কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আজ কিছুদিন হয়েছে। পান্ডবদের জয় নিশ্চিত করতে হলে কোন যুবার বলিদান প্রয়োজন মা কালীর সামনে। কিন্তু কে করবে এই কাজ! তখন সামনে এগিয়ে আসে অর্জুন আর উলুপির সন্তান আরাবান। কিন্তু তার অন্তিম ইচ্ছা, মৃত্যুর আগে সে একবার অন্তত বৈবাহিক জীবনের স্বাদ পেতে চায়। কেউ রাজী হয় না। কেই বা রাজী হবে? বিবাহের অনতিপরেই স্বামীর নিশ্চিত মৃত্যু জেনে কোন নারীর এগিয়ে আসা মানেই অকাল বৈধব্য বরণ করা। তখন নিরুপায় হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মোহিনী রূপ ধরে এগিয়ে আসেন আর আরাবানকে বৈবাহিক জীবনের দর্শন করান। কিন্তু পরেরদিন শর্তানুযায়ী আরাবানের শিরচ্ছেদ হয় মা কালীর সামনে আর শ্রীকৃষ্ণ বৈধব্যের সমস্ত আচার পালন করেন।
মহাভারতে বর্ণিত এই অংশটা প্রত্যেক বছর দক্ষিণ ভারতে কুভাগাম নামক গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে লর্ড আরাবান এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আরাবানীরা/কিন্নররা। কুভাগামে ১৮ দিনের একটা উৎসব হয় যা 'এশিয়াস্ বিগেস্ট ট্রান্সজেন্ডার ফেস্টিভ্যাল' নামে পরিচিত। তাতে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজনের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানও হয় যা একদিনের জন্য হয়ে পরেরদিন বৈধব্য দশায় পর্যবসিত হয়। এবার এখানেই প্রশ্ন কেন এরা প্রতি বছর একদিনের জন্য বিয়ে করতে দূর দূরান্ত থেকে আসে। শুধুই কি 'লর্ড আরাবানের স্ত্রী' আখ্যা পেতে? আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। কিন্তু একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে বেরিয়ে আসে সমাজের এদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।
ভারতে কোন শিশু কিন্নর হিসেবে চিহ্নিত হলে তাকে কিন্নর সম্প্রদায় এসে নিয়ে যায় নিজেদের গোষ্ঠীতে রেখে নিজেদের মত তৈরি করবে বলে। শুধু তাই নয় অনেক পরিবারও এইধরনের শিশুকে নিজেদের কাছে রাখতে চান না সমাজে একঘরে হয়ে যাবে বলে বা নিজেরাই এইধরনের শিশুকে কিন্নর সম্প্রদায় এর অধীনে পাঠিয়ে দেয়, কারণ কিন্নর সন্তানকে নিজেদের সন্তান বলে পরিচয় দিতে ঘৃণা বোধ করে। অনেক সময় এইসব শিশুরা ঠিকমত পু৺থিগত শিক্ষা পায় না। ফলস্বরূপ ভিক্ষা বৃত্তি, যৌনদাসীর কাজ করে দিন গুজরান করতে হয়। সমাজ মনে করে কিন্নররা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়, তাদের বিয়ে কোনদিনও হবে না। তাই তারা প্রতি বছর দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে এই উৎসবে অংশ নিতে। এই উৎসবের একদিন বিউটি কনটেস্ট হয়। যে মিস্ কুভাগাম এর খেতাব জেতে তার মাথায় মুকুট ওঠার সাথে সাথে অনেক নিউজ চ্যানেল এর তরফ থেকে মিডিয়া কভারেজ পায়। এই মিডিয়া কভারেজ তাদের বাড়ি ফেরার রাস্তা কিছুটা সহজ করে দেয়। বিয়ের পরেরদিন সকালে বৈধব্য আচার পালন করার সময় স্বামী হারিয়ে তাদের যে গগনভেদী হাহাকার, তা খুবই হৃদয় বিদারক। মানছি এটা একটা অনুষ্ঠান এবং তাতে তারা শুধুই আচার পালন করে। কিন্তু একজন নারী হিসেবে তাদের ঐ সময়কার মনস্থিতি অনুধাবন করলে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
কুভাগাম সংলগ্ন গ্রামগুলির অধিবাসীরা খুব অসন্তুষ্ট হয় এদের উপস্থিতিতে। তাদের বক্তব্যনুযায়ী, তাদের ছেলেরা কিন্নরদের জীবনশৈলী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিপথে চলে যাচ্ছে। আমরা কোন যুগে বাস করছি? যে যুগে ইন্টারনেট, টিভির দৌলতে যৌন তারকারা হাতের মুঠোয়, রিয়েলিটি শো তে ছোট ছোট বাচ্চারা বড়দের নকল করে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে নৃত্য প্রদর্শন করে এবং তাতে তাদের বাবা মায়েদের উৎসাহের অন্ত নেই, সেই সমাজ কিন্নরদের জীবনযাত্রার দিকে আঙ্গুল তুলছে?
এই উৎসবের সময় বহু কিন্নর যৌনকাজে লিপ্ত হয় পেট চালানোর জন্য রাস্তার ওপরেই রাতের অন্ধকারে। পুলিশ প্যাট্রলি়ং টিম তাদেরকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে লক্ আপ এ ভরে। কিছু টাকা অথবা কোন পুলিশ অফিসারের সাথে রাত্রিযাপনের বিনিময়ে তারা হয়তো মুক্তি পায়। উত্তর- জানা নেই।
ভারতীয় ইতিহাসে, মহাভারত, রামায়ন, সান টেম্পল, খাজুরাহো, সমস্ত মাইথোলজিতে কিন্নরদের সম্মানীয় স্থান দেওয়া হত। পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় মুঘল ও ইংরেজদের এদেশে আগমনের পর। কিন্নরদের ভাষায় প্রাচীন কালের রাজাদের মহলে যত সেনাপতি, কাউন্সিলর ছিলেন, তাদের অধিকাংশই কিন্নর ছিলেন। মুঘলরা সেটা জানতেন। তারা কিন্নরদের নীচু দেখানোর জন্য এই লিঙ্গ প্রকারভেদ শুরু করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আজকের আধুনিক সমাজও তাদের নীচু দেখাতে এতটুকু পিছপা হয়নি। সুযোগ পেলেই সেটার সুন্দর করে সদ্ব্যবহার করেছে। ক্যামেরা, মঞ্চ- সবজায়গাতেই কিন্নরদের হাসির পাত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। নাহলে দেখানো হয়েছে যে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এইসবদ্বারা এটাই প্রমানিত হয় যে ভারতীয় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই এমন ছিল যেন এটাই তাদের ভবিতব্য। কিন্নররা রাস্তায়, বাস, ট্রাম, ট্রেনে ভিক্ষা করে, যৌনবৃত্তি করে দিন গুজরান করে। তাদেরকে এতটা নীচু চোখে দেখা হয় যে তাদের যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সব মানুষই বা৺চার জন্য যে কোন রাস্তা অবলম্বন করবে। এরাও তাই করেছে। তথাকথিত সভ্য সমাজ কিন্নরদের নর্ম্যাল মানুষ বলে ভাবতেই পারেনা। আজকের তারিখেও কোন ফর্ম ভরতে গেলে দেখা যায় জেন্ডার এর জায়গায় লেখা আছে মেল, ফিমেল এবং আদার। এই আদারটা কেন? ডঃ রা তো রিসার্চ করে বলেন যে, এটা শুধু মাত্র একটা ক্রোমোজোম ডিসঅর্ডার। তাহলে এদেরকে কেন আলাদা লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে?
কিন্নরদের আমরা ভদ্র, শিক্ষিত লোকেরা 'হিজড়া' বলে গালি দি। প্রথমত হিজড়া শব্দটি কোন গালি নয়। হিজড়া শব্দটি এসেছে উর্দু থেকে যার উৎপত্তি আরবি শব্দ হিজড় থেকে। এর অর্থ 'অনেকের মধ্যে অন্যদিকে হা৺টা'। দ্বিতীয়ত আমরা জানি কি হিজড়া হল পৃথিবীর সবথেকে পুরোনো কমিউনিটি যাদেরকে ভগবানের দূত বলে মানা হত। এরজন্য এদের অন্যদের আশীর্বাদ দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ওরা যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতে আসে আমরা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নি। আর এটা আমরা করি কারণ ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় ওদের ঘৃণা করতে। কাদের করুনা করা উচিত? ওদের না আমাদের?
আসলে সমস্যাটা গোড়ায়। আমরা সেটাই মেনে চলি যেটা আমাদের ছোট থেকে শেখানো হয়। কেন আমরা পড়াশোনা শিখে নিজেদের বিচার বুদ্ধির ওপর নির্ভর করতে পারি না? আমাদের বোঝানো হয় ওদের এড়িয়ে চলতে, আমরাও কিছু না ভেবেই ওদের দূরে সরিয়ে রাখি। কেন দূরে সরিয়ে রাখছি তার কারণ আমরা খুঁজতেও যাই না। প্রত্যেকেই মানুষ। অন্যদের নীচু চোখে দেখার কোন অধিকার আমাদের আছে কি? সম্মান না করতে পারলেও অসম্মান করার অনুমতি পাই কোথা থেকে? কিন্নর মানেই যৌনতা সম্পন্ন কাজে লিপ্ত, আমরা এটাই ভেবে চলি। মেনে নিলাম এটাই সত্যি। তাতেও কি আমাদের কিছু বলার আছে? শরীরটা তার, সেটা সে কততে বেচবে, কার কাছে বেচবে-সে ভাবনা একান্তই তার। আমরা কি এখন তাদের সেই ভাবনাটাও ছিনিয়ে নেব? তাদের ভাবনা নিয়ে এত সমালোচনা করারই বা কি আছে? আমাদের কাছে হিজড়া মানেই যারা গালি দিয়ে, তালি মেরে, খারাপ ব্যবহার করে টাকা উপার্জন করে। কিন্তু এই পন্হাই কেন তারা বেছে নিয়েছে সেটার খবর আমরা রাখি না। প্রাচীন কালে এরা নৃত্য ও সঙ্গীত পটীয়সী হত। কিন্তু এখনকার সমাজ তাদের কোন কাজ দেয় না, তাই তারা বাধ্য হয় চুরি, ছিনতাই, তোলাবাজি করতে। এরা বাচ্চা চুরি করে বেচে দেয়-ওরে বাবা এদের থেকে দূরে থাকো। ছোটবেলা থেকে এটাই আমরা শিখে এসেছি। কিন্তু তাদের মনের খবর আমরা রাখি কি? এখন অনেক কিন্নররাই শিক্ষিত হয়ে উ৺চু পোষ্টে কাজ করছে। তারা বায়োলজিক্যালি মা হতে পারবে না বলে বাচ্চা দত্তক নিচ্ছে। তাদের সন্তানরা কিন্তু ভবিষ্যতে খুব সফলও হচ্ছে। আসলে মাতৃত্ব একটা স্বভাব যেখানে ভালোবাসা, যত্ন এবং আগলে রাখতে পারাটাই আসল মূলধন। শুধু জন্ম দিতে পারাটাই মাতৃত্বের সংজ্ঞা নয়। আর কেউ জন্ম দিতে পারছে না মানে সে নারী নয়, এটাও প্রমাণিত হয় না।
একটা শিশু যখন এই পৃথিবীতে আসে তখন সে বাবা মায়ের আশ্রয়টাকেই সবথেকে নিরাপদ স্থান মনে করে। কিন্তু সেই আশ্রয় থেকে যখন বিতাড়িত হয় তখন তার রাগটা পুরো সমাজের ওপর পড়ে। তাই সবার আগে এদের নিজেদের পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে, নিজেদের সন্তানকে নিজের বলে পরিচয় দিতে ভয়, লজ্জা পেতে বন্ধ করতে হবে। নিজেদের চিন্তায় পরিবর্তন আনলে তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একটু হলেও পরিবর্তীত হবে এটা আশা করা যায়। আসলে যে যেমন, সামনের মানুষটিকে সে সেইভাবেই দেখে।
আর সবশেষে বলি, ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ নির্মাণ বলা হয় মানুষ কে। আর সেই আমরাই মানুষের মধ্যে লিঙ্গভেদ করে ভগবানকেই কিন্তু প্রতিনিয়ত অবমাননা করে চলেছি।
Source: swarajmag com