কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। স্বামীজী একদিন বসে আছেন বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে। শীতের বিকেল। স্বামীজীর পাশে এসে বসলেন নিবেদিতা (Sister Nivedita)। নিস্তব্ধতা ভাঙলেন স্বামীজী। বললেন, সিস্টার। এভাবে বসে বসে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না। নিবেদিতা একথা শুনে বললেন, 'বলুন স্বামীজী কি করতে হবে? উত্তরে স্বামীজী বললেন, "সারা পৃথিবীকে আমি ভারতীয় দর্শন বোঝালাম। কিন্তু, আমি নিজে কি আজও ভারত মাকে জানার চেষ্টা করেছি? ভাবছি পায়ে হেঁটে আমি ভারত মাকে দর্শন করব। তুমি কি পারবে আমার সঙ্গে যেতে?" উত্তরে নিবেদিত বললেন, " এটা তো আমার পরম সৌভাগ্য। এই দেশকে আমি নিজের দেশ ভেবে সব ছেড়ে চলে এসেছি। এই দেশকে চেনা জানার সৌভাগ্য আমি অর্জন করতে চাই। যত কষ্টই হোক, আমি আপনার সঙ্গে যাব।"
সেই মতো দক্ষিণের কন্যাকুমারী থেকে শুরু হল পায়ে হেঁটে ভারত দর্শন। স্বামীজীর পরের গন্তব্য কাশ্মীর উপত্যকা।
টানা প্রায় ৬ মাস পথ চলে, অক্টোবর নাগাদ স্বামীজী পৌঁছান কাশ্মীর। ক্লান্ত অবসন্ন স্বামীজীর শরীর আর চলছে না। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। উপত্যকার একটি ফাঁকা মাঠের পাশে একটি পাথরের খণ্ডের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন স্বামীজী। মাঠে তখন খেলা করছে কয়েকটি স্থানীয় শিশু ও কিশোর। একটি বছর পাঁচেকের শিশুকন্যাও রয়েছে তাদের মধ্যে। স্বামীজীর ওই শিশুকন্যাটির দিকে বারবার চোখ যাচ্ছে। স্বামীজী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। কিছুক্ষণ পর মেয়েটির মা, তাঁর মেয়েকে ডেকে, একটি পাত্র করে কিছু খাবার দিয়ে গেলেন। মেয়েটি খাবারটি সবে মুখে তুলতে যাবে, এমন সময় দূর থেকে একটি ছোট ছেলে চিৎকার করে নিজেদের ভাষায় কিছু একটা বলতে বলতে মেয়েটির কাছে ছুটে এল। ছেলেটি ওই বাচ্চা মেয়েটির চেয়ে বয়সে ছোট। এরপর মেয়েটি নিজের মুখের খাবারটা রেখে দিল আবার পাত্রের মধ্যে। তারপর খাবার সহ পাত্রটি এগিয়ে দিল ওই ছেলেটির দিকে।
স্বামীজী এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে উঠে দাঁড়ালেন আর চিৎকার করে বললেন, "সিস্টার আমি পেয়ে গিয়েছি।" নিবেদিতা চমকে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, "কি পেলেন স্বামীজী?" উত্তরে স্বামীজী জানান, "মা দুর্গাকে পেয়ে গিয়েছি। সিস্টার আমি ভারত মা কে খুঁজে পেয়েছি!" তারপর নিবেদিতার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, "ওই-ওই দেখো দেখো সিস্টার যে মেয়েটা নিজের মুখের খাবার, হাসতে হাসতে ভাইয়ের মুখে তুলে দিতে পারে যুগ যুগ ধরে সেই তো আমার মা দুর্গা। সেই তো আমার ভারত মাতা। সিস্টার, তুমি পুজোর উপকরণ সাজিয়ে ফেলো। আগামীকাল দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে এই মেয়েটিকেই আমি ক্ষিরভবানী মন্দিরে, দুর্গার আসনে বসিয়ে কুমারীপুজো করব। আমি যাচ্ছি মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা বলতে।"
ঠিক তখনই স্বামীজীর রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন কাশ্মীরি পণ্ডিত। তাঁরা স্বামীজীর পথ আটকে বললেন, "স্বামীজী আপনি দাঁড়ান। আপনি না জেনে বুঝে এক মস্ত ভুল করতে যাচ্ছেন। আপনি ওই মেয়েটিকে কখনওই দুর্গা রূপে পুজো করতে পারেন না। ওর জন্ম মুসলমান ঘরে। ওর বাবা একজন মুসলমান শিকারা চালক। ও মুসলমানের মেয়ে।" এই কথা শুনে স্বামীজীর দুটো কান লাল হয়ে গিয়েছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। স্বামীজী গম্ভীর গলায় বললেন, "আপনারা আপনাদের মা দুর্গাকে হিন্দু আর মুসলমানের পোশাক দিয়ে চেনেন। আমি আমার মা দুর্গাকে অন্তরাত্মা দিয়ে চিনি। ওই মেয়েটির শরীরে হিন্দুর পোশাক থাক বা মুসলমানের পোশাক, ওই আমার মা দুর্গা। আগামীকাল ওকেই আমি দুর্গার আসনে বসিয়ে পুজো করব। আপনাদের যা ইচ্ছে তাই করুন।"
পরদিন সকাল...
দুর্গাপুজার অষ্টমী। ক্ষিরভবানী মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে, শাঁখ বাজছে! আর সেই মন্দিরেই মুসলমানের মেয়ে বসে আছে কুমারী সেজে। পুজো করছেন, 'কায়েতের ছেলে' হিন্দুসন্ন্যাসী বিবেকানন্দ। পুজোর উপকরণ সাজিয়ে দিচ্ছেন, আইরিশ সন্তান মিস মার্গারেট ওরফে নিবেদিতা।
এই ঘটনার বহু বছর পর বেলুড় মঠের এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে মুসলমানের সেই কুমারী মেয়েটির দেখা হয়। স্বামীজীর কথা শুনে সে কেঁদে ফেলে ও বলে, "উনি আমাকে “উমা” জ্ঞানে পুজো করেছিলেন। পরে শুনেছি ওঁর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের কুমারী পুজো পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছে। কিন্তু, সেসবের আগে ওঁর নিজের হাতে উমারূপে পুজো করা প্রথম কুমারী আমি―একজন কাশ্মীরি মুসলমান মেয়ে। যেদিন তিনি কাশ্মীর ছেড়ে চলে গেলেন, সেদিন আমি তাঁর জন্য এক থালা আপেল নিয়ে টাঙ্গা পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছিলাম। কেন জানি না, সেদিন তাঁকে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। তারপর তিনি আর খুব বেশি বছর বাঁচেন নি..."।
তথ্য ঋণ:
যুগনায়ক বিবেকানন্দ- স্বামী গম্ভীরানন্দ (খণ্ড২-৩)। পত্রাবলী- স্বামী বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দ স্মৃতি।