ঠিক কবে থেকে অন্যান্য বাঙালির মতো রবীন্দ্রনাথ এর সাথে আমার ও পরিচয় ঘটল নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না।তবে স্কুলে ভর্তি হলাম।বরাহনগর রামকৃষ্ণ মিশনের মেন গেট ছাড়িয়ে দুপাশে উচ্চ বিদ্যালয় ভবন,ডাক্তার খানা,খেলার মাঠ তার পর ডান দিকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মন্দির বাম দিকে সাধু মহারাজ দের বাসভবন, বাগান এসব ছাড়িয়ে কিছু টা পুর্বপ্রান্তে হেঁটে গিয়ে আমাদের প্রাথমিক বিভাগ এর ভবন।সেই ভবনের মুল দ্বারে একটা বিরাট সাইজের একজন সাদা বড় দাড়ি বিশিষ্ট মানুষের বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে থাকার ছবি। কি দারুন ভাবে আমার দিকে চেয়ে আছেন। বাবা বলেছিল "প্রনাম কর ইনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।" প্রনাম করে ভেবেছিলাম ইনি ও বোধহয় ঐ ঠাকুর ঘরে থাকা অন্যদের মতো আরও একজন। প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়লাম - আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। জানলাম ইনি শুধু ঠাকুর ঘরে আটকে থাকা ঠাকুর নন খুব সুন্দর কবিতা লেখেন।কালের নিয়মে বড় হলাম।স্কুল জীবনের বোধহয় নবম শ্রেনীতে পাঠ্য ছিল পোস্ট মাস্টার।এক নতুন জগতের জানলা খুলে গেল চোখের সামনে।উঠলাম দশম শ্রেণী পড়লাম কর্ন-কুন্তী সংবাদ, ছোট গল্প অতিথি।কর্নের মাতৃস্নেহ পিয়াসা,কুন্তীর লোকলজ্জা- সন্তানের প্রতি ভালোবাসা বা ফটিকের জীবন নদীর জল মাপার চেষ্টা "এক বাঁও মেলে না দোওওও বাঁওওওওও মেলেএএএএএএ নাআআআআআআ,কেমন যেন চেতনা কে অবশ করে দিল।আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথ কে।তাঁর কবিতা,গল্প, উপন্যাস।বার বার শুনলাম তাঁর গান।যতবার পড়ি দেখি প্রতিবার এক নতুন অর্থ নিয়ে হাজির তিনি। যুবা বয়সে লিখেছেন মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান।আর বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে শেষের কবিতা।প্রথম যখন শেষের কবিতা পড়ি ঐ স্কুল জীবনে,খুব মন খারাপ হয়েছিল।কেন রবীন্দ্রনাথ এমন বিচ্ছেদ আনলেন? অমিত -লাবন্যর মিল কি কারনে হলো না ! আজ জীবনের উপান্তে এসে অনুভব করি বিচ্ছেদের মাঝেই লুকানো মহা মিলনের সুর।একবার কয়েক বছর আগে আমার ই স্কুলের ছাত্র দের টীম নিয়ে নেচার ক্যাম্প করতে গিয়ে ছিলাম শুশুনিয়া পাহাড়।সেখানে শুশুনিয়া পাহাড়ে শাল গাছের জঙ্গলের মাঝে চাঁদ উঠতে দেখে ঘাস আর ঝরা পাতার রাজসিক শয্যায় শায়িত হয়ে গেয়েছিলাম "যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙলো ঝড়ে…" জীবনের প্রতিটি অনুভুতিতেই তার ই সুর।যে দিন বাবা কে হারিয়েছিলাম সেদিন সৎকার করে এসে একাকী শুনেছিলাম "ভরা থাক স্মৃতি সুধায় বিদায়ের পাত্রখানি…..।" মাত্র কয়েক দিন আগে জীবনর পাত্র কে আরো কিছুটা শুন্যকরে বিদায় নিলেন সেজ পিসেমশাই লকডাউনে হাজির হতে ব্যার্থ হলাম।একাকী বসে বার বার শুনলাম "আছে দুঃখ,আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে।" জীবনের উপান্তে পৌঁছে যেন শুনতে পাই---"আজি জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…।" "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরনধূলার পরে…"।এভাবেই কখন যেন মিশে গিয়ে হৃদয়ের মাঝে মিশে আছেন সেই উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিয়ে চির উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথ।