙ্গ বলে দাবি করলেও নাইজিরিয়ান চিকিৎসক মারিও উসমান মানদারা (Mairo Usman Mandara) জানিয়েছেন, সতীচ্ছদ বা হাইমেন (hymen)-কে আঘাত করার ফলে এই পদ্ধতিতে vesicovaginal fistulae হয়, যে যন্ত্রণাদায়ক রোগটি হয় যোনি ও মূত্রথলির মধ্যেকার ছিদ্র পথে মূত্র প্রবেশ করার কারণে।
আফ্রিকান লেখিকা এডনা অ্যাডান ইসমাইল (Edna Adan Ismail) সোমালিয়ায় প্রচলিত FGM-এর যা বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে গা শিউরে ওঠে। এই বীভৎস অস্ত্রোপচারের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাচ্চা মেয়েদের অজ্ঞানও করা হয় না। বিরল ক্ষেত্রে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া থাকলে দিয়ে জায়গাটাকে সাময়িক অসাড় করার চেষ্টা হয়। নাহলে সম্পূর্ণ অনুভূতি সজাগ রেখে মামুলি ব্লেড দিয়েই চলে এইসব অপারেশন। বালিকা বা কিশোরীকে পেছন থেকে জোর করে চেপে পা ফাঁক করে শুইয়ে বা বসিয়ে আঙুলের নখ দিয়ে ভগাঙ্কুর খিমচে ধরে চালানো হয় তপ্ত ব্লেড বা ক্ষুর। যদি মনে হয় কম কাটা হয়েছে, তাহলে বাড়ির লোকের পরামর্শে আরো খানিকটা মাংস বা চামড়া খুবলে নেওয়া হয়। রক্তে ভেসে যাওয়া বাচ্চা মেয়েটার চিৎকার, ছটফটানি সব উপেক্ষা করে তারপর ছুঁচ বা কাঁটা ও সুতো দিয়ে ২-৩ মিলিমিটার ফুটো বাদ রেখে অবশিষ্ট বাইরের যোনিওষ্ঠ মুড়ে পুরো স্ত্রীঅঙ্গ সেলাই করে দেওয়া হয়।
রক্তস্রোত, ছটফটানি ও চিৎকারে দুর্বল হলে চলে না। অসুন্দর, অমসৃণ, বদ গন্ধযুক্ত জায়গাটাকে পুরুষমানুষের ভোগের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে তো।
মালির বম্বারা ভাষায় (Bambara language) বলা হয় ‘বোলোকোলি’ (bolokoli) যার অর্থ ‘হাত ধোয়া’ ("washing your hands")। পূর্ব নাইজিরিয়ার ইগবো ভাষায় (Igbo language) এই অঙ্গহানির নাম ‘ইসা অরু’ (isa aru) বা ‘ইউ আরু’ (iwu aru) যার মানে ‘স্নান করা’ ("having your bath")। উদাহরণস্বরূপ, "a young woman must 'have her bath' before she has a baby." পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ের সুন্নতকে আরবি ভাষায় বলা হতো ‘তহুর’ বা ‘তাহারা’ (tahur and tahara) যার উৎপত্তি ‘t-h-r’ ধাতু এবং অর্থ পবিত্রকরণ। [23] তাছাড়া ‘খাফদ’ (khafḍ) বা ‘খিফাদ’ (khifaḍ) শব্দদুটিও প্রচলিত। বিভিন্ন আরবি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণত স্ত্রী জননাঙ্গ সেলাই করে জুড়ে দেওয়াকে "pharaonic infibulation” বা ‘ফারাওনিক সেলাই’ নামে পরিচিত।
Infibulation শব্দটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘fibula’ থেকে, যা অনেকটা ব্রোচ বা ক্লিপের মতো বস্তু পোশাকের জোড় এঁটে রাখার জন্য। প্রাচীন রোমে অস্ত্রোপচার দ্বারা দাসীদের বহিঃস্থ যোনি ওষ্ঠ (labia major) এই ফিবুলা দিয়ে সেলাই করে দেওয়া হতো যাতে তারা স্বাভাবিক যৌনতা ও সন্তানধারণে অক্ষম হয়। সহজে অনুমান করা যায়, অস্বাভাবিক অরুচিকর যৌনতায় তাদের বাধ্য করা হতো। সুদানে এই শল্য ইনফ্যাবুলেশনকে বলা হয় “Pharaonic Circumcision”, মিশরে এরই নাম “Sudanese circumcision” আর সোমালিয়ায় অল্পকথায় “qodob” বা ‘সেলাই করা’ ("to sew up"), যে কথাটির মধ্যে সেলাইয়ের আগে তিলে তিলে চালানো পৈশাচিকতার কিছুই ধরা পড়ে না।
আর অন্যান্য কাটাছেঁড়ার নাম ‘সুন্না’ (sunna) নামে পরিচিত। ভারতে এই সুন্না বা ‘সুন্নত’ শব্দটাই বেশি প্রচলিত, যার অর্থ ‘পথ’। একে ‘খতনা’ও বলা হয়। মোল্লারা সুন্নাকে ইসলামের অঙ্গ বলে দাবি করলেও কোরানে এর নির্দিষ্ট নির্দেশ নেই। এটা ওই অঞ্চলের প্রাচীন প্রথা, যা পুরুষদের লিঙ্গোন্মোচনের সহায়ক হলেও নারীদের পক্ষে যেমন যন্ত্রণাদায়ক তেমনই বিপজ্জনক।
চাহিদাটা পুরুষদের, কিন্তু তৎপরতা মেয়েদেরই বেশি। এই নারকীয় অত্যাচারের ভিত্তি হলো সতীত্ব, ঐতিহ্য, কৌমার্য ও সৌন্দর্য, যা মেয়েদের বশীভূত করতে অব্যর্থ। যেসব সমাজে ইনফিবুলেশন প্রচলিত, তাদের নারী-পুরুষ উভয়েই মনে করে স্ত্রী যৌনাঙ্গ অরুচিকর। তাছাড়া কোনো কোনো পুরুষ সেলাই করা স্ত্রী অঙ্গ জোর করে ভেদ করায় বেশি সুখানুভূতি লাভ করে। স্ত্রীঅঙ্গের স্বাভাবিক আর্দ্রতা ও পিচ্ছিলতা, যা সঙ্গমের সহায়ক, তাও নাকি দূর করে শুষ্ক রাখতে হবে। তাই Type-IV অঙ্গচ্ছেদের সময় যোনিতে পাতা, বাকল, টুথপেস্ট এমনকি ভিকস্ মলম পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
মেয়েদের বিয়ের আগে যৌনাচারের পথ বন্ধ করে, যৌনসুখ হরণ করে চরিত্র পবিত্র রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর সঙ্গে ধর্মের সমীকরণ রচিত হলেও মেয়েদের স্বাস্থ্যোন্নতির কোনো যোগ নেই; বরং অবর্ণনীয় যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু, বা বেঁচে থাকলে প্রস্রাব ও রজ নিঃসরণে তীব্র কষ্ট, ঘনঘন প্রস্রাবের অনুভূতি, রেচন ও জননাঙ্গে সংক্রমণ, বৃক্কে পাথর (kidney stone), জীবনভর পেটে যন্ত্রণা, সন্তানধারণে ও প্রসবকালীন জটিলতা ইত্যাদি মারাত্মক পরিণতির কথাই জানা যায়।
যারা এই বীভৎসতার শিকার, সেই মহিলাদের এই ব্যাপারে উৎসাহ উল্লেখযোগ্য। কাজটা কদাচিৎ পুরুষ ক্ষৌরকার করলেও সচরাচর কোনো বয়স্ক মহিলাকে দিয়েই করানো হয়। বেশিরভাগ পাঁচ বছর হওয়ার আগেই শিশুদের ওপর এই পৈশাচিক পবিত্রকরণের কাজটি সারা হয়। খুব দেরি হলে আঠেরো। বাড়ির মহিলারা সমাজে একঘরে হওয়ার ভয়ে নিজেরাই কন্যা বা নাতনির কোমল যৌনাঙ্গের স্পর্শকাতর অংশগুলো নৃশংস কাটাছেঁড়ায় উদ্যোগী হয়, তার আর্তচিৎকার, রক্তপাত, যন্ত্রণা সবকিছু উপেক্ষা করে। নৃতাত্ত্বিক রোজ় ওল্ডফিল্ড হেস (Rose Oldfield Hayes) জানিয়েছেন সুদানের শিক্ষিত বাবারা কন্যাদের clitoridectomy করে ভগাঙ্কুর বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী হলেও অত বীভৎস কাটা-ছেঁড়া-চাঁছা ও সেলাই করে যন্ত্রণা দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। কিন্তু কচি শিশুকন্যাদের ঠাকুমারা আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার নাম করে নাতনীদের সারা জীবনের জন্য যন্ত্রণা ভোগের ব্যবস্থা সেরে আসে।
স্ত্রীঅঙ্গে প্রচলিত যে-কোনো পদ্ধতির নির্যাতন চালানোর পর অব্যবহিত ফলশ্রুতি হলো প্রাণঘাতী রক্তপাত (bleeding), রক্তাল্পতা (anaemia), মূত্রনালীতে সংক্রমণ (urinary infection), সেপ্টিসিমিয়া (septicaemia), ধনুষ্টঙ্কার (tetanus), গ্যাংগ্রিন (gangrene), মাংসখেকো নেক্রোটাইজ়িং রোগ (necrotizing fasciitis বা flesh-eating disease), ও গর্ভান্তরীণ আস্তরণে সংক্রমণ (Endometritis)। তবে সেলাই করে ঢেকে ঘা শুকোনোর সুযোগ না দেওয়ায় Type-III FGM-এর ক্ষেত্রে যন্ত্রণা ও জটিলতা সবচেয়ে ভয়াবহ, যদিও ঘটনার তুলনায় রিপোর্টিং হয় অনেক কম। hepatitis B, hepatitis C ও HIV রোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায় বহুগুণ। পদ্ধতি ও অঙ্গহানির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে নিরবচ্ছিন্নকালে কিলয়েড, ফিসচুলা, রক্তনালীর সংকোচন, ত্বকে সিস্ট, জননাঙ্গে নিউরোমা, যোনিতে মূত্র ও মল প্রবেশ করে ভয়ানক ঘা ইত্যাদি নানাবিধ যন্ত্রণাদায়ক অসুখ হয়।
২০১৩-র মোট ১২,৬৭১ জন মহিলার ওপর ১৫টি সমীক্ষা চালিয়ে সংযুক্ত তথ্য বিশ্লেষণ (meta-analysis) করে দেখা গেছে ৫০% ক্ষেত্রে স্ত্রী-অঙ্গচ্ছেদ কামাবেগ ঘুচিয়ে দেয় এবং ৫২% ক্ষেত্রে স্বাভাবিক যৌনসঙ্গম রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে, যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় Dyspareunia বলা হয়। আর এক তৃতীয়াংশ নারীর যৌন অনুভূতিই সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, বুরকিনা ফসো, ঘানা, কেনিয়া, নাইজিরিয়া, সেনেগাল ও সুদানে ২৮টি প্রসূতিসদনে মোট ২৮৩৯৩ জন মহিলার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সদ্যোজাতর মৃত্যুহার (Neonatal mortality) প্রতি হাজারে অন্তত ১০-১২টি বেড়ে গিয়েছে প্রসূতির ওপর এই প্রকৃতিবিরুদ্ধ অত্যাচার অবদমনের ফলে।
তাছাড়া সেলাইয়ের পর প্রাণঘাতী রক্তপাত, ২-৩ মিলিমিটার ব্যাসের একটি ছিদ্র দিয়ে প্রস্রাব করা দুর্বিষহ কষ্টের হয়ে যায়। ফোঁটা ফোঁটা ও জ্বালাময় মূত্র নিঃসরণ, সবসময় মূত্রথলিতে জলবিয়োগের চাপ অনুভব, রজঃস্রাবে সমস্যা – ইত্যাদির সঙ্গেই সহাবস্থান করতে হয় ওইসব মেয়েদের। ঋতুস্রাব বাধা পেয়ে ঘটায় পেটে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও স্ফীতি। আর তার চিকিৎসা শুনবেন? চিকিৎসক আসমা এল ডারির (Asma El Dareer) জানান, ১৯৭৯ সালে এফজিএম-এর কারণে ঋতুবন্ধকে গর্ভধারণ ভেবে সুদানে একটি মেয়েকে তার পরিবার হত্যাও করে ফেলে।
UNICEF প্রদত্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩-য় আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় বসবাসকারী অন্তত ১২.৫ কোটি (125 million) মেয়ের এই নারকীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। [44] জননাঙ্গ কাটার বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার সত্ত্বেও ২০১৬-তেও ২৭টি আফ্রিকান দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ইরাকি কুর্দিস্থান ও ইয়েমেন মিলিয়ে মোট ৩০টি দেশে কমপক্ষে ২০ কোটি (200 million) সুন্নত করা মহিলার সন্ধান পাওয়া গেছে। [45] এরা হলো বীভৎসতা সহ্য করেও যারা জীবিত। যন্ত্রণা, রক্তপাত বা পরবর্তী রোগ সংক্রমণে কতজন মারা গিয়েছে, তার হদিশ এই পরিসংখ্যানে নেই।
১৯৮০ পর্যন্ত সুন্না বা circumcision কথাটাই প্রচলিত ছিল, [46] যেন পুরুষের সুন্নত ও মেয়েদের জননাঙ্গ কাটাছেঁড়া সমতুল্য ব্যাপার। ১৯৭৫ সালে আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক রোজ় ওল্ডফিল্ড হেস (Rose Oldfield Hayes) তাঁর American Ethnologist-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে প্রথম female genital mutilation বা স্ত্রী জননাঙ্গহানি বা স্ত্রীঅঙ্গ বিকৃতি কথাটা ব্যবহার করেন। পরে অস্ট্রেলীয় আমেরিকান নারীবাদী লেখিকা ফ্র্যান হস্কেন (Fran Hosken) পুনরায় mutilation অর্থাৎ অঙ্গহানি বা অঙ্গবিকৃতি শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁর বিখ্যাত The “Hosken Report: Genital and Sexual Mutilation of Females” রচনায়। [48] বর্তমানে FGM-কে লিঙ্গবৈষম্যের বীভৎসতম রূপ হিসাবে দেখা হয়। ১৯২৯ সাল থেকে কেনিয়ার Kenya Missionary Council এই প্রথাকে ‘নারী যৌন বিকৃতিকরণ’ (Sexual Mutilation of Women) হিসাবে বিরোধিতা করে এসেছে যাতে পরবর্তীতে Scotland missionary-র Marion Scott Stevenson চার্চও শামিল হয়।
যদিও ইসলামে নারীর সুন্নত বাধ্যতামূলক নয় এবং স্ত্রী-অঙ্গহানির প্রথম নজির নাকি উত্তর-পূর্ব এশিয়াতেই মিলেছে, তবু মুসলিম বিশ্বেই এই প্রথার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা, যার শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া। UNICEF-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৫-৪৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে সোমালিয়ায় ৯৮%, মালিতে ৮৯%, সিয়েরা লিওনে ৮৮%, সুদানে ৮৮%, গাম্বিয়ায় ৭৬%, বুরকিনা ফাসোয় ৭৬%, ইথিওপিয়ায় ৭৪%, মউরিটেনিয়ায় ৬৯%, লিবিয়াতে ৬৬% এবং গিনি-বিসাউ দেশে ৫০% শিশুকন্যা বা নারী কোনো না কোনো প্রকার জননাঙ্গহানি ও বিকৃতির বলি।
২০১৩-য় মিশরে ২৭.২ মিলিয়ন, ইথিওপিয়ায় ২৩.৮ মিলিয়ন ও নাইজিরিয়ায় ১৯.৯ মিলিয়ন মেয়ে এই প্রথাগত অত্যাচারের শিকার হয়। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ১৩.৪ মিলিয়ন বা ০-১১ বছরের শিশু ও বালিকার ৪৯ শতাংশেরই জননাঙ্গ বিকৃতি ঘটানো হয়। ইন্দোনেশিয়ায় চলে Type-I ও অন্যতম বীভৎস Type-IV স্ত্রী জননাঙ্গহানি।
প্রথাটি কিছুটা কম হলেও প্রচলিত কলোম্বিয়া, কঙ্গো, মালয়েশিয়া, ওমান, পেরু, সৌদি আরবিয়া, শ্রীলঙ্কা ও সংযুক্ত আরবে (United Arab Emirates)। তাছাড়া ইসরায়েলর বেদুইন, জর্ডনের রাহমাহ (Rahmah) এবং ভারতের ‘দাউদি বোহরা’ (Dawoodi Bohra) সম্প্রদায়ের মধ্যেও নারীর অঙ্গের ছেদন বা সেলাইয়ের প্রথা রয়েছে। আর পরিযায়ী বা শরণার্থী সম্প্রদায়গুলির মাধ্যমে তো সারা বিশ্বেই এই নোংরা নৃশংস প্রথা ছড়িয়ে পড়েছে।
নির্যাতিতা সংখ্যায় মুসলিম মহিলারা শীর্ষে হলেও সমাজবিজ্ঞানী গেরি ম্যাকি (Gerry Mackie) মনে করেন পিতৃতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে ইসলাম আগমনের বহু পূর্বে ৮০০-৩৫০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে সুদানের মেরোইট সভ্যতা বিকাশের সময় যৌনাঙ্গচ্ছেদ প্রথাটির উদ্ভব হয়েছিল। ঐতিহাসিক মেরি নাইট (Mary Knight) বলেছেন, প্রাচীন মিশরের ১৯৯১-১৭৮৬ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে ১১১৭ বছর সময়কালের মিশরীয় কফিনের চিত্রলিপি (hieroglyphs) সম্ভবত কোনো মেয়ের স্ত্রী-জননাঙ্গ বিকৃতিকরণের কথা লিখেছে। রাইট মমি পরখ করে জানিয়েছেন স্ত্রীদেহের মমিগুলোর যৌনাঙ্গের সঙ্গে Type-III FGM মানে ইনফিবুলেশন বা সেলাই করা জননাঙ্গের মিল আছে। সেই সঙ্গে টাইপ-১ ও ২ও করা হয়ে থাকতে পারে, যা এখন স্পষ্ট নয়।
বোঝা যাচ্ছে এই নোংরা পৈশাচিকতার উৎস প্রাচীন মিশর বলেই টাইপ-৩ বিকৃতিকরণ ‘ফারাওনিক ইনফিবুলেশন/সেলাই’ (Pharaonic Infibulation) বা ‘ফারাওনিক সুন্না’ (Pharaonic Circumcision) নামেও পরিচিত। প্রাচীন মিশরে মেয়েদের গৃহকর্ম ছাড়া শিক্ষা লাভের অধিকারও ছিল না। সম্রাট বা ফারাওয়ের পিরামিডে তার স্ত্রীরা তো বটেই দাসদাসীরাও জীবন্ত প্রবেশ করে সহমরণে যেত। অবস্থা ভালো ছিল, এই মিথ গঞ্জিকাসেবন ব্যতীত বিশ্বাস করা অসম্ভব।
শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকানরা নয়, ১৯ শতকের ইওরোপ ও আমেরিকার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরাও মহিলাদের মানসিক অসুখ ও আত্মরতির অভ্যাস সারানোর জন্য ভগাঙ্কুর কেটে বাদ দিত। ১৮১৩ সালে জনৈক ইংরেজ চিকিৎসক রবার্ট থমাস (Robert Thomas) অস্ত্রোপচার দ্বারা ভগাঙ্কুর বিযুক্তি (clitoridectomy) করে নারীর nymphomania বা অতিরিক্ত কামাবেগ সারানোর বিধান দেন। [57] [58] ১৮২২ সালে বার্লিনে অতিরিক্ত আত্মরতি (masterbate) করার অপরাধে কার্ল ফাডফনান্ড ভন গ্রেফ (Karl Ferdinand von Graefe) ১৫ বছর বয়সী এক জার্মান কিশোরীর ক্লিটোরিডেকটমি করে “সুস্থ” করে তোলেন। [59] [58] ছেলেরা এসব করলেই স্বাভাবিক।
ব্রিটিশ স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ও Medical Society of London-এর যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট আইজ়াক বেকার ব্রাউন (Isaac Baker Brown) সুযোগ পেলেই মেয়েদের ক্লিটোরিস কেটে বাদ দিতেন। তাঁর মতে মেয়েদের হিস্টিরিয়া, স্নায়বিক অস্বস্তি, জ্ঞান হারানো, মৃগী, বোকামি, বাতিক এমনকি মরণরোগের কারণ হলো হস্তমৈথুন বা আত্মরতি, যার কারণ ভগাঙ্কুরে অস্বাভাবিক স্পর্শকাতরতা।
মেয়েরা কতজন হস্তমৈথুন করে সেই জানা নেই, তবে ছেলেদের ধারেকাছে নয়, বলা বাহুল্য। আর কেউ করলেও কোনো চরম সুখলাভ সবসময় সম্ভব হয় না। তবু তাকে চিরকালের মতো সুখানুভূতিহীন করে যন্ত্রণাভোগ করতে বাধ্য করাই হলো আসল দাওয়াই। ১৮৫৯-১৮৬৬ সালের মধ্যে কত মেয়ের যে কামজ্বালা জুড়িয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর অনুগামী জনৈক মার্কিন ডাক্তার ১৮৬২ সালে ব্রাউনের অনুপ্রেরণায় গর্ভ ও ক্লিটোরিস কাটাকুটি করে যথোপযুক্ত শল্যচিকিৎসা শুরু করেন। এই কৃতিত্ব প্রকাশিত হলে তাঁকে Obstetrical Society থেকে বহিষ্কার করা হয়।
কিন্তু তারপরেও ১৯ শতকের শেষের দিকেও নিউ অরলিনে একটি দুই বছরের শিশুকন্যা হস্তমৈথুন করেছে অপবাদে নিজের কচি ভগাঙ্কুরটি হারায়। শুধু তাই নয়, ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত Obstetrical & Gynecological Survey-র একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, মেয়েদের হিস্টিরিয়া, সমকামের চিকিৎসায় এমনকি নিজেকে কারও প্রেমাস্পদা ভেবে বুঁদ হয়ে থাকার (erotomania) অপরাধেও এলোপাথাড়ি ক্লিটোরিডেকটমি করা হয়েছে ১৯৫০-৬০-এর দশকেও। [ মেয়েদের মানসিক ব্যাধির কারণ যে বঞ্চনা, অত্যাচার ও অবদমন, তার প্রতিকার যখন সম্ভব নয়, তখন তাদের নিজস্ব চাহিদাহীন, পুরুষের কাম-আজ্ঞাপালনকারী যন্ত্রে রূপান্তরিত করা যাক।
ওহিও রাজ্যের ডেটনের এক গাইনি জেমস্ বার্ট (James Burt) সন্তান প্রসবের সময় episiotomy করে মায়েদের যোনি চিরতে হলে পরে তাতে অতিরিক্ত সেলাই দিয়ে সংকুচিত করে দিতেন ও ভগাঙ্কুর বাদ দিয়ে দিতেন। কখনও বা কাটাকুটি করে যোনি ও মূত্রদ্বারের অবস্থান পুনর্বিন্যাস করতেন, যার নাম ছিল "love surgery" – প্রেমাস্ত্রোপচার! তাঁর মতে এভাবে নারীদেহকে স্বাভাবিক আদর্শ ভঙ্গীতে (missionary position) যৌন মিলনের বেশি উপযুক্ত করে তোলা যায়। [69] ১৯৭৫ সালের মধ্যে পুরুষদের অতিরিক্ত হর্ষোৎপাদনের মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি রোগীর বা রোগীপক্ষের মতামত না নিয়ে কমপক্ষে ৪০০০ মহিলার স্ত্রী-অঙ্গ নিয়ে খেয়ালখুশি পরীক্ষা চালান বলে নিজেই গর্ব করেছেন। তবে এত মহৎ সমাজসেবার পুরস্কারস্বরূপ ১৯৮৯ সালে তাঁর চিকিৎসার অনুমোদন কেড়ে নেওয়া হয়।
ইস্তাম্বুল অধিবেশনের ঘোষণার ৩৮ নং ধারায় এই বর্বরতার সবকটি পদ্ধতি, যার মধ্যে প্রসবের পর পুনরায় যোনি-ওষ্ঠ সেলাই করে দেওয়াও পড়ে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ২০১৬ সালে বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশ যেমন বেনিন, বুরকিনা ফাসো (Burkina Faso), সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, চাদ (Chad), কোট ডি’আইভরি (Côte d'Ivoire), জিবুতি (Djibouti), মিশর (Egypt), এরিট্রীয়া (Eritrea), ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, ঘানা, গিনি, গিনি বিসাউ (Guinea Bissau) ও কেনিয়ায় FGM ক্ষতিকর ঐতিহ্যগত প্রথা (harmful traditional practice) বলে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও, নিয়ন্ত্রণ খুবই শিথিল।
উপরন্তু বিশ্বায়নের জোয়ারে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশগুলি আলোকস্নাত না হলেও অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতেও। তাই অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও স্ত্রী-অঙ্গচ্ছেদের প্রথা ডালপালা ছড়াচ্ছে, কখনও প্রথারূপে কখনও বা চিকিৎসার ছদ্মেবেশে। যেমন উত্তর আমেরিকায় ৫১৩,০০০ জন মহিলা ও বালিকার হয় যৌনাঙ্গচ্ছেদ হয়ে গেছে কিংবা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা বলতে গোপনে বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজন দ্বারা বিক্ষত হওয়াই শুধু নয়, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য বা ইন্দোনেশিয়ায় দেশের বাড়ি নিয়ে গিয়ে মহৎ কর্মটি সেরে আসার সম্ভাবনাও নিহিত। যেমন কানাডায় এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা নজরে এসেছে।
ইওরোপিয়ান পার্লামেন্ট (European Parliament)-এর সমীক্ষা জানাচ্ছে, ইউরোপের অন্তত ৫,০০,০০০ জন মহিলা ও শিশুকন্যা বা বালিকার ২০০৯-র আগে ইতিমধ্যে জননাঙ্গহানি হয়ে গেছে। দুস্থ দেশের বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিতে গিয়ে ফ্রান্স তো নিজেই রীতিমতো বিপন্ন। যখন তখন জেহাদি আদর্শে অনুপ্রাণীত হয়ে সেখানকার শিক্ষিত মেয়েরা আরব দেশে শুধু চালান যায় না, জননাঙ্গহানির মতো বিভীষিকা সেখানেও ছড়িয়ে পড়ছে। মুক্তচিন্তার ফরাসি দেশে প্রায় ৩০,০০০ মেয়ের ১৯৯৫ সালের আগেই অঙ্গহানি হয়ে গেছে। ফলে চলেছে আইনি কড়াকড়ি, ৬ বছরের নীচে সমস্ত শিশুর জননাঙ্গ তদন্ত (inspection of the genitals), নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা। পাশাপাশি জননাঙ্গহানি থেকে রক্ষা বা জননাঙ্গহানির শিকার মেয়েদের আশ্রয়দানের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে বসবাসকারী অন্তত ১,৩৭,০০০ জন নারী ও শিশু আছে যাদের ২০১১ সাল পর্যন্ত জন্ম হয়েছে স্ত্রী-জননাঙ্গ ঘাতক দেশে। ফলে যেসব দেশে স্ত্রী জননাঙ্গ বিকৃতকরণের ঐতিহ্যগত চল নেই, সেখানেও আইন আনতে হয়েছে প্রথাটির ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করতে।
সুইডেন হলো প্রথম পশ্চিমী দেশ যা FGM নিষিদ্ধ করে ১৯৮২ সালে। তারপর বেলজিয়াম, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডও নতুন আইন নিয়ে আসে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার বাইরেও মোট ৩৩টি দেশে এই বর্বরতার প্রচলন না থাকলেও শরণার্থী, স্থানান্তরণ ও অনুপ্রবেশের জেরে সংশ্লিষ্ট সরকার এফজিএম বিরোধী আইন আনতে বাধ্য হয়েছে।
এদিকে ভারতবর্ষে বোহ্রা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত হলেও তাকে নিষিদ্ধ করার মতো আইন এখনও নেই। এই গোষ্ঠীর কাছে মেয়েদের ক্লিটোরিস হলো ‘হারাম কী বোটী’ ('source of sin') অর্থাৎ ‘পাপের উৎস’, একটি ‘অনৈতিক’ ও ‘অবাঞ্ছিত চামড়া’। এই অংশটি থাকলে নারী নিজের দেহে নিষিদ্ধ সুখের সন্ধান পেয়ে যাবে, আর গেলেই বেপথুগামী হবে।
https://www.hrw.org
অকাট্য যুক্তি! যৌনতার সন্ধানে নারীই তো বিপথগামী হয় – একাধিক বিয়ে করে, ‘অ্যাডাম টিজ়িং’ করে, যৌনদাস রাখে, দশজনে মিলে একজন পুরুষকে ছিঁড়ে খায়, ভোগ করা পুরুষটিকে হত্যা করে নৃশংস উপায়ে। ভারতবর্ষে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নারীদেহে খতনা বিরোধী আইন নেই, ধর্মনিরপেক্ষতার সৌজন্যে সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ! উল্টে অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমী দেশগুলোয় স্ত্রী-অঙ্গহানি নিষিদ্ধ হওয়ায় বোহ্রা মুসলিমরা নিজেদের মহান ঐতিহ্য রক্ষার্থে ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। ব্যাপারটা এদেশেও সহস্র বছরের, কিন্তু এতটাই গোপন রাখা হয়েছে, যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের FGM প্রভাবিত দেশের তালিকায় ভারতের নামই নেই; শোরগোল, প্রচার বা সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা তো দূরের কথা।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের Committee on the Elimination of Discrimination against Women (CEDAW) সংস্থাটি প্রতিটি সরকারকে ২০১৩-র মধ্যে এই জাতীয় অপরাধে কড়া আইনি পদক্ষেপ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও বিপুল সংখ্যক ঘাতক আইনের নজরদারি এড়িয়ে বা ফাঁক গলে পার পেয়ে যাচ্ছে, আর মেয়েরা বলি হতেই থাকছে। ইউনিসেফ (UNICEF) ২০১৪-র একটি প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, "If there is no reduction in the practice between now and 2050, the number of girls cut each year will grow from 3.6 million in 2013 to 6.6 million in 2050…If nothing is done, the number of girls and women affected will grow from 133 million today to 325 million in 2050. However, if the progress made so far is sustained, the number will grow from 133 million to 196 million in 2050, and almost 130 million girls will be spared this grave assault to their human rights."
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার অনেক নৃতাত্ত্বিক এমনকি মহিলারাও cultural relativism বা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা আর সার্বিক মানবাধিকারের ধুয়ো তুলে এই বীভৎসতার পক্ষেও অবস্থান নিচ্ছে। কিন্তু যে হারে প্রথাটি সারা বিশ্ব গ্রাস করছে, তাতে সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা কি আদৌ রক্ষিত হচ্ছে? এই কালচারাল রিলেটিভিজ়ম ও স্বাধীনতার দাবি মানলে হিন্দু সমাজের সতী প্রথাও আজও নিষিদ্ধ ঘোষিত হতো না।