Image by Robert Cheaib from Pixabay 

নিবাস,

বাগবাজার। ১৮নংবাড়ি। বাড়িতে আছে বলতে, মৃণাল ভট্টাচার্য, তার স্ত্রী জয়ন্তী ভট্টাচার্য এবং দুই ছেলে। দুজনেই কর্মক্ষেত্রে বাইরে থাকে।

তারা কোনো খোঁজ খবর ও রাখে না। তবে মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তারা বহুবছর পরে এলেন। ৫০ বছর বিবাহ অতিক্রম করে আজ যেন মৃণাল বাবুর এই দিনটি কেন এলো তিনি বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছেন। বিগত ৪ বছর ধরে হার্টের অসুখ সহ্য করে যাচ্ছিলেন জয়ন্তী ভট্টাচার্য। অনেক চিকিৎসা করেও ফল বলতে ব্যার্থতা। মৃণাল বাবুর পাশে আছেন বলতে প্রতিবেশী মাত্র। পুজোটা সবে মাত্র গেল। গেল বলতে ওষুধ এর মাধ্যমে ভোজ আর যন্ত্রণা সহ্য করে থাকা পুজো। আজ সব শেষ।

বেখেয়ালবশতঃ.....

পাঞ্জাবির বোতাম টা লাগিয়ে দিয়ে যাও তো"....মৃণালবাবু হঠাৎ বলে থেমে গেলেন। আজ তো মহালয়া। আজকে তার স্ত্রী অর্থাৎ জয়ন্তী দেবী গত হয়েছেন। ভোর ৫টা। মৃণালবাবু কেমন যেন থমথমে। হঠাৎ ই মে সব ঘটে গেল। বাড়ি ভর্তি লোকজন। পাশের ঘর থেকে বড়ো ঘরে এলেন। মাটিতে স্থির হয়ে বসে থাকলেন। সামনে তার বিবাহিতা স্ত্রী এর শবদেহ । লাল সিঁদুরে সিঁথি ভরে গেছে। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি , রজনীগন্ধার মালা, চন্দন এ সাজানো হয়েছে তাকে। সম্বিত ফিরতে, ছেলে বলল, " গাড়ি এসে গেছে, এবার যে যেতে হবে"। চোখে একরাশ জল ভরে ছেলের দিকে তাকালেন। গালের দুপাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো । নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন। চলে গেলেন বাইরে। শবদেহ বহন গাড়িতে স্ত্রী কে সযত্নে শুইয়ে দিলেন। শেষ বারের মতো সিঁদুর টা পড়িয়ে দিলেন।

কিছু সময় পরে শ্মশানে উপস্থিত হলো সকলে। মৃণালবাবু গাড়ি থেকে নামলেন। স্ত্রী কে নামালেন। নামানোর সাথে সাথেই তার মনে হলো অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। শ্মশানের লোকজন এসে তার স্ত্রী কে তড়িঘড়ি নিয়ে যাচ্ছে ওরা। দুই ছেলে এবং বাকি বাড়ির লোকেরা কাউন্টারে কথা বলছে।

শবদেহের কোনো লাইন নেই। কাজেই তার স্ত্রী প্রথম বৈতরণী পার করবেন।

পুরোহিত মশাই বললেন, "মুখাগ্নি কে করবেন??"

মৃণালবাবু বললেন, " আজ থেকে ৫০ বছর আগে ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম, আর আজ বৈতরণী পার করার শেষ দায়িত্ব টা নিয়ে নিই"। টলমল করে মাটি থেকে উঠলেন। বৃদ্ধের ৭০ বছর বয়স। নিয়ম-কানুন সারলেন। পিন্ড দান করলেন। হারিয়ে গেলেন, ৫০ বছর আগে। যে হাতে তিনি তাকে ভালোবেসে তার স্ত্রী এর পছন্দের ফুচকা খাওয়াতেন, যেই হাতে তার স্ত্রী এর অসুস্থকালে সেবা করেছেন, স্ত্রী এর মাথায় হাত রেখেছেন,সেই হাতে আজ পিন্ড টাও দান করে দিলেন। পরের পর্ব মুখাগ্নি। এই পর্ব সেরে গেলো। এবার ৫০ বছরের মায়া কাটিয়ে চিরজীবনের বিদায় পালা। শেষ বারের মতো স্ত্রী কে ছুঁয়ে দিলেন। তিনি এবার উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন। বসে পড়লেন তার স্ত্রী এর শবদেহের সামনে। স্ত্রী যেন বলছেন, সময় আমার ফুরিয়ে গেলো,এবার যে যেতে হবে।

চুল্লিতে ঢুকিয়ে দিলো তার ৫০ বছর ধরে একসাথে থাকা মানুষ টিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পোড়া ছাই এ মাখা নাভি তার হাতে দিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে বললেন।

গঙ্গায় নামতে তার অস্পষ্ট চোখে দেখলেন , তার স্ত্রী বৈতরণী পার করলেন। তার স্ত্রী যেনএকবার ফিরে চাইলেন মায়াত্যাগ করা দুনিয়াটার দিকে আর তার সেই প্রিয় বন্ধু কে।

সবাই বাড়ি ফিরে এলো। তার স্ত্রী স্মৃতি হিসেবে দিয়ে গেলেন, তার গায়ের গন্ধ, ছবিতে থাকা রজনীগন্ধা, ধূপ আর গঙ্গার জলের স্মৃতি। তিনি বৈতরণী পার করেছেন। মৃণালবাবুর দায়িত্ব পালনের পালা শেষ। এবার তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন........

- রূপাশ্রী দত্ত

Discus