যাকে বলে চরণকমল, এর আক্ষরিক নাম তাই। তবে আমাদের ‘লক্ষ্মী লক্ষ্মী পা’ বা ‘Daity Feet’-এর মতো স্বাভাবিক সুন্দর গড়ন গঠনের সঙ্গে মেলালে ভুল হবে। চিন দেশে প্রচলিত বাচ্চা বয়স থেকে পায়ের পাতা বেঁধে রাখার পর যে পা দুটি যে চলৎশক্তিহীন বিচিত্র বিকল অঙ্গে পরিণত হয়, তারই নাম পদ্ম পা বা lotus feet। মনে করা হয় সং রাজবংশের (Song dynasty) শাসনকাল থেকে মর্যাদা ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসাবে বিকশিত হয় এই প্রথা, যা প্রচলিত ছিল বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত।[1] বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বারবার কড়া নিষেধাজ্ঞার জেরে এমন অনুপম দৃশ্য এখন একেবারে বিরল বা অবলুপ্তই হয়ে গেছে।
৫০১ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে গত সম্রাট জিয়াও বাওজুন (Xiao Baojuan) মেঝেতে চিত্রিত পদ্মের ওপর জনৈক নর্তকীকে নাচতে দেখে মুগ্ধ হন, যেন তার বৌদ্ধ কিংবদন্তী পদ্মাবতীর মতো প্রতি পদক্ষেপে পদ্ম বিচ্ছুরিত হচ্ছিল ("lotus springs from her every step!"/ 步步生蓮)। সম্ভবত এই গল্পটিই ‘সোনালি পদ্ম’ ও ‘পদ্ম পা’ ("golden lotus" or "lotus feet") পদ তথা ধারণা দুটির জন্ম দেয়, যা বাঁধানো পা সম্পর্কে প্রযুক্ত হতে থাকে। [2]
তার অনেক পরে দশম শতাব্দীতে সং রাজত্বের ঠিক আগে দক্ষিণ ট্যাং (Southern Tang)-এর তেন বংশীয় সম্রাট লি ইউ (Emperor Li Yu) একটি ছ ফুট লম্বা রত্নখচিত সোনার পদ্ম নির্মাণ করান এবং নিজের রক্ষিতা ইয়ো নিয়াংকে (Yao Niang) সাদা রেশমে (white silk) চাঁদের আকৃতিতে পায়ের পাতা বেঁধে আঙুলের ডগায় দাঁড়িয়ে ব্যালে জাতীয় কোনও নাচ করার হুকুম দেন। [1] অষ্টাদশ শতাব্দীর একটি ছবিতে ইয়ো নিয়াংয়ের নিজের পা বাঁধার এই দৃশ্য ধরা আছে। সেই নাচ নাকি এতটাই সুন্দর স্বচ্ছন্দ হয়েছিল, যে বাকিরা তাকে অনুকরণ শুরু করে দেয় এবং কালক্রমে সং রাজত্বকালে সৌন্দর্যচর্চা হিসাবে অভিজাত মহিলাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। [3] অর্থাৎ পুরুষদের মনোরঞ্জনে নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারা মেয়েরা নিজেরাই শুরু করে দেয়।
তারও পরে কুইং বংশের (Song dynasty) শাসনকালে এই প্রথা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে, যা কঠোরতম রূপ নেয় ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ যখন মাত্র “তিন-ইঞ্চি সোনালি পদ্ম ("three-inch golden lotus") পায়ের উল্লেখ পাওয়া গেছে। অবশ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পদ্ধতি ও প্রাবল্যের কিছু তারতম্য বরাবর থেকেছে। মাঞ্চু রাজারা কিন্তু ১৬৩৬-৬৪ সালের মধ্যে কমপক্ষে তিনবার এই নিপীড়ন বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু তেমন সাড়া না পেয়ে কুইং বংশের রাজা কাংশি (Kangxi Emperor) ১৯৬৪ সালে সংস্কারের চেষ্টা ছেড়ে দেন। [1] এর জেরে উনিশ শতকের মধ্যে ৪০-৫০% ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ১০০% চিনা মেয়ের পা বাঁধানো হয়ে গিয়েছিল। [4]
এরপর একাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হয় বাঁধা পায়ের গুণগান, কবিতায় ও গদ্যে ফুটে ওঠে বাঁধানো পায়ের আদর্শ আকার আকৃতির বর্ণনা। [5][6][7] ত্রয়োদশ শতকে চে রোউশুই (Che Ruoshui) নাকে এক পণ্ডিতের লেখায় প্রথম এই প্রথার নিন্দা ধ্বনিত হয়: "Little girls not yet four or five years old, who have done nothing wrong, nevertheless are made to suffer unlimited pain to bind [their feet] small. I do not know what use this is." [9][10][11]
প্রাচীনতম পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হল ১২৪৩ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে মারা যাওয়া হু্য়াং শেং (Huang Sheng) ও ১২৭৪-এ গত ম্যাডাম ঝ়োউ (Madame Zhou)-এর সমাধি, যেখানে দেখা যায় উভয়েরই পায়ের পাতা ৬ ফুট লম্বা গজ দ্বারা বাঁধা ছিল। ঝোউয়ের কঙ্কালের পায়ে আবার একটা ছুঁচোলো মাথার ছোট্ট জুতো পরানো। [12][13]
সং রাজবংশের সমাধিতে পাওয়া বাঁধানো পায়ের বুড়ো আঙুল ওপর দিকে বাঁকিয়ে তোলা, যে গড়নের সঙ্গে পরবর্তী পর্যায়ের পদ্ম-পায়ের বিশেষ মিল নেই। সং রাজত্বে আবার পুরুষরা স্বর্ণালী চরণকমলের সম্মানে ("toast to the golden lotus") জুতোর গোড়ালিতে রাখা পানপাত্রে এবং ইউয়ান বংশের (Yuan dynasty) সময় সরাসরি জুতোয় ঢেলে মদ্য পান করত, যে রীতি কুইং বংশের (Qing dynasty) রাজত্বকাল পর্যন্ত চলেছিল।[14] পূর্ণাঙ্গ পায়ের পাতাকে স্থূল এবং খর্বকৃত চরণকে সুন্দর জ্ঞানে লোকদেখানো আদিখ্যেতার রেওয়াজ তখন থেকেই।
জনৈক ইটালিয়ান মিশনারি ওরডিক অব পোর্ডেনন (Odoric of Pordenone) প্রথম চতুর্দশ শতকে ইউং রাজত্বের [15] সময় পা-বাঁধাই প্রথার উল্লেখ করেন, যেখানে অন্যান্য পর্যটক যেমন ইবন বতুতা বা মার্কো পোলো মেয়েদের খুব ছোট ছোট নড়বড়ে পদক্ষেপ লক্ষ্য করলেও তার কারণ নিয়ে কিছু লিখে যাননি। সম্ভবত তখনও প্রথাটা ততটা ব্যাপক ও ভয়াবহ ছিল না। [16] পরে মোঙ্গল শাসকরা চিনা প্রজাদের এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ বা প্ররোচনা দিতে শুরু করে। অভিজাত মহলের এই মর্ষকামী সৌন্দর্যচর্চা বা আত্মপীড়ন ক্রমশ সাধারণ পরিবার থেকে থিয়েটার অভিনেত্রী – সর্বস্তরে মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মিং রাজত্বে (Ming period) তা হয়ে ওঠে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। [17][18][19] অথচ পা-বাঁধানোর ফলে মেয়েদের চলৎ শক্তি কমে যাওয়ায় চিনের নৃত্যকলায় ভাঙন ধরে। সং যুগের পর তো পদ্ম-চরণ সুন্দরীদের মধ্যে ভালো নর্তকী পাওয়াই বিরল হয়ে দাঁড়াল। [20][21]
পা-বাঁধাইয়ের জন্য পদ্ম জুতোগুলোর (lotus shoe for bound feet) আদর্শ মাপ ৩ চিনা ইঞ্চি যা পাশ্চাত্য মাপে ৪ ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার মতো। [22][23] ছোট বাঁধা পা পতিলাভেও সহায়ক। উনিশ শতাব্দীতে গুয়ানডং (Guangdong) প্রদেশে গরিব পরিবারগুলোয় বাড়ির বড়ো মেয়ের পা বেঁধে ফেলা হোত উপযুক্ত পাত্রে সন্ধানে। আর স্বাভাবিক পদচারণায় সক্ষম তার অনুজাদের ক্ষেত-খামারে কঠোর পরিশ্রম ও দিনরাত সাংসারিক দাসত্ব (domestic slavery) করতে হোত। ছোট বিকৃত পদগর্বে গর্বিত কন্যাদের কোনও কাজকর্ম করতে হোত না, তাদের স্বামীদেরও বিশেষ শ্লাঘার বিষয় ছিল পদ্ম-পা, বিশেষত ৪ ইঞ্চির আদর্শ পদ্ম পা হলে কথাই নেই। সূচীকর্মে নক্শাদার জুতো বা আবরণ ছিল সেই গর্বের ভূষণ।[24]
অনেক মহিলাই জুতোর সাহায্য ছাড়া চলতেই পারত না, আবার কাউকে কাউকে ঐ পা নিয়েই মাঠে ঘাটে কাজ করতে হোত। এত অসুবিধা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত নর্তকী, সার্কাস শিল্পীদের মধ্যে বাঁধানো পায়ের রীতিমতো জনপ্রিয়তা ছিল। ইউনান (Yunnan) প্রদেশের একটি গ্রামে খুদে পায়ের মাহিলাদের একটি বিশেষ নাচের দল ছিল অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ। [25][26] বর্তমানে ৭০-৮০ পার করা এই মহিলাদের পা কৌতুহল উদ্রেগকারী অবশ্যই, কিন্তু সুন্দর কিনা সেটা পদ্ম-পায়ের নির্মাণ পদ্ধতি ও পরিণতি দেখলে টের পাওয়া যাবে।[4]
সাধারণত ঘরোয়া কাজ করা মেয়েদেরই পা বাঁধা হোত, যেখানে খেত-খামারে কঠোর শ্রম করা মেয়েদের পা নিয়ে আদিখ্যেতা করার উপায় ছিল না। [27] তাই এর প্রচলন শহরাঞ্চলেই বেশি। দক্ষিণের চেয়ে উত্তর চিনে এর বেশি প্রচলন ছিল। ১৮৮০-র দশকে মাঞ্চুরা ‘পুষ্পপাত্র জুতো’ ("flower bowl" shoes) তৈরি করেছিল ‘পদ্মজুতো’-র অনুকরণে। কাঠের ব্লক দিয়ে তৈরি পুষ্পপাত্র জুতোকে (花盆鞋) ‘অশ্বক্ষুরাকৃতি জুতোও’ ("horse-hoof" shoes (馬蹄鞋)) বলা হয়। তবে মাঞ্চু, মোঙ্গল ও আটটি উচ্চকোটি (“Eight Banners”) গোষ্ঠিভুক্ত মেয়েরা কঠোরভাবে পা না বেঁধে শুধু সরু করে রেখে প্ল্যাটফর্ম হিল পরে হেলেদুলে চলত।[28] নিম্মকোটি মামুলি মহিলারা অনেক সময় পা বাঁধার যন্ত্রণাদায়ক ফ্যাশন থেকে রেহাই পেত, যদি না তাদের পরিবারের আভিজাত্যের বাসনা জাগে। বাঁধানো পদ্ম-পা কার্যত হ্যান ও মাঞ্চুসহ অন্যান্য অকুলীন মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ সনাক্তকরণ চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।[28]
অন্যান্য অ-হ্যান (non-Han) প্রজাতিগুলি যেমন তিব্বতী (Tibetans) বা হ্যান হলেও ‘হাক্কা’ (Hakka) গোষ্ঠির মেয়েরা পা বাঁধতো না। [29] তবে কিছু অ-হ্যান উপজাতি যেমন গানসু প্রদেশের (Gansu) হুই মুসলিম (Hui Muslims)[30] ও তাদেরই উত্তরসূরী উত্তর-পশ্চিম চিনের পরবর্তীতে মধ্য এশিয়ায় পালিয়ে যাওয়া ডানগান মুসলিমদের (Dungan Muslims) মধ্যে ১৯৪৮ পর্যন্ত মেয়েদের পা-বাঁধানোর রীতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। [31] অথচ জেমস্ লেগ (James Legge) নামে এক স্কটিশ পণ্ডিত লক্ষ্য করেন, দক্ষিণ চিনে গুয়াংঝোউ (Guangzhou) অঞ্চলে মসজিদের গায়ে ঝোলানো প্ল্যাকার্ডে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে বিকৃত করে বলে পা-বাঁধাই নিন্দিত হয়েছে। [32] এই মন্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যায়, বাহ্যিক স্ত্রী যৌনাঙ্গহানির মতো মারাত্মক বিপজ্জনক ও নিষ্ঠুর বিকৃতি যা বহু ইসলামিক রাষ্ট্রে কোরানে নির্দেশ না থাকলেও মুসলমানিকরণের নামেই চলেছে, তা চিনে প্রচলিত নয়।
পদ্ম পা নির্মাণের এই ইতিহাস ভূগোল থেকে প্রথাটির নিষ্ঠুরতা কিছুই ধরা পড়ে না। কিন্তু ছবি দেখলেই গা শিউরে ওঠে। পা-বাঁধাইয়ের নানা পদ্ধতি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সরল হল সিচুয়ান (Sichuan) অঞ্চলে প্রচলিত শশার মতো সরু আকৃতির পা-বাঁধাই। একে বলা হয় ‘শশা পদ’ বা "cucumber foot" (huanggua jiao) যাতে শুধু দু-পায়ের চারটি আঙুলকে ভেঙে পায়ের তলায় গুঁজে চেপে বেঁধে দেওয়া হয়, গোড়ালি বা গোছের কোনও ক্ষতি করা হয় না। [33] জিয়াংসু (Jiangsu) অঞ্চলের মহিলারা যাদের পা স্বাভাবিক রয়ে গেছে, তারা আবার লোকলজ্জায় পা-বাঁধা আছে ভান করে খুঁড়িয়ে হাঁটে। [34] তেমন গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া পা বাঁধানো মেয়েদের হয় সারা জীবন কিংবা ভাগ্য ভালো হলে বিয়ে পর্যন্ত পায়ে জবরজং ব্যান্ডেজ ও জুতো নিয়ে ঘুরতে হোত। [35][36] অবশ্য জুতো ও ব্যাণ্ডেজের ঠেক ছাড়া দাঁড়ানও মুশকিল ছিল। এই বাঁধানো পা শুধু মর্যাদা ও সৌন্দর্য নয়, পুরুষদের কাছে নাকি বিশেষ যৌন আকর্ষণেরও কারণ ছিল।
সৌন্দর্যায়ন প্রক্রিয়া শুরু হোত পায়ের বাঁক (arch) তৈরি হওয়ার আগেই মোটামুটি ৪ থেকে ৯ বছর বয়সের মধ্যে। [37] সাধারণত শীতকালে যখন হাত পা অসাড় হয়ে থাকে এবং যন্ত্রণাবোধ কম হয়। নিরক্ষীয় উষ্ণমণ্ডলের সহনীয় শীতে অবশ্য হাড়ে অল্প লাগলেই যন্ত্রণাবোধ প্রবল হয়। প্রথমে পায়ের পাতা দুটি প্রাণীর রক্ত ও কিছু ভেষজের (Herbs) মিশ্রণে ভিজিয়ে নরম করা হয়। তারপর পায়ের নখগুলো যতটা সম্ভব ছোট করে কাটা হয় যাতে ভেতরে তাদের বৃদ্ধি ও সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে। অতঃপর আন্দাজ ৫ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৩ মিটার লম্বা কাপড়কে রক্ত ও ভেষজ মিশ্রণে ভিজিয়ে দিয়ে পা চেপে নীচের দিকে বাঁকিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়। পায়ের আকার ছোট রাখার জন্য আঙুলগুলো বাঁকিয়ে ভেঙে পায়ের তলায় লেপ্টে দেওয়া ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায়ের মধ্যিখানের খাঁজও (arch) জোর করে ভেঙে দেওয়া হয়। ব্যান্ডেজর্টিকে ইংরেজি ৮ (figure-eight) আকারে বারবার পেঁচিয়ে কচি স্বাভাবিক পাকে ‘সুন্দর’ ও ‘আকর্ষণীয়’ করে তোলা হয়। এই বজ্র আঁটুনির ফলে এমনিতেই পায়ের আঙুল নাড়ানোর উপায় থাকে না, তার ওপর জবরদস্ত সেলাইও দেওয়া হয় যাতে বাচ্চাটি বাঁধন আলগা করতে না। সারা বিশ্বের প্রচলিত সৌন্দর্যের ধারণার সঙ্গে এই বিকৃতির কোনও মিল না থাকলেও চিনের মা দিদিমারা ‘ভালো’ জামাই ও সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য এইভাবে কচি কচি মেয়েগুলোকে জোর করে অলিখিত বিউটি কনটেস্টে নামিয়ে দিত। ৪ ইঞ্চি (চিনা ৩ ইঞ্চি) মাপের সবচেয়ে ছোট পায়ের নাম সোনালি পদ্ম (golden lotuses), তার চেয়ে একধাপ কম ছোট হল রজত পদ্ম (silver lotuses)।
এই ভাঙা পাকে যথেষ্ট পরিচর্যাও করতে হোত। বাঁধন খুলে নিয়মিত ধোয়া, নখ কাটা, ঘা হয়েছে কিনা পরখ করা তো ছিলই, সেই সঙ্গে অস্থি-সংযোগগুলো নমনীয় রাখতে পা দুটোকে পেটানোও হোত। তারপর ঘা সংক্রমণ সারাতে ওষধি মিশ্রণ (concoction) প্রয়োগ করেই ভাঙা আঙুলগুলো পুনরায় মুড়ে আবার বজ্র আঁটুনি।[38] ধনী পরিবারে প্রায় প্রত্যহ একবার, আর দরীদ্র কৃষক পরিবারে দু-তিন সপ্তাহে একবার করে এই খোলা-বাঁধার পর্ব চলত। বলা বাহুল্য, প্রাথমিক হাড় ভাঙার চেয়েও ভাঙা হাড় আবার মুচড়ে ভেঙে বাঁধা আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। [39] হয় পরিবারের কোনও বয়স্ক মহিলা কিংবা পেশাদার পা-বাঁধাইকারিনী পায়ে পাতা ভাঙা ও বাঁধার দায়িত্ব পালন করত। সচরাচর কাজটা মাকে দিয়ে করানো হোত না, কারণ মেয়ের যন্ত্রণা দেখে সে দুর্বল হয়ে বাঁধন আলগা রাখতে পারে। [40] অবশ্য পুত্রসন্তানের বাসনায় নিজেদের সদ্যোজাত কন্যাকে গরম জলে চুবিয়ে হত্যা করার কঠিন পরীক্ষা মাকেই দিতে হোত বা বহুক্ষেত্রে এখনও হয়ে থাকে।
যাইহোক পদ্ম-পা লাভের জন্য বারবার খোলা-বাঁধার যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে পা শেষ পর্যন্ত অসাড় হয়ে যেত। ‘পরিচর্যা’ সত্ত্বেও কিংবা তার সৌজন্যেই পায়ের নখে বা নখের খোঁচায় আঙুলে রোগ সংক্রমণ (infection), শক্ত বাঁধুনির ফলে রক্ত চলাচল রুদ্ধ হয়ে আঙুলগুলোর পচন, পচনজনিত কলামৃত্যু (necrosis) ইত্যাদি ছিল অবশ্যম্ভাবী। প্রথম দিকে পচা মাংসের দুর্গন্ধ ও পরের দিকে নানাবিধ জীবণুর প্রভাবে মিশ্র দুর্গন্ধ ছাড়ত। [41] সংক্রমণ হাড় পর্যন্ত পৌঁছোলে পচা আঙুল খসেও পড়ত অনেক সময়। এটা আবার খুবই কাঙ্খিত ব্যাপার ছিল, কারণ এর পর আরো শক্ত ও ছোট করে বাঁধন দেওয়া যেত। তাই প্রায়শ ব্যান্ডেজের মধ্যে কাঁচ বা ভাঙা টালির টুকরো (broken tiles) ঢুকিয়ে ইচ্ছাকৃত রোগ সংক্রমণ ঘটানো হোত। ফলে মেয়েটির কাছে বিকল্প বলতে দুটি – হয় সেপটিক হয়ে মৃত্যু, কিংবা জীবনভর বিকলাঙ্গতা। সূত্রানুযায়ী পচনশীল ক্ষত বা গ্যাংগ্রিন (gangrene) অথবা অন্যান্য সংক্রমণে অকালমৃত্যুর হার ১০%, [42] আর বেঁচে থাকা মানে কৈশোর যৌবন জুড়ে ভাঙা হাড় জুড়ে যাওয়ার উপক্রম হলেই বারবার ভেঙে দোমড়ানোর যন্ত্রণাভোগ, [43] সারা জীবন খুব সতর্ক হয়ে পাতা বাঁচিয়ে গোড়ালিতে ভর করে টলমল করে হাঁটা। বয়স বাড়লে চলাফেরা ওঠ-বোস করতে গিয়ে পায়ে জোর না পেয়ে ভারসাম্য হারিয়ে প্রায়ই পড়ে গিয়ে কোমর বা উরুর জোড় (hip joints) ভেঙে ফেলে তারা। [44] তাছাড়া জন্মের মতো পক্ষাঘাত (paralysis) বা পেশিক্ষয় (muscular atrophy) ইত্যাদিও রূপ-সাধনার-সাধনার খুব সাধারণ প্রতিক্রিয়া। [45]
প্রকৃতপ্রদত্ত শতাধিক যন্ত্রণা ও অস্বস্তির পাশাপাশি নিজের পা নিয়ে নারীজীবনে আরোপিত বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। অথচ এই গলা-পচা বিকৃতিই নাকি সৌন্দর্য, বিদ্ঘুটে ভঙ্গিতে টলমল করে হাঁটাই সৌন্দর্য ও যৌন আবেদন (Beauty and erotic appeal)। [46][47] এমনকি পা থেকে ছাড়া দুর্গন্ধও নাকি ছিল আবার অনেক পুরুষের ইন্দ্রিয় উত্তেজনার কারণ। অনেকেই বাঁধা পা সরাসরি খুলে দেখত না। কারও কারও ধারণা ছিল পা বাঁধলে যোনিতে বাড়তি খাঁজ তৈরি হয়, উরু বেশি মাংসল ও উত্তেজক হয়। [48] লেখক রবার্ট ভ্যান গুলিক (Robert van Gulik)-এর মতে বহু পুরুষ স্ত্রীর যোনির চেয়ে পায়ের পচা পাতাকে বেশি গোপনীয় ও আকর্ষণীয় মনে করত। [49]
ট্যাং রাজবংশে (Tang dynasty) ৮৫০ সালে ডুয়ান চেংশি (Duan Chengshi)-র লেখা “ইয়ে জ়িয়াং” (Ye Xian)-এর রূপকথা খুব সমাদৃত হয়। অনেকটা সিন্ডারেলা জাতীয় কাহিনী। জুতো হারানো কন্যার পায়ে ছোট্ট জুতো খাপে খাপে বসার পর রাজার তাকে বিয়ে করেন। [50][51] আবার কুইং রাজাদের কেউ কেউ পা-বাঁধাই বন্ধ করতে চাইলেও রাজবংশের যৌনশিক্ষার বইতে (sex manuals) পদ্ম-পা নিয়ে খেলার ৪৮ রকম উপায়ও বাতলানো ছিল। [52]
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে কিছু লেখক চিন্তক প্রথম এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ব্যর্থ হন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে তাইপিং বিদ্রোহীরাও (Taiping Rebellion) এর বিরোধিতা করে ব্যর্থ হয়। [53][54] পরে খ্রিস্টান মিশনারিদের এই প্রথাকে বর্বর ও অমানবিক বলে লাগাতার প্রচারে এবং শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে পদ্ম পায়ের প্রতি মোহ কাটতে থাকে। [55][56] -বাঁধাই বিরোধী প্রাচীনতম পশ্চিমি সংগঠনটির (Western anti-foot binding society) নাম “জী চ্যান জ়ু হুই” বা Jie Chan Zu Hui (截纏足会) যেটা ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৫ সালে ৬০-৭০ জন খ্রীস্টান মহিলা জন ম্যাকগাউন (John MacGowan)-এর নেতৃত্বে জ়িয়ামেনে “টিয়ানজ়ু (‘tianzu’) সমাজ গড়ে তোলেন, যার আক্ষরিক অর্থ স্বাভাবিক পা বা Natural Foot। [57][58] এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যায় মিশনারি টিমোথি রিচার্ড (Timothy Richard) প্রমুখের অনুপ্রেরণায় ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত Woman's Christian Temperance Movement।[59][60] এই সূত্রে চিনে খ্রীস্ট ধর্ম লিঙ্গসাম্য আনতে পারে এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে অধিকাংশ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও এই প্রথার বিপক্ষে হওয়ায় [61] ১৮৮৩ সালে কাং ইওউই (Kang Youwei)-এর নেতৃত্বে ক্যান্টনে পা-বাঁধাই বিরোধী সমাজ Anti-Footbinding Society গড়ে ওঠে এবং ক্রমে এই জাতীয় সংগঠন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে, যাদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ। [62] তবে আন্দোলনটির ভিত্তি নারীবাদী দৃষ্টি ছিল না, ছিল কিছু পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক চাহিদার প্রেক্ষিতে – যেমন মুক্ত পায়ে মেয়েদের স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষমতা বাড়বে।[56] সামাজিক ডারউইনবাদে (Social Darwinism) বিশ্বাসী লিয়াং কুইচাও (Liang Qichao)-র মতো সমাজ সংস্কারকের আবার বক্তব্য ছিল দুর্বল নারী যেহেতু দুর্বল সন্তানের জন্ম দেবে, তাই দেশও দুর্বল হয়ে পড়বে। [63]
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় নারীবাদী কুই জিন (Qiu Jin) পা-বাঁধাই বন্ধ করার ডাক দেন।[64][65] পরামর্শ দেন, নিজের কন্যাদের পা না বাঁধতে ও পা-বাঁধা মেয়েদের সঙ্গে ছেলের বিয়ে না দিতে। [66][57] নারীবাদী আন্দোলনের জোরালো ভূমিকা ছিল এই নিষ্ঠুরতার অবসানে। সম্রাজ্ঞী দোয়াগের কিক্সি (Empress Dowager Cixi) ১৯০২ সালে পা-বাঁধাই নিষিদ্ধ করে আইন আনেন। কিন্তু সেটাও প্রত্যাহার করতে হয়। [67] শেষ পর্যন্ত ১৯১২ সালে নতুন Republic of China সরকার পা-বাঁধা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, যদিও আইন প্রয়োগে কড়াকড়ি ছিল না। [68] May Fourth Movement-এর বুদ্ধিজীবীরাও চিনের অনগ্রসরতার কারণ হিসাবে মেয়েদের পা বাঁধাকে দায়ী করে। [69] ক্রমশ কিছু স্বেচ্ছাসেবীর লাগাতার প্রচার এবং প্রাদেশিক সরকারগুলির কড়া আইনি তৎপরতায় পা বাঁধানো কোনও কোনও প্রদেশে বন্ধ করা সম্ভব হয়। [68][55]
১৯২৯ সালে এক সমীক্ষায় প্রকাশ ১৯১০ সালের আগে ও পরে জন্মানো পা-বাঁধাইমুক্ত মেয়ের সংখ্যা যথাক্রমে ২.৩% ও ৯৫%। [70] Mary White Stewart (27 January 2014). Ordinary Violence: Everyday Assaults against Women Worldwide. Praeger. pp. 4237–428. ISBN 978-1-4408-2937-6. বেইজিংয়ের ডিংজ়িয়ান (Dingxian) অঞ্চলে যেখানে ৯৯% মেয়ের পা বাঁধাই হোত, ১৯১৯-এর পর সেখানে একটিও নিদর্শন মেলেনি। [71][72] তাইওয়ান (Taiwan) প্রদেশে জাপানি শাসনের (Japanese rule) শুরু থেকেই এই প্রথা নিরুৎসাহিত হয়েছে, এবং শেষে ১৯১১-১৫-র মধ্যে পা বাঁধাইকে বেআইনি ঘোষিত হয়। [73] তবে চিনের অন্যান্য জায়গায় আরো কিছু বছর এই ঐতিহ্য বেঁচে ছিল। ১৯২৮ সালের জনগণনায় শাংক্সি (Shanxi) গ্রামীণ অঞ্চলে ১৮% মহিলার পা বাঁধা ধরা পড়েছিল [26] যেখানে ইউনান প্রদেশে (Yunnan Province) পা-বাঁধাই প্রথাটি ১৯৫০ পর্যন্ত রমরমিয়ে বিরাজ করেছে, [74][75] যদিও কমিউনিস্ট শাসনে এই প্রথাটি অপরাধ হিসাবে গণ্য হওয়ার পর অধিকাংশ জায়গায় ১৯৪৯-এই এটি কার্যত অবলুপ্ত হয়। তারপরেও ১৯৫৭ সালে আরো কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ধরা পড়ে। [76] "The last case of girls binding ever occurred in 1957. [77] ১৯৯৯ সালে ‘পদ্ম জুতো’ (making lotus shoes) প্রস্তুতকারী হার্বিনস্থিত (Harbin) ঝ়িক়িয়াং শু ফ্যাক্টরি (Zhiqiang Shoe Factory) নামের শেষ কারখানাটিও বন্ধ হয়ে যায়। Dorothy Ko (2008).[78]
কিন্ত এই পুরো পদ্ধতি ও তার পরিণামে সৌন্দর্য কিংবা যৌন আবেদন কি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও কি খুঁজে পাওয়া যায়? মনস্তত্ত্ববিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) একে সোজাসুজি মৃত বা জড় নিয়ে যৌনতার মতো যৌন বিকৃতির সঙ্গে তুলনা করেছেন ("perversion that corresponds to foot fetishism")। [79] তাছাড়া অনেক সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকের ধারণা সং বংশের রাজত্বকালে কনফিউসীয় ধর্মের (Confucianism) নবজাগ্রত রূপ নব্য কনফিউসীয় ধর্ম (Neo-Confucianism) বিশ্বাসের প্রভাবে সমাজে মেয়েদের অবস্থান অনেকটাই অবনত হয়েছিল। বৈধব্য ও সতীত্ব নিয়ে কড়াকড়িও বাড়ে তার প্রভাবে। পা-বাঁধাই করে মেয়েদের চলচ্ছক্তিহীন পঙ্গু ও পরনির্ভরশীল করে দেওয়ার চল তখনই পৃষ্ঠপোষকতা পায়।[80] গবেষক রবার্ট ভ্যান গুলিক (Robert van Gulik)-এর মতে সং রাজত্বের অন্যতম কনফিউসীয় পণ্ডিত ঝ়ু জ়ি (Zhu Xi) নারীর হীনতা প্রমাণ এবং নারী-পুরুষকে পৃথক রাখার ওপর জোর দেয়। [81] লিন ইউটাং (Lin Yutang) প্রমুখ চিনা পণ্ডিতদের দাবি ঝ়ু জ়ি মেয়েদের সতীত্বরক্ষার জন্য পা-বেঁধে গতিরোধ করতে উৎসাহ দেন। [80] ঐতিহাসিক ডরোথি কো (Dorothy Ko)-র বক্তব্য পা-বাঁধা আসলে কনফিউশীয় আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রকাশ যার দ্বারা মেয়েদের সঠিক পোষাক ও শরীরি আর্ষণীয়তার পরিধি স্থির করে দেওয়ার প্রবণতা ছিল, যার ফলে পা-দুটো বন্দী করা হয়ে দাঁড়ায় সভ্যতা ও মর্যাদার প্রতীক।[82]
প্যাট্রিশিয়া ইব্রে (Patricia Ebrey) আবার এই অনুমানকে কাল্পনিক বলেছেন।[83] অনেক কনফিউসীয় নীতিবিদ পা-বাঁধানোর সঙ্গে যৌন আবেদনের সম্পর্ক অস্বীকার করে বলেছেন বাকি মহিলারাও প্রশংসিত হোত। [84] কিন্তু যদি সৌন্দর্য ও যৌন আবেদনের সম্পর্ক নাই থাকে, তাহলে তো মেয়েদের অঙ্গহানি করার পুরুষালি দুরভিসন্ধি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। নব্য কনফিউসিয়ান চেং য়ি (Cheng Yi) পা বাঁধানোর বিপক্ষে ছিলেন, এবং তাঁর পরিবারের মেয়েরাও পা বন্দী করত না [85][86]। আধুনিক কনফুসীয় পণ্ডিত তু উইমিং নব্য কনফিউিয়ান মতবাদে পা বাঁধানোকে যেনতেন জুড়ে দেওয়ার বিপক্ষে।[87]
কনফিউশীয় নীতি যদিও অঙ্গহানির বিপক্ষে – “injure even the hair and skin of the body received from mother and father”, তবু এই নীতি পুরুষদের বেলা প্রযোজ্য ছিল মনে করা হয়, যেখানে মা-বাবার সঙ্গে পুত্রসন্তানের সম্পর্কটাই বড়ো করে দেখনো হোত। তাছাড়া কনফিউশীয় মতবাদ (Confucianism) নারীকে সংসারের স্বার্থে আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়েছে। এই আত্মত্যাগের মধ্যে পরিবারের জন্য মৃত্যবরণ তথা অঙ্গহানি মেনে নেওয়া বিশেষভাবে শামিল ছিল।[88]
চিনা বিশ্বকোষে (Chinese Encyclopedia) তাই পা-বাঁধাই অঙ্গহানি হিসাবে নয়, নারীর অঙ্গবাস ও শৃঙ্গার হিসাবে বর্ণিত। ১৫৯১ সালের তেমন একটি অভিধানে চুল বাঁধা, প্রসাধন করা বা কান বিঁধোনোর মতোই পা-বাঁধাকে সাজসজ্জার অঙ্গ হিসাবে দেখানো হয়েছে। ঐতিহাসিক কো-র মতে পা-বাঁধাকে সভ্য সমাজের প্রথা হিসাবে প্রচার করার প্রয়াস মিং রাজত্বের কয়েকটি নির্দেশে স্পষ্ট – যেমন "entice [the barbarians] to civilize their customs” অর্থাৎ মহিলারা পা-বাঁধিয়ে সভ্য হোক।[89] কাজটা বয়স্ক মহিলাদের দিয়ে কন্যাশিশু বা বালিকা নির্যাতন করিয়ে ছোট থেকেই ছেলে ও মেয়ের তফাৎটা মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হোত।[90][91] নৃতাত্ত্বিক ফ্রেড ব্লেক (Fred Blake) মনে করেন পা-বাঁধাই দ্বারা মহিলারা নিজেরাই একরকম শৃঙ্খলা পালন করে কন্যা পরম্পরায় তা সঞ্চারিত করত; এবং পুরোটাই কনফিউশীয় সভ্যতার পুরুষতান্ত্রিক আদশর্বাদ মেনে। [88] প্রসঙ্গত স্মরণ করতে হয়, নিও কনফিউসিয়াজ়মের প্রভাবেই ভিয়েতনামের মাতৃতান্ত্রিক বা মাতৃবংশানুক্রমিক সমাজ ব্যবস্থাকে চিনা আগ্রাসন বারবার তছনছ করতে চেয়েছে। সুতরাং সৌন্দর্যের ঠুলি পরিয়ে মেয়েদের দমন করার পুরুষতান্ত্রিক দুরভিসন্ধি মোটেই অস্পষ্ট নয়।
নারীবাদীরা দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রথাটিকে শুধু অবদমনমূলক (oppressive practice)[92][93] নয়, মেয়েদের ওপর হিংসা হিসাবেও দেখা হয়। [94][95][96] বিকলাঙ্গ পা নিয়ে মেয়েরা স্বভাবতই বাড়ির অন্যান্য বিশেষত পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয়।[97] [98]
প্রথম দিককার চিনা নারীবাদী কুই জিন (kui jin) নিজে পা বাঁধা-খোলার মতো যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞাতার মধ্যে দিয়ে গেছেন, পা-বাঁধাই সহ ঐতিহ্যের নামে চলে আসা একাধিক প্রথাকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর ভাষায় পা বাঁধা মানে মেয়েটিকে গৃহবন্দী করে রাখা। নারীমুক্তিতে শিক্ষার ওপর জোর দেন, যার দ্বারা শরীর ও মনের বিকাশ সম্ভব।[65][99] প্রথাটির বিলুপ্তি চীনে নারী স্বাধীনতা ও উত্থানের অন্যতম কারণ হিসাবে দেখেছেন [100] সন্দেহ নেই, এর ফলে মেয়েদের কর্মক্ষমতা বেড়ে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন থেকে অলিম্পিকের আসর সবেতেই অনস্বীকার্য অবদান রেখেছে। অবশ্য তারপরেও নারীরা ওখানে স্বাধীন বা কাঙ্খিত নাকি ব্যবহৃত, তা ভিন্ন অনুসন্ধান।
উল্টোদিকে লরেল বোসন (Laurel Bossen) ও হিল গেটস্ (Hill Gates) এঁরা পা-বাঁধাইয়ের সঙ্গে সৌন্দর্য বা সামাজিক মর্যাদা, ভালো বিয়ে অথবা পুরুষালি আধিপত্য – কোনওটারই যোগসূত্র খুঁজে পাননি। তাঁদের মতে এতে করে নাকি কাজে সুবিধা হোত এবং মা থেকে কন্যা পরম্পরায় মেয়েদের জমির বেশি কাছাকাছি থাকার শিক্ষা দেওয়া যেত।[101][102]
এই বিচিত্র কষ্টকল্পিত ব্যাখ্যা ছাড়াও তাঁদের বক্তব্য পা-বাঁধাই ছিল ‘হ্যান’ নারীদের বহিরাগত মোঙ্গল (১২৭৯), মাঞ্চু (১৬৪৪) বা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নারীদের থেকে স্বতন্ত্র করার উপায়। [90] তাই মাঞ্চুদের কুইং বংশের রাজত্বকালে পা-বাঁধাই নিষিদ্ধ করার প্রয়াস শুধু ব্যর্থ হয়নি, স্বাতন্ত্র্য রক্ষার তাগিদে ১৭ ও ১৮ শতকে হ্যান নারীদের মধ্যে এই প্রথা বহুগুণ জেঁকে বসে। [103] এটা অবশ্য মন্দ বলেননি তাঁরা। যুদ্ধ করে শত্রু জাতিগোষ্ঠি নির্মূলীকরণের দায়িত্ব নেবে পুরুষরা, আর অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করে প্রজাতির ঐতিহ্য বা সাতন্ত্র্য রক্ষার দায় বর্তাবে মেয়েদের ওপর।
এই প্রকৃতি বিরোধিতার চল উঠে যাওবার পরে চিন বিশ্বের ক্রীড়া জগতে আভাবনীয় উন্নতি করেছে। জিমনাস্টিকস্ থেকে ব্যাডমিন্টনে শতশত খেতাব বলা বাহুল্য মেয়েরা বাঁধা পা নিয়ে অর্জন করেনি। তবে এই প্রথার অবসান কতটা না নারীমুক্তির কথা ভেবে, আর কতটা মেয়েদের কাজে লাগানোর পুরুষতান্ত্রিক অভিসন্ধি থেকে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়, কারণ এখনও চিন সমাজ পুত্রসন্তানের কামনায় শিশুকন্যা হত্যা করে, গ্রামাঞ্চলে বধূ-নির্যাতন খুব মামুলি ব্যাপার।
একটা ব্যাপার আশ্চর্য লাগে। যাদের সংস্কৃতি তারা তো হাজার একটা যুক্তি দেখাবেই, নিষ্ঠুরতা গোপন করতে চাইবে। কিন্তু বহির্বিশ্বে বিশেষত ভারতবর্ষে কিসের প্রভাবে চিনা মেয়েদের দশ-বারো শতাব্দী প্রাচীন দুঃসহ যন্ত্রণা অস্বস্তির সঙ্গে শুধু সৌন্দর্য প্রসাধন ও কাঠ বা লোহার জুতোর অতিসরলীকৃত সমীকরণ প্রচারিত রইল?
চিন দেশের নারী সৌন্দর্যের সংজ্ঞা, পুরুষের যৌন চাহিদা তথা পারিবারিক আভিজাত্য একদা ছিল নারীর পায়ের পাতায় বাঁধা, বলা ভালো নারীর বাঁধা পায়ে। বিচ্ছিন্নভাবে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে Foot Binding-এর কিছু বিরোধিতা হলেও সেসব ব্যর্থ হয়েছে। মূলত খ্রীষ্টান মিশনারি ও নারীবা আন্দোলনের জেরে এর বিরুদ্ধে জনমত সগঠিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে জনৈক রানীর শাসনে এই নিষ্ঠুরতার চল অনেকটাই কমে আসে। অবশেষে কমিউনিস্ট শাসনে পা বাঁধাই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত হয়