শক্তি বা এনার্জি হলো কোন ব্যক্তি কিংবা বস্তুর অন্তর্নিহিত একটি মৌলিক ধর্ম যা ওই ব্যক্তি কিংবা বস্তুটিকে কাজ করার সামর্থ্য যোগায়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে সমস্ত জড় এবং জীব নিজের প্রয়োজনে শক্তি ব্যবহার করে। শক্তি কে জুল, কিলোওয়াট-ঘন্টা, ক্যালরি, ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট, থার্ম, কিলো ক্যালরি প্রভৃতি এককে মাপা হয়। প্রকৃতিতে শক্তি গতি, স্থিতি, আলোক, জল, বায়ু, সৌর, বৈদ্যুতিক, তাপ, নিউক্লিও, এবং রাসায়নিক প্রভৃতি রূপে বিরাজ করে।
পৃথিবী যেমন তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে শক্তি খরচ করে, তেমনি প্রাণীকূলও তার দৈনন্দিন জীবনে নানা প্রয়োজনে শক্তি ব্যবহার করে। তবে শক্তি সংরক্ষণের সূত্র জানায়, শক্তি কে কখনো তৈরি বা ধ্বংস করা যায় না। শুধুমাত্র এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত করা যায়। বাইরে থেকে কোন অতিরিক্ত শক্তি যোগ করা না হলে সময়ের সঙ্গে পুরো সিস্টেম জুড়ে শক্তি একই থাকে। আজ অত্যাধুনিক বিশ্বে আমরা মানুষ জাতি আমাদের অতিরিক্ত বিলাস বৈভবের তৃষ্ণা মেটাতে শক্তির যথেষ্ট অপচয় করছি। তাৎপর্যপূর্ণভাবে আমরা অধিকাংশ সময়ই সেই ধরনের শক্তি খরচ করে থাকি যা পুনরায় নতুন করে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। ফলস্বরূপ ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের সীমিত শক্তি ভান্ডার আজ বিপদের মুখে।
অ-পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার এবং শক্তির অপচয় আজ মানবসভ্যতার জন্য অভিশাপ বয়ে আনছে। পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে বায়ু দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন তথা বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো মারাত্মক বিপদ আজ সামগ্রিক প্রাণীকূলের আর্থিক, শারিরীক, সামাজিক ও মানসিক আরাম কেড়ে নিয়েছে। তৈরি হচ্ছে অস্তিত্বের সংকট। এরজন্য দায়ী শক্তির ব্যবহারে আমাদের অবিবেচক ও অনিয়ন্ত্রিত মানসিকতা।
তাই প্রয়োজন শক্তির সংরক্ষণ। সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে নতুন শক্তি উৎপাদনের চেষ্টার চেয়েও শক্তির সংরক্ষণই সবচেয়ে বেশি উপযোগী। দৈনন্দিন জীবনে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, যেমন জোয়ার ভাটার শক্তি, বায়ু শক্তি, সৌর শক্তি প্রভৃতির প্রয়োগ বৃদ্ধি করা এবং অকারণে শক্তির অপচয় কম করা একান্তই জরুরি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ খ্রীস্টাব্দের নিরিখে ভারতবর্ষ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি ব্যবহারকারী দেশ এবং আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিক প্রতি বছর প্রায় ২৭.৩ গিগাজুল পরিমাণ শক্তি খরচ করে। আশঙ্কা আগামী দু’এক দশকের মধ্যে এই মাত্রা মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যাবে।
শক্তি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সমগ্র পৃথিবীর নানা দেশের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সরকার শক্তি সংরক্ষণ(সংশোধনী) আইন-২০২২ অনুযায়ী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যাতে শক্তির পুনর্নবীকরণ এবং পুনঃব্যবহার সম্ভব হয়। তৈরি হয়েছে ব্যুরো অব এনার্জি এফিসিয়েন্সি। বিল্ডিং এবং যানবাহন ও যন্ত্রপাতির শক্তি অপচয় রোধে আনা হয়েছে এনার্জি কনজারভেশন বিল্ডিং কোড, পারফরম্যান্স স্কীম ও স্ট্যান্ডার্ড লেবেলিং প্রোগ্রাম। বাজার এবং শিল্পক্ষেত্রে শক্তির পরিমিত ব্যবহারে উৎসাহ দিতে লাগু হয়েছে ন্যাশনাল মিশন ফর এনার্জি এফিসিয়েন্সি অ্যান্ড টেকনোলজি। লক্ষ্য স্থির হয়েছে আগামী ২০৩০-এর মধ্যে কার্বন নির্গমন ৪৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে এবং ২০৭০ নাগাদ কার্বনের শুন্য নির্গমন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের মাইক্রো সোলার ডোম, বায়োমাস পাওয়ার প্লান্ট, রাজস্থানের বায়ো-ফুয়েল পলিসি, এলইডি ও স্ট্রীট লাইট প্রোগ্রাম সবই শক্তি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের গ্রীন হাইড্রোজেন পলিসি-২০২৩ এবং কোলকাতার এনার্জি এডুকেশন পার্কও শক্তি সংরক্ষণের কথায় বলে।
সর্বোপরি দেশ বিদেশের আইন কানুনের উর্ধ্বে হলো সাধারণ মানুষের সচেতন হয়ে ওঠা। আমরা চাইলেই খুব সহজেই শক্তির অপচয় বন্ধ করে সংরক্ষণ করতে পারি। প্রতিদিন যদি আমরা একটু সচেতন হয়ে শক্তির প্রয়োগ করি, যেমন সবসময় গিজার ব্যবহার না করি, এসি সবসময়ের জন্য না চালিয়ে দু’এক ঘন্টা চালায়, ফ্রীজে খাবার রাখার আগে যদি খাবার ঠান্ডা করে নিই, যানবাহনের ইঞ্জিন নিয়মিত পরিচর্যা করি, যদি কৃত্রিমতা একটু দূরে সরিয়ে প্রকৃতিতে আপন করে নিই তাহলেই শক্তি সংরক্ষিত হবে, এবং সভ্যতা হয়ে উঠবে সুন্দর।