রক্তে লত্পত্ হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে শিবানী। বয়েস ১৯ বছর। গতকাল ফুলশয্যা ছিল। কিন্তু বিয়ের ফুল ঠিকমত ফুটে ওঠার আগেই যেন শুকিয়ে মরে যাওয়ার অবস্থায় পরিনত হয়েছে। কিন্তু কেউ তার এই পরিনতির কথা শুনতে চাইবে কি! মাকে বললেই বলবে "মানিয়ে নে মা"।
গ্রাম হরিসাধনপুর। চরিত্র- ফুলি-বয়েস ৩০।
তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, নাহলে শাশুড়ি মুখ ঝামটা দেবে। কিন্তু সারা রাতের পর ঠিকমত উঠে দাঁড়ানোরক্ষমতা নেই তো বাড়ির কাজ করবে কি করে। এতবড় সংসার তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। জলখাবারে কে কি খাবে, দুপুরে কে কি খাবে- সব মুখস্ত তার। কিন্তু তার মনের জ্বালার খবর কেউ রাখে না।
এলিনার হাজবেন্ড পুস্কর আজ রাতে বাড়ি ফিরবে না। ফোনে খবরটা শুনে এলিনা একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো।জানলার সামনে দাঁড়িয়ে গত কয়েক মাসের বিভীষিকাময় রাতগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে নিজেই শিউড়ে উঠছিল। কেন তারই ভাগ্যটা এমন হল। কাকে বলবে? কেউ যে বিশ্বাসই করবে না। সেদিন কিটি পার্টিতে বৈশালীকে বলতে বললো "আরে ইয়ার সহেন্ করলে। তু নসিবওয়ালী হ্যায়। পুস্কর তুঝে ইতনা প্যায়ার দেতা হ্যায়।" ভালোবাসা!!! হবে হয়তো! এলিনার অনুভূতিগুলো ক্রমশঃ অন্তঃসারশূন্য হতে শুরু করেছে।
কি? ভাবছেন তো এসব কি আবার ছাইপাশ লিখতে শুরু করেছে। ছাইপাশই বটে। প্রাচীনযুগ থেকেই নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখা শুরু করা এই সমাজকে দোষ দিয়ে কি লাভ। সমস্যা তো ঘর থেকে শুরু। বয়ঃসন্ধি থেকেই ছেলেদের মেয়েদের শরীরের প্রতি এবং মেয়েদের ছেলেদের শরীরের প্রতি এই অমোঘ আকর্ষণকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারোর নেই। এইবয়স থেকে অন্যের শরীরটা নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই নাড়াচাড়ার চক্করে মানুষ অন্যের মনের হদিস রাখতে ভুলে গেছে। মনের গভীরে তৈরী হয়েছে এক অজানা কৌতুহল, এক বিকৃতকাম ইচ্ছে যেখানে মনের দেওয়া নেওয়া প্রায় নেই বললেই চলে। আর উৎপত্তি হয়েছে এক নতুন শব্দ।
বৈবাহিক ধর্ষণ! ব্যাস্, কিছু মানুষ তাচ্ছিল্যভরে এই লেখাটি পড়া বন্ধ করে দেবেন, কিছু মানুষ এই অধমকে মনে মনে গালি গালাজ করবেন। আবার কিছু মানুষ কৌতুহলবশতঃ নড়ে চড়ে বসবেন এই ভেবে যে, আগামীতে কি আসছে সেটা জানার জন্য। সে যে যাই ভাবুন আজকে এই কলম কিন্তু থামবে না। মনের কথা ব্যক্ত করেই ছাড়বে।
সম্প্রতি P.K সিনেমাতে আমির খানের সংলাপ ছিল "শাদী বিহা মে পটাকা ফোড়কে, ব্যান্ড বাজা বাজাকে কাহে পুরে শহের কো বাতায়ে যাতে হ্যায় কি I am having sex". এই ডায়লগে সারা হল হাসলেও যার আক্ষরিক অর্থ হল ভারতীয় সমাজ মনে করে 'বিবাহ মানেই সহবাসের সামাজিক অনুমতি। যেখানে স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।' দুই বছর আগে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উইমেন এবং জাতিসংঘের পপুলেশন ফান্ড ভারতে একটি জরিপ করেছিল যেখানে প্রায় অর্ধেক নারী বলেছেন যে তারা তাদের স্বামীদের দ্বারা যৌন সহিংসতার শিকার। ৬০ ভাগ পুরুষও স্বীকার করেছেন যে তারা স্ত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনমিলন করে পরিতৃপ্ত হয়েছেন।
কিন্তু একটু ওয়ার্ড হিস্ট্রি ঘাঁটলেই দেখা যায় যে, ১৯০০ BCE তে ব্যবিলনে কোন পুরুষ যদি অন্য কারোর স্ত্রী বা কন্যার সাথে জোর করে যৌনমিলন করতো তাহলে তার অন্যের সম্পত্তি নষ্ট করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হত। প্রাচীনকালের আইন অনুযায়ী অন্যান্য দেশগুলোতেও ধর্ষণ মানে বাবা/স্বামীর সম্পত্তি নষ্ট করাকেই চিহ্নিত করা হত, নারীর সম্মান নষ্ট করাকে নয়। কিন্তু বিয়েতে বলপূর্বক যৌনমিলন কখনই অপরাধ ছিল না। কারন, একজন পুরুষ যা খুশি করতে পারে তার সম্পত্তির সাথে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মতবাদ প্রাচীন যুগের ইতিহাস থেকে বর্তমান আধুনিক সমাজেও সমানভাবে বিরাজ করছে। ১৭০০ শতাব্দীতে কিং ডায়নেস্টি(চাইনিজ ফোক্ রিলিজিয়ন, টাওয়সম, বুদ্ধিয়েসম্ প্রভৃতি), এমনকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও আইনে সামান্য পরিবর্তন এনে দেখানো হয় যে, বলপূর্বক যৌনমিলন নারীদের প্রতি অবমাননা নয়, এটা আসলে একজন নারীর যৌন পবিত্রতা নষ্ট করার অপরাধ। কিন্তু এটা কখনোই বিবাহের পরে সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, একজন নারীর যৌন পবিত্রতা কখনোই তার স্বামী দ্বারা নষ্ট হতে পারে না, অবশ্যই! এমনকি একজন ব্রিটিশ আইনজীবী এটাও বলেছিলেন যে, বিবাহ একটা আইনি চুক্তি যার দ্বারা একজন নারী নিজেকে সমর্পণ করে তার স্বামীর কাছে সারা জীবনের জন্য। ১৮০০ এবং ১৯০০ শতাব্দীতে বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত ও ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা নারীর সতীত্বের ওপর জোর বাড়াতে থাকে। এবং নারীদের বোঝানো হয় যে, জোর করে যৌনমিলনের ভয় শুধু মাত্র ঘরের বাইরে পাওয়া উচিত যার থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার বাবা অথবা স্বামীর ওপরেই বর্তায়। ১৮৬০ এ ভারতীয় দন্ডবিধি এই আইনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদের আইনের খসড়া তৈরি করে। সেকশন ৩৭৫ এ লেখা আছে যে, ১৮ বছরের ঊর্দ্ধে কোন বিবাহিতা নারী তার স্বামীর দ্বারা বলপূর্বক যৌনমিলন অথবা যৌনসম্পন কার্যকলাপ দ্বারা আক্রান্ত হলে তাকে 'ধর্ষণ' বলা হবে না। এর খুব সহজ অর্থ হল 'বৈবাহিক ধর্ষণ' এর কোন অস্তিত্ব এর স্বীকার রইলো না ভারতীয় আইনে। পরবর্তীকালে অনেক আন্দোলনের মাধ্যমে ২০০২, ২০১২ এবং ২০১৩ তে ভারতীয় দন্ডবিধিতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনে অনেক পরিবর্তন আনলেও 'ম্যারিটেল রেপ' এ্রর কোন পরিবর্তন হয়নি। ২০১২ তে বিচারক কমিটি 'ম্যারিটেল রেপ'; কে অপরাধ হিসেবে বিবেচনার সুপারিশ করলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি 'এটি অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হলে পুরো পরিবারের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হবে, এই বলে খারিজ করে দেয়। তখন থেকে রাজনৈতিক এবং বিখ্যাত মণীষীরা পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, বৈবাহিক ধর্ষণ কে ক্রিমিনিয়ালাইজিং হিসেবে ঘোষণা করলে এটি একটি বিয়েকে খুব সহজেই ভেঙ্গে ফেলবে এবং সমস্ত পরিবারে এক বিশাল নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে।
কি? এতটা পড়ে অবাক হচ্ছেন? না অবাক হওয়ার মত কিছু কিন্তু বলিনি। পূর্ব প্রসঙ্গকে টেনে এনে বলি, পুরাতনকাল থেকেই বিবাহ মানেই স্ত্রী তার স্বামীর যৌন সম্পত্তি এবং যখনই তার স্বামী যৌন আস্বাদন পেতে চাইবে সে সেটা দিতে বাধ্য। বছরের পর বছর আমরাই বিবাহিত নারী মানেই তারই স্বামী দ্বারা যৌন অধীনতাকে নানাভাবে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছি নানা ধর্মীয় আচার, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। অন্যদিকে ৮০% নারীরা অভিযোগ করেন তাদের স্বামীরাই এই ঘটনার জন্য দায়ী যেখানে ৯% নারীরা দায়ী করেন প্রাক্তন স্বামীকে। ৫০ টিরও বেশী দেশ বৈবাহিক ধর্ষণকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে। যৌনমিলনে একজন নারীর সম্মতির পক্ষে ফেমিনিস্ট মুভ্মেন্ট হয়েছে সারা বিশ্বে। এই আন্দোলনে যৌনহিংসাকে আইনত নথিভুক্ত করতে নিপীড়িত নারীদের আহ্বানও জানান হয়েছে। কিন্তু, বিবাহিত নারী শুধুই ভোগ্য সামগ্রী, তার কোন নিজস্বতা নেই বা থাকতে পারে না- এই মানসিকতাটাই ভারতীয় আইনকেও প্রভাবিত করেছে। এই ক্রমান্বয়ী এক চিন্তাধারা শুধু যে, যৌনমিলনে নারীদের সম্মতিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় তা নয়, একাধারে নারীর পরিচয়, আত্মসম্মান, অধিকার এবংশারীরিক স্বশাসনকেও প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
এতক্ষণ জ্ঞান বিতরণের পর কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও মতামত বিনিময় করে এই লেখাটি শেষ করবো। কলেজে পড়াকালীন এক বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষে অন্য সমস্ত বান্ধবীদের সাথে তাল মিলিয়ে সেই বান্ধবীকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে, স্বামীকে শারীরিকভাবে তুষ্ট রাখতে পারলেই কিন্তু স্বামী তোর হাতের মুঠোয় এবং স্বামী অন্য মেয়েকে চোখ তুলেও দেখবে না। বিশ্বাস করুন তখনও ভাবিনি যে, দেড় বছরের মাথায় বাচ্চা কোলে যখন সেই বান্ধবী বাপের বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালো এবং তার এই পদক্ষেপ নেওয়ার কারণ শুনে শিউরে উঠেছিলাম। প্রতিদিন, প্রতিরাত, মাসিক এবং বাচ্চা প্রসবের দুদিন আগেও বলপূর্বক যৌনমিলনের গল্প শুনতে শুনতে গা গুলিয়ে উঠেছিল। তখন উপলব্ধি করেছিলাম, না জেনে বুঝেই বন্ধুকে খাদের দিকে ঠেলে দেওয়ার দলে আমিও ছিলাম। এই ঘটনার এক বছর পর নাচের স্কলারশিপ পরীক্ষায় 'ম্যারিটাল রেপ' এর ওপর ডান্স ড্রামা করে স্কলারশিপটা ছিনিয়ে নিয়েছিলাম। নাঃ, কোন ক্রেডিট নিচ্ছি না। কিন্তু যখন ডান্স ড্রামাটি শেষ করে সামনে বসে থাকা প্রায় ২০ জন শিক্ষক শিক্ষিকার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, তাদের অভিব্যক্তিই বলে দিয়েছিল যে, আমি স্কলারশিপটি পেয়ে গেছি। কারোর চোখে ছিল বিস্ময়, কারোর চোখে হতাশা আবার করোর চোখে লজ্জা। ঐ দৃশ্য দেখে সেদিন মনে হয়েছিল যে, কিছু বছর আগে যে বান্ধবীকে ভুল পরামর্শ দেওয়ার দলে নাম লিখিয়েছিলাম আজ হয়তো তার কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত করতে পারলাম এই পারফরম্যান্স এর মাধ্যমে। কিছু মানুষের হয়তো চোখ খুলে যাবে এবং এসব হয়তো কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হবে। এটা যে অপরিনত বয়সের অপরিনত চিন্তা ছিল সেটা প্রমাণ হয়ে গেল এর কয়েক বছর পর যখন নিজে বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম। বিয়ের আগের দিন সব দিদিরা যখন রাত ৩ টে অবধি পরামর্শ দিল "এইসব নিয়ে কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লাগে। তাই চাইলেই তুমি দিয়ে দেবে। এতে শান্তি বজায় থাকে।" আমি বাকরুদ্ধ হয়ে ভাবতে বসলাম, পুরুষ মানুষকে কি দোষ দেব, মেয়েদের চিন্তাধারাটাই যদি এরকম হয়ে থাকে। যতই বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, কন্যাশ্রী প্রভৃতি প্রকল্প করা হোক না কেন মেয়েদের স্থান একই জায়গায় থাকবে। মেয়েরা আজ যতই প্লেন ওড়াক না কেন বাড়ির বউ মানেই হে৺সেল থেকে বিছানা অবধি তার গন্ডি। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তদের ঘরে ঘরে এক গল্প। শুধু প্রকাশ ভঙ্গি আলাদা। এতকিছু দেখা, শোনা, বোঝার পর কি করে বলবো 'মেরা ভারত মহান';। যেখানে একজন নারীর দেহের প্রতি সম্মান নেই, প্রতিনিয়ত তার মননকে রক্তাক্ত করা হয়- সেখানে কি করে হবে 'Amazing India';. প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।