কেমন যেন গুম মেরে বড় গাছটার তলায় বসে ছিল নীলেন্দু। ঠিক কতক্ষন সে এভাবে বসে আছে নিজেরও খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফেরে লোকটির লাল ও জল ভরা চোখে করজোড়ে সামনে এসে "বাবু ও বাবু" বলে ডাকে, সাড়া দেয় নীলেন্দু। "সব কাজ তো আপনার দয়ায় শেষ হল, আমিও এবার ফিরে যাবো, আপনি..." ঘাড় ঘুরিয়ে একবার বাম দিকের সদ্য গজান মাটির ঢিবি টাকে দেখে নীলেন্দু,উপরে কয়েক টা গাঁদা ও বুনো ফুল ছড়ানো। বুকের মাঝে আবারও একটা ব্যথার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীর জুড়ে । ওদিকে পশ্চিম আকাশে সারাদিন আগুন ঝরিয়ে সূর্য্য টা এখন একটা বিষন্নতার রঙে চারপাশ টা রাঙিয়ে বিদায় নিতে চলেছে।

বারিপদা ফরেস্ট অফিসার এর সাথে যথেষ্ঠ হৃদ্যতা থাকায় বেশ সহজেই বারিপদা জঙ্গল বীট লাগোয়া গ্রাম চান্দুয়া তে এক গৃহস্থের বাড়ি দিন কয়েকের জন্য হোমস্টে এর ব্যাবস্থা হয়ে গেল নীলেন্দুর। নীলেন্দু মানে নীলেন্দু রায়, কলকাতার একটা বড়ো দৈনিক সংবাদ পত্রের সাংবাদিক, একই সাথে বেশ ভালো চিত্র গ্রাহক। বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও আছে তার ঝুলিতে। দীর্ঘকায় সুঠাম ও বেশ আলাপী স্বভাবের। সদ্য ঘটে যাওয়া বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের কভার করতে প্রচুর খাটনি গেছে তাই কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে হাজির হয়েছে এই চান্দুয়াতে। টুরিস্ট রা যদিও একটু দূরের শিমলিপাল রিজার্ভ ফরেস্ট ই বেশি পছন্দ করেন, কিন্তু নীলেন্দু এই সব ভীড় থেকে দূরে মাটির গন্ধ নিতে হাজির এই অখ্যাত গ্রামে।

এখানে জঙ্গল কিছুটা শরতের আকাশের মেঘের মত ছেঁড়া ছেঁড়া, ঘনত্ব কম, রুক্ষ মাটি। বন্য প্রাণী বলতে মাঝে মাঝে বাংলা থেকে ঢুকে পড়া হাতির দল, অল্প কিছু হরিণ, শেয়াল আর কিঞ্চিৎ দেখা মেলে বুনো শুয়োর।আর আছে প্রচুর পাখি। স্থানীয় লোকজনের ভাষা ওড়িয়া হলেও বাংলা টা বোঝেন।

বাংলার নির্বাচন শেষ হলেও উড়িষ্যা তে বিধান সভা নির্বাচন আসন্ন তাই এখানে এসে সেই পরিচিত দলীয় পতাকা ও বড় বড় ছবি সম্মিলিত ফ্লেক্স এদিক ওদিক লাগান দেখে নির্বাচনী প্রচারের আঁচটা বেশ বুঝতে পারে। তবে নীলেন্দূ এবার ঠিক করেই এসেছে, ঢের হয়েছে কাজ, এবার এই অখ্যাত গাঁয়ে প্রকৃতির মাঝে বুক ভরে অক্সিজেন নেবে আর মনে মত কিছু ছবি তুলবে। আগেই শুনেছে এখানে বহু পাখি দেখতে পাওয়া যায় যদিও তেমন ভাবে সে পাখি চেনে না। তবে ভীষণ প্রিয় হরিণ ও কর্মরত মানুষের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের ছবি তো আছেই।

চাঁন্দুয়া নামে গ্রাম হলেও বসত ঘর খুবই কম। ইতস্তত দূরে ছড়ানো ছেটানো, সব কটি বাড়ি ই মাটির। এমনকি নীলেন্দু যে বাড়িতে উঠেছে সেই সুবল রথ এর বাড়িও। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লজঝড়ে পুরাণ উইলি জীপ যখন তার মত একজন শহুরে বাবু কে এমন অজ গ্রামে নামিয়ে দিয়ে গেলেন খোদ ফরেস্ট অফিসার অমল মহাপাত্র, তখন গ্রামবাসিরা বেশ অবাক ও সমীহের দৃষ্টিতেই চেয়েছিল। এখানে পৌঁছাতেই প্রায় দুপুর হয়ে গেছিলো তাই স্নান সেরে মোটা চালের ভাত, ডাল, আলু ভাজা ও ডিমের ওমলেট দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে অল্প বিশ্রামের পর বিকেলে বেড়িয়ে চারপাশের খোঁজ নিয়ে জেনেছিল,এখানে পুরুষরা যায় দূরের গ্রামে, মাঠে জন মজুরের কাজ করতে আর অবসরে পুরুষ মহিলা উভয়েই বিড়ি বাঁধে। এটাই অধিকাংশ লোকের জীবিকা। বিকেলে একটা জিনিস দেখলো, এখানকার রাজনৈতিক দলের প্রচার। একটা মাঝ বয়সী লোক ভ্যান রিক্সায় বসে হ্যান্ড মাইক নিয়ে স্থানীয় ভাষায় কোন একটি রাজনৈতিক দলের আগামীকাল হতে চলা সভায় সকলকে আসতে আহ্বান(!) নাকি নির্দেশ দিচ্ছেন।

সম্পূর্ণ টা না বুঝলেও বেশ কিছুটা বুঝতে পারে নীলেন্দূ, বিশেষত বক্তব্য রাখতে আসবেন বলে যে সব ওজনদার নেতাদের নাম বলে গেলো সেগুলো তো তার বিশেষ ভাবেই জানা। তবে খটকা লাগলো অন্য জায়গায়, এই প্রচারক লোকটির সাথে বেশ বড় লাঠি হাতে কয়েক টি স্বাস্থ্যবান যুবক। দলটি নীলেন্দুর সামনে দিয়ে যাবার সময় বেশ জরিপের দৃষ্টি তেই দেখে গেলো। কিছুটা এগিয়ে গ্রামেরই একজন কে পেয়ে নীলেন্দু কে দেখিয়ে কিছু একটা বলছে এটা বুঝলেও কি বলছে সেটা দূরত্বের কারণে ও স্থানীয় ভাষায় রপ্ত না হওয়ায় বোধগম্য হলনা। তবে বেশ ভালো করে ওরা অপাঙ্গে মেপে গেলো এটা সে বুঝল।

বাড়ি ফিরে নীলেন্দু ওর বরাদ্দ ঘর টির চৌকিতে গা এলিয়ে দেয়। সঙ্গের ক্যামেরা টিতে বিকেলের তোলা ছবিগুলো একবার দেখে নিতে থাকে। এমন সময় সুবল বাবুর মেয়ে সুশীলা চা আর একটা বাটিতে চপ মুড়ি নিয়ে ঢোকে। বেশ মিষ্টি ও মিশুকে মেয়ে সুশীলা।

বয়স ঐ আঠারো উনিশ, ওর সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারে সুবল বাবু বন বিভাগের অস্থায়ী পিওন পদে কাজ করেন। তাই বন দপ্তরের অফিসারদের কথাতেই তার বাড়িতে এই হোম স্টে এর আয়োজন, সুশীলা এখন থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছে। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার ইচ্ছে থাকলেও এখান থেকে প্রায় বার /তেরো কিলোমিটার দূরের স্কুলে পড়তে যেতে হবে, তাই আর যাওয়া হয়নি, কারণ এখানে যাওয়া আসা পুরোটাই পায়ে হেঁটে অন্য কোন ব্যাবস্থা নেই। এই গ্রামে সাইকেল একমাত্র তার বাবারই আছে, বন দপ্তরের কাজ করার জন্য দিয়েছে। গল্পের মধ্যেই চপ মুড়ি ও চা শেষ হলে কাপ ও মুড়ির বাটি নিয়ে চলে যায় সুশীলা, তবে যাওয়ার আগে দুটি তথ্য জানিয়ে যায় নীলেন্দুকে। এক সে এবছরই নতুন ভোটার হয়েছে, তাই জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাবে, আর দুই রাত্রের মেনু হয়েছে রুটি ও ডিম আলুর ঝোল।

সুশীলা বেরিয়ে গেলে নীলেন্দু ভীষণ কাছের মানুষ ও বন্ধু অমৃতার থেকে জন্মদিনে উপহার পাওয়া গজেন্দ্র কুমার মিত্রের "পাঞ্চজন্য" বইটা পড়তে শুরু করে। শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র কে লেখক অসাধারণ মূল্যায়ন করেছেন। দেব ভাবের সাথে মানব ভাবের কি দারুন মেলবন্ধন। ধীরে ধীরে বইয়ের মাঝে ডুবে যেতে থাকে। কতক্ষন সময় কেটেছে জানেনা, দরজায় টোকার শব্দে সম্বিৎ ফেরে। দেখে দরজা খোলা থাকলেও বাইরে দাঁড়িয়ে সহবত বশত টোকা দিয়েছেন সুবল বাবুর সাথে সুশীলা। ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা সন্তান স্নেহ যেন জন্মে গেছে সুশীলার প্রতি। তাড়াতাড়ি উঠে বসে ওদের আস্তে বলে নীলেন্দু। সুশীলা সামনে থালায় গরম রুটি ও ধূমায়িত বাটি ভর্তি ডিম আলুর ডালনা রাখে। সাথে প্লাস্টিকের ঢাকা দেওয়া জলপূর্ণ জগ। সুবল বাবু কিছুটা কুণ্ঠিত বোধ করতে থাকেন ও বলে ওঠেন, যে এটা বেশ গরীব মানুষদের গ্রাম এখানে বাড়িতে ওই অতিথি রাখার চল নেই। বড় কর্তা দের নির্দেশে তিনি তার বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বটে তবে যত্ন আত্তির সাধ্য তার তেমন নেই। নীলেন্দু সহাস্যে সুবল বাবু কে জানায় কোনরকম অসুবিধা তার এ পর্যন্ত হয়নি, তাই নয় সুশীলার মাঝে নিজ কন্যার ছায়া পেয়ে তাকে নিজ কন্যাই ভাবছে। সুবল বাবুর কাছে আলোচনার মাঝে গ্রামের একটা সার্বিক চিত্র ফুটে ওঠে নীলেন্দুর চোখে। খাওয়া হয় গেলেও আরো কিছুটা গল্প চলতে থাকে সুবল বাবুর সাথে, এরপর সুবল বাবু বিদায় নিলে ক্লান্ত দেহে নীলেন্দু শুয়ে পড়ে ভাবতে থাকে আজ স্বাধীনতার পর দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এসে দেশ জুড়ে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করতে চাওয়ার মুহূর্তে দাঁড়িয়েও বহু গ্রামে কোন বিদ্যালয় তৈরি করা যায়নি। সুশীলার মত মেয়েদের ন্যুনতম শিক্ষা টুকু নিতে প্রায় হেঁটে সাত কিলোমিটার দূরের স্কুলে যেতে হয়। আরো দূরে যেতে হবে বলে ভালোভাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হয় , কোথায় যেন মনটা ভারী হয়ে উঠতে থাকে। বাড়িতে বেশ কয়েক বার ফোন করার চেষ্টা করলেও নেটওয়ার্ক না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন ভোরে উঠেই ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়লো নীলেন্দু। এদিক ওদিক কিছুটা জঙ্গলে ঘুরে কয়েক টা ছবি তুলল বেশির ভাগই ল্যান্ডস্কেপ,সাথে কাঠবেড়ালি ও নাম না জানা বেশ সুন্দর রঙিন পাখি,এবং হরিণের একটা ছোট দল। মনটা বেশ ভালো হয় যায় এমন ছবি পেলে। বেশ শান্ত সুন্দর জায়গা কিন্তু তার মাঝে বেলা একটু হতে বহুদূর থেকে ভেসে আসা মাইক এর আওয়াজ টাই যেন এই সুন্দর নির্জনতার মাঝে কলঙ্কের মত কাজ করছে। নীলেন্দুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বুঝতে পারছিল এ নিশ্চয় ওই রাজনৈতিক দলের প্রচার সভা থেকে আসা মাইকের আওয়াজ। প্রায় দশটা নাগাদ ঘরে ফেরার পথ ধরল।

আজ একটা বিষয় লক্ষ করল সারা গ্রাম কেমন ফাঁকা ফাঁকা রাস্তায় কোন লোক নেই। পরোটা ও আলুর দম জলখাবার নিয়ে সুশীলা এলে, তার থেকে জানতে পারে আজ ঐ স্কুলের সামনে মাঠে যে সভা আছে সেই নিয়ে বেশ অশান্তি হয়েছে আশেপাশের গ্রাম গুলিতে। এর আগে ওড়িশা গোমন্তক পার্টি থেকে মিটিং করেছিল, তখন ঐ ওড়িশা বিকাশ সংঘ থেকে খুব হাঙ্গামা করেছিল ও বোমাবাজি হয়েছিল। আজ বিকাশ সংঘ দলের মিটিং এর জন্য টেম্পো এসেছিল সাথে পালোয়ান ভাইয়া-রা ছিল। তারা প্রতি বাড়ি থেকে জোর করে সকলকে টেম্পোয় তুলে মিটিং এ নিয়ে গেছে। শুধু তাদের বাড়ির লোকজনই কলকাতা থেকে খবরের কাগজের বড় বাবু এসে রয়েছেন বলে ছাড় পেয়েছে। এদিকে ওড়িশা গোমন্তক পার্টি আজ হরতাল ডেকেছিল। গ্রাম ঘুরে ওদের ভাইয়া-রা সব দেখে ও গেছে। মিটিংয়ের মাঠে প্রচুর পুলিশ থাকবে বাইরে থেকে সব মাথায় পাখা লাগানো উড়োজাহাজে নেতারা এসে মাইকে ভাষণ দিয়ে চলে যাবে ঠিকই কিন্তু ফেরার পথে গোমন্তক পার্টি ঝামেলা করবে বলে তৈরি। সুশীলার কাছে সব শুনে কিছুটা গুম হয়ে যায় নীলেন্দু। গোটা দেশটাই যেন এক বারুদের স্তূপের ওপরে বসে আছে।

দুপুরে লাঞ্চ এর পরে আবারো ক্যামেরা টা সাথে নিয়ে জঙ্গলের পথে কিছুটা এগিয়েছে এমন সময় দেখে একজন অতি দরিদ্র মানুষ খালি গা খাটো ধুতি বিধ্বস্ত অবস্থায় একটা শিশু কে বুকে আঁকড়ে ধরে জঙ্গলের পথে দুর দিয়ে নীলেন্দু কে আড়াআড়ি ভাবে অতিক্রম করে কিছুটা দৌড়ে চলে যাচ্ছে, কোনদিকেই তার খেয়াল নেই। বেশ কিছুটা দৌড়ে গিয়েই লোকটির সামনে দাঁড়ায় নীলেন্দু আর ওকে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠে বুকের মাঝে শিশুটিকে আরও জোরে চেপে ধরে লোকটি। "কে তুমি? কোথা হতে আসছো?" বেশ কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে নীলেন্দু, বিস্ময়ে ফ্যাল ফ্যাল করে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে দেখে লোকটা। তারপর "হামার সব শেষ হয়ে গেল বাবু" বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

এরপর কাঁদতে কাঁদতে লোকটি জানায় সাথে থাকা শিশুটি তারই সন্তান। গত পরশু দিন হঠাৎ করেই জ্বর আসে সাথে শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়।তার গ্রামে কোন ডাক্তার না থাকায় প্রায় চার ক্রোশ পথ উজিয়ে সে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু কোনো বড় নেতা বা ডাক্তার বাবুর সুপারিশ না থাকায় তাকে কিছুতে ভর্তি করাতে পারেনি। শেষে বড় ডাক্তার বাবুর পা ধরে কাঁদতে থাকায় তিনি দয়া পরবশ হয় শিশু টি কে ভর্তি করেন। পরশু রাত টা কাটলেও সকাল থেকে আবার জ্বর। বেলা বাড়লে সে অনেক চেষ্টা করেও কোন ডাক্তার বাবুর দেখা পায়নি, কারণ বাইরে থেকে অনেক বড় বড় নেতা আসবেন তাই ডাক্তার বাবুকে এই মিটিং এ উপস্থিত নেতাদের জন্য বিশেষ ডিউটি করতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব গ্রামের হাসপাতালে তো আর বেশি ডাক্তার বাবু থাকেন না। সন্ধ্যার পর ছেলের অবস্থা খারাপ হতে থাকে, জ্বরের সাথে পাল্লা দিয়ে বারে শ্বাস কষ্ট। ছটফট করতে করতে ভোর রাতের দিকে একসময় সকল কষ্টের অবসান ঘটে। সকল মায়ার বাঁধন কাটিয়ে ছেলে পাড়ি দেয় অন্য লোকে।

অন্যের জমিতে জন খাটা মানুষটির কাছে পাঁচ হাজার টাকা স্বপ্নের মতোই, তাই সেই অর্থ দিতে না পারায় একমাত্র সন্তানের মৃতদেহ বুকে নিয়ে সে হাঁটা দিয়েছে ঘরের পথে। বছর চারেকর শিশুটির মুখখানি দেখে নীলেন্দুর নিজ কন্যার ছোটবেলার মুখটা ভেসে ওঠে। মনের মাঝে সমস্ত শিক্ষা চেতনা বিবেক সব কিছু হারিয়ে, একটা যন্ত্রণা ও অন্ধ ক্ষোভ যেন হাতুড়ি মারতে থাকে তার মাথার মধ্যে। লোকটিকে বুকে টেনে নেয় নীলেন্দু।

অনেক কষ্টে তার পরিচিত ফরেস্ট অফিসার অমল মহাপাত্র কে ফোনে পায় তারপর অমল বাবুর সহায়তায় ঐ লোকটিকে নিয়ে তার গ্রামে সেখান থেকে এই গ্রামের বাইরে জঙ্গলের মাঠে । এত ছোট শিশু কে দাহ এর বদলে কবর দেওয়া প্রচলিত বিধি।এই ছোট দেহ স্নান করিয়ে নতুন কাপড়ে মুড়ে পরম যত্নে মাটির বেশ কয়েক ফুট নিচে সদ্য কাটা গর্ত টাতে শুইয়ে দেওয়া হয়।প্রয়োজনীয় সব খরচ নীলেন্দুই করেছে, বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়েছে শরীর জুড়ে। এক সন্তানহারা পিতা কে সে হাতে হাজার পাঁচেক টাকা দিতে গেছিল, কিন্তু লোকটি জানায় "বিয়ের দীর্ঘকাল পর ঈশ্বরের আশীর্বাদে পাওয়া অমূল্য ধন ই যখন হারিয়ে গেল তখন এই সামান্য ধন আর কোন প্রয়োজন নেই, বাবু"

লাল ডুবন্ত সূর্য্য কে পিছনে ফেলে ধীর পায়ে কবরখানা ছেড়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়িতে এসে বসে নীলেন্দু। সুবল বাবুকে এই দুদিনের জন্য অর্থ দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে এখুনি বেড়িয়ে পড়তে হবে কলকাতার পথে। অস্বাভাবিক নিঃসঙ্গতা গ্রাস করছে, এক মুহুর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছে নেই তার পালাতে চাইছে এই অঞ্চল ছেড়ে। ওদিকে দূরে তখনও লাউড স্পিকারে ভেসে আসছে "মনুষ্য বিকাশ কে সাথী ওড়িশা বিকাশ পার্টি জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ..."

.    .    .

Discus