পৃথিবীতে রহস্যের বোধহয় কোন সীমা- পরিসীমা নেই। কিছু রহস্যের সমাধান হয়তো মানুষ করে ফেলেছে কিন্তু অনেক রহস্যই মানুষের বোধবুদ্ধির অগোচরেই বাইরেই থেকে গেছে। এমনি এক রহস্য এই বারমুডা ত্রিকোন রহস্য যার সমাধান তো দূরের কথা এই রহস্যের প্রকোপে পড়ে আজ পর্যন্ত কত প্রান যে নিঃশেষিত হয়েছে; কত জাহাজ, উড়োজাহাজ যে অন্তর্হিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বারমুডা ত্রিকোনকে সেই কারনেই বোধহয় শয়তানের আস্তানা বা শয়তানের ত্রিভুজ বলে ও অনেকেই মনে করেন। পশ্চিম আটলান্টিক সাগরে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অবস্থান। অনেকের মতে ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম এই ত্রিভুজ বিষয়ে তাঁর অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লেখেন। তিনি লিখেছিলেন যে তাঁর জাহাজের নাবিকেরা এ অঞ্চলে দিগন্তে আলোর নাচানাচি ও আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টোপাল্টা দিক নির্দেশনার কথাও বর্ননা করেছেন।রড্রিগো ডি ট্রাইয়ানা নামে এক নাবিক রাত দশটার সময় জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে প্রথম এর ডাঙ্গা দেখেছিলেন।
বারমুডা ত্রিকোন অতলান্তিক মহাসাগরের একটি অংশ বিশেষ যা একদিকে বারমুডা এবং অন্যদিকে মিয়ামি ও পুয়ের্তরিকো দিয়ে ঘেরা এবং যা প্রায় পাঁচ লক্ষ থেকে পনেরো লক্ষ বর্গ মাইল বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে রয়েছে। আমেরিকার একটি রাজ্য ফ্লোরিডার দক্ষিন-পূর্ব উপকূলের তীরে অবস্থিত এই বারমুডা ত্রিকোন। এই বারমুডা ত্রিকোন অঞ্চলে গত শতাব্দীতে কত জাহাজ এবং উড়োজাহাজ যাত্রা করে যে ফিরে আসে নি , কত সহস্র প্রান যে বলির যূপকাষ্ঠে চড়েছে তার কোন লেখাজোখা নেই।বহু মানুষ এই অঞ্চলের কাছ পর্যন্ত ঘুরে এসে এই রহস্যের বিষয়ে নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন কিন্তু কোন যুক্তিই সর্বগ্রাহ্য হয়নি।
বারমুডা ত্রিকোন অঞ্চলের অস্বাভাবিক অর্ন্তধানের ঘটনা লোকের প্রথমে দৃষ্টিগোচরে আসে যখন এডোয়ার্ড ভন উইনকেল জোন্স ১৬ ই সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে মিয়ামি হেরাল্ড পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এরই দু'বছর পরে ফেট নামক একটি সাপ্তাহিকে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় "সামুদ্রিক রহস্য আমাদের খিড়কি দুয়ারে" নাম দিয়ে। এই প্রবন্ধে লেখক জর্জ এক্স স্যান্ড অনেক জাহাজ এবং উড়োজাহাজের রহস্যময় অন্তর্ধানের ব্যাপারে বর্ননা করতে গিয়ে সামরিক উড়োজাহাজ ১৯শের ঘটনাও উল্লেখ করে আমেরিকার নৌসেনার পাঁচ টর্পেডোবাহী বম্বার এবং তার সঙ্গে জড়িত চোদ্দজন যারা প্রশিক্ষণের জন্য বারমুডা ত্রিকোন অঞ্চলে গিয়ে আর ফিরে আসেনি তাদের কথা বলেন। লোকেরা এই প্রথম বারমুডা ত্রিকোন অঞ্চলের রহস্যময় ঘটনাবলীর কথা অবগত হয়।
১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে ফ্লাইট ১৯ নিয়ে আমেরিকার লিজানে লেখা হয় যে এই ফ্লাইটের দলপতিকে নাকি বলতে শোনা গেছে - আমরা কোথায় আছি জানিনা ।সবুজ রঙের জল, সাদা কিছু নেই। এতেই প্রথম ফ্লাইট ১৯কে কোন অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।১৯৬৪ সালে লেখক ভিনসেন্ট গাডিস তাঁর এক বইয়ে এই রহস্যের নামকরন করেন বারমুডা ট্রেঙ্গল নামে এবং বহু জাহাজের আশ্চর্যজনক ভাবে অন্তর্ধান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করেন। তখন থেকেই এই রহস্য বারমুডা ট্রেঙ্গেল রহস্য বা বারমুডা ত্রিকোন রহস্য নামে পরিচিতি লাভ করে। কিছু জাহাজ এবং উড়োজাহাজের আশ্চর্যজনক অন্তর্ধানের ঘটনার উল্লেখ নিচে করা হল:
উড়োজাহাজ ১৯ - যে ঘটনার বিবরন এ্যলেন অস্টিন থেকে পাওয়া যায়।
ইউএসএস সাইক্লোপস - যে ঘটনার বিবরন কনিমারা টিভিতে দেওয়া হয়।
উড়োজাহাজ ডিসি - ৩ - যার বিবরন এ ক্যারোল ডিয়ারিং থেকে পাওয়া যায়।
মেরী সিলেস্টি নামক জাহাজ - যে ঘটনার বিবরন দ্বিতীয় টুডোর- ৪ থেকে পাওয়া যায়।
মার্টিন - পি 5 এম নামক সামরিক জাহাজ - যার বিবরন সামরিক নৌপোত ওয়াই সি ১২২ থেকে পাওয়া যায়।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো যদিও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং টিভিতে দেখানো হয়েছিল, কিন্তু কিছু লোক যাদের মধ্যে অগ্রগন্য ছিলেন ল্যারি খুসে এঘটনাগুলো অপার্থিব বলে মানতে রাজি ছিলেন না। ল্যারি খুসে তাঁর বই - বারমুডা ট্রায়াঙ্গল মিষ্ট্রি সলভড এ এই ঘটনাগুলোকে রহস্য জনক বলে মানতে রাজি হননি। তাঁর কথায় এই ঘটনাগুলোর বেশীরভাগই অতিরঞ্জিত এবং এই ঘটনার বিবরনকারীরা কেউই সেই জায়গার দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়ার কথা চিন্তা না করেই এ ঘটনাগুলোকে রহস্যময় বলে মনে করেছেন। বেঞ্জামিন রেডফোর্ড তাঁর বইয়ে বলেন যে এই ঘটনাগুলো রহস্যজনক হলেও অপার্থিব নয়।
অপার্থিব কারন হিসাবে ব্যাখ্যা - কিছু লোকজন এই ঘটনাগুলো অপার্থিব বলে মনে করে এগুলোকে ইউফো রহস্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেছেন।
সাধারণ পার্থিব কারন হিসাবে ব্যাখ্যা-
১) কম্পাসের তারতম্য - বেশকিছু লোক এই রহস্যের সঙ্গে সেই জায়গার অস্বাভাবিক কম্পাসের তারতম্যের সম্পর্কের কথা বলেছেন যা নাকি ঐশ্বরিয় ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। যদিও তার কোন প্রমান পাওয়া যায়নি।কম্পাসের পাঠ নিয়ে বিভ্রান্তি অনেকাংশে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাহিনীর সাথে জড়িত। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে কম্পাস থেকে চুম্বক মেরুর দূরত্বের উপর ভিত্তি করে এর দিক নির্দেশনায় বিচ্যূতি আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র উইসকনসিন(Wisconsin) থেকে মেক্সিকোর উপসাগর(Gulf of Mexico) পর্যন্ত সরলরেখা বরাবর চৌম্বক উত্তর মেরু সঠিক ভাবে ভৌগোলিক উত্তর মেরু নির্দেশ করে। এই সাধারণ তথ্য যে কোন দক্ষ পথপ্রদর্শকের জানা থাকার কথা। কিন্তু সমস্যা হল সাধারণ মানুষকে নিয়ে, যারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। ঐ ত্রিভুজ এলাকা জুড়ে কম্পাসের এমন বিচ্যূতি তাদের কাছে রহস্যময় মনে হয়। কিন্তু এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
২) মানুষের গননা সম্বন্ধিত ভুল।
৩) দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়া: বারমুডা ত্রিকোন রহস্যের বেশীরভাগ জাহাজ- উড়োজাহাজের অর্ন্তধানের পিছনে দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়া একটি বড় কারন বিশেষতঃ " প্রাইড অফ বাল্টিমোর " জাহাজের অর্ন্তধানের ব্যাপারে।বেশ কিছু সেইসময়ের ডুবে যাওয়া জাহাজ জানিয়েছিল যে বাতাসের গতিবেগ হঠাৎ ৩২ কিঃমিঃ প্রতিঘন্টা থেকে ৯৭-১৫০ কিঃমিঃ প্রতিঘন্টায় পরিবর্তিত হয়েছিল। জেমস্ লুসাইন নামক এক জাতীয় ঝড়ের সম্বন্ধে গবেষনাকারী বিশেষজ্ঞ জানিয়েছিলেন যে দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়ার সময় ঝড় বিস্ফোরকের মত ভয়ঙ্কর হিসাবে কাজ করে।হারিকেন(Hurricane) হল শক্তিশালী ঝড়। ঐতিহাসিক ভাবেই জানা যায়- আটলান্টিক মহাসাগরে বিষুব রেখার কাছাকাছি অঞ্চলে শক্তিশালী হারিকেনের কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে, আর ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার। রেকর্ড অনুসারে ১৫২০ সালে স্প্যানিশ নৌবহর “ফ্রান্সিসকো দ্য বোবাডিলা” (Francisco de Bobadilla) এমনি একটি বিধ্বংসী হারিকেনের কবলে পড়ে ডুবে যায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাহিনীর সাথে জড়িত অনেক ঘটনার জন্য এধরনের হারিকেনই দায়ী।
৪) উপসাগরের প্রবাহ: উপসাগরীয় প্রবাহ বা গলফ স্ট্রিম হল মেক্সিকো উপসাগর থেকে স্ট্রেইটস অব ফ্লোরিডা(Straits of Florida) হয়ে উত্তর আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত উষ্ঞ সমুদ্রস্রোত। একে বলা যায় মহা সমুদ্রের মাঝে এক নদী। নদীর স্রোতের মত গলফ স্ট্রিম ভাসমান বস্তু কে স্রোতের দিকে ভাসিয়ে নিতে পারে। যেমনি ঘটেছিল ১৯৬৭ সালের ২২ ডিসেম্বর “ উইচক্রাফট” নামের একটি প্রমোদতরীতে। মিয়ামি তীর হতে এক মাইল দূরে এর ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে তার নাবিকরা তাদের অবস্থান কোস্ট গার্ডকে জানায়। কিন্তু কোস্ট গার্ডরা তাদেরকে ঐ নির্দিষ্ট স্থানে পায়নি।
৫) মিথেন গ্যাসের উদগম: কিছু বৈজ্ঞানিকের ধারনা অনুযায়ী
বারমুডা ত্রিকোন রহস্যের পিছনে সেই স্থানে বেশি পরিমাণে মিথেন
গ্যাসের উদগমও কারন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অভিজ্ঞতা
অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের ভগ্নাবশেষ সাগরীয় স্রোতে অন্যজায়গায়
স্থানচ্যুত হলেও তার থেকে প্রভূত পরিমানে মিথেন গ্যাসের
নির্গমনের কারন ঘটে যা কিনা ফেনার সৃষ্টি করে এবং যে কোন
জাহাজ সেই ফেনার মধ্যে অতিদ্রুত, নিঃশব্দে ডুবে যেতে পারে।অস্ট্রেলিয়ায় পরীক্ষাগারের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাতাসের বুদবুদ জলের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। তাই সাগরে যখন পর্যায়ক্রমিক মিথেন উদগীরন হয়, তখন জলের প্লবতা(কোন কিছুকে ভাসিয়ে রাখার ক্ষমতা) কমে । যদি এমন ঘটনা ঐ এলাকায় ঘটে থাকে তবে সতর্ক হবার আগেই কোন জাহাজ দ্রুত ডুবে যেতে পারে।
৬) ইলেকট্রনিক কুয়াশা : বৈজ্ঞানিক এডওয়ার্ড গার্ননের মতে সমুদ্র
পৃষ্ঠে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় শক্তি কুয়াশার জন্ম দেয় যার প্রকোপে
উড়োজাহাজ অন্তর্হিত হয়ে যাওয়া কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
৭) যদিও বৈজ্ঞানিকরা সমুদ্রগর্ভে প্রায়শই ভূমিকম্পের পরিমাপ
করেননি কিন্তু সমুদ্রগর্ভের ভূমিকম্প ও এর কারন হতে পারে যার
প্রভাবে সুনামীর মত ঘটনা ঘটেছিল।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এক দুর্ভেদ্য রহস্যের নাম।বারমুডা ত্রিকোন রহস্য বহু বীভৎস, অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারন হলেও এখন পর্যন্ত এর সঠিক, যুক্তিযুত ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারেনি। যদিও বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এর ভয়াবহতা হয়ত কিছুটা কম হয়েছে কিন্তু এখনো অস্বাভাবিক অন্তর্ধানের ঘটনা সম্পূর্নভাবে বন্ধ হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল রহস্যের সমাধান করার বিষয়টি উঠে এসেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়, নরওয়ের গবেষকেরা উত্তর মেরুর ব্যারেন্টস সাগরের তলদেশে বেশ কিছু বড় গর্তের সন্ধান পেয়েছেন। আর্কটিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বলছেন, এই গর্ত বা আগ্নেয়গিরির মুখগুলোর ব্যাস ৩ হাজার ২৮০ ফুট ও গভীরতা ১৩১ ফুট হতে পারে। থ্রিডি সিসমিক ইমেজিং পদ্ধতিতে এই গর্তগুলো শনাক্ত করেছেন তাঁরা। গবেষকেরা বলছেন, তেলের খনি থেকে সৃষ্ট উচ্চ চাপের মিথেন গ্যাসের উদগীরণে এ গর্ত সৃষ্টি হতে পারে।
ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই আবিষ্কারের ঘটনা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামের বিতর্কিত ওই এলাকায় জাহাজ ও বিমানের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারে। এর আগে ২০১৪ সালে সাইবেরিয়ান টাইমসকে দেওয়া রাশিয়ার গবেষক ভ্লাদিমির পোতাপভের এক সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়েছে ডেইলি মেইল। পোতাপভের তত্ত্ব অনুযায়ী, মিথেন গ্যাসের উদগীরণ সমুদ্রকে উত্তপ্ত করে। মিথেনযুক্ত জলের কারণে জাহাজ ডুবে যায়। এ ছাড়া বায়ুমণ্ডলেও বিশেষ পরিবর্তনের ফলে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। এরকম বড় গর্ত থাকতে পারে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলেও ।তার থেকে হয়তো মিথেন বের হয়ে জলে মিশে জলের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়।মিথেন নির্গমনের জন্য যে ফেনা হয় তাতে যে কোন জাহাজ দ্রুত ডুবে যেতে পারে।
ভবিষ্যতই বলতে পারবে এই কারনে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কাছে জাহাজ ডুবে গেছিল কিনা।এই রহস্যের সমাধান কোনদিন আদৌও হবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলতে পারে।
- সমাপ্ত -