“ত্বনী, শ্যামা, আর সূক্ষ্মদন্তিনী, নিম্ননাভি, ক্ষীণমধ্যা,
জঘন গুরু বলে মন্দ লয়ে চলে, চকিত হরিণীর দৃষ্টি
অধরে রক্তিমা পক্ক বিম্বের, যুগল স্তনভারে ঈষৎ-নতা,
সেথা আছে সে-ই, বিশ্বস্রষ্টার প্রথম যুবতীর প্রতিমা।“

- বুদ্ধদেব বসু

(কালিদাসের মেঘদূতম্-এর বাংলা অনুবাদ)


প্রকৃতি যখন মানব জাতির সৃষ্টি করেছিলেন, নারী এবং পুরুষকে দু’প্রকারের আলাদা আলাদা শারীরিক গঠন দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন। পুরুষকে যেমন শারীরিক দৃঢ়তা দিয়েছিলেন তেমনি নারীকে কোমল ত্বক ও নমনীয় দেহ দিয়েছিলেন। নারীর দেহ সৌষ্ঠব গড়ার সময় প্রকৃতি খুবই যত্নবান ছিলেন। তাই তো নারীর প্রতিটি অঙ্গদেশ আকর্ষণীয়। আর সবথেকে আকর্ষণীয় অঙ্গ হল ‘বক্ষযুগল’। স্বয়ং কালিদাস তা৺র রচিত বিখ্যাত গীতিকাব্য ‘মেঘদূতম্’ এ নারীদেহের বর্ণনা করতে গিয়ে স্তনযুগলের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন, যা যুগে যুগে বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এই বর্ণনা এতটাই বিখ্যাত যে আজকের কবি ও সাহিত্যিকরাও তাদের সৃষ্টিতে সেই প্রসঙ্গ বার বার উল্লেখ করেন। এককথায় বলা যেতে পারে স্তনযুগলের এই অমোঘ আকর্ষণ, চিরন্তন।

কিন্তু যখন এই আকর্ষণীয়, সমাদৃত বক্ষযুগলই হয়ে দাঁড়ায় দুশ্চিন্তার কারণ, তখন?

পৃথুলা স্তন, যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় জাইগ্যানটোমাস্টিয়া বলা হয়, এটি অ্যাবনর্মালি বড় স্তনকে বোঝায়। অনেক নারীর স্তন তাদের দেহের মাপকাঠির উচ্চতা, ওজন সবকিছু অনুযায়ী অত্যধিক বড় হয়। এরূপ হওয়ার সঠিক কারণ আজ অবধি জানা যায়নি। তবে জেনেটিক বা বংশগত কারণকে এর মূল কান্ডারী ধরা হয়। আবার কখনও কখনও টিউমারজনিত কারণেও স্তনের এরূপ আকার হওয়াকে আলোচনার বিষয় হিসেবে ধরা হয়।

বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীদের শরীরে নানারকম পরিবর্তন দেখা দেয়। তার মধ্যে স্তনবৃদ্ধি বা ব্রেস্ট এনলার্জমেন্ট অন্যতম। সাধারনত এটি ঘটে ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে। এইসময় স্তন ম্যামরি গ্ল্যান্ড ও ফ্যাটি টিস্যু তৈরি করে। বুকের সম্মুখভাগে দু’পাশে বিবর্তিত ও বিশেষ দু’জোড়া গ্ল্যান্ড থাকে যা ম্যামরি গ্ল্যান্ড নামে পরিচিত। এই ম্যামরি গ্ল্যান্ড মিল্ক তৈরির গ্রন্থিযুক্ত এবং মিল্ক নিপল্ অবধি এসে পৌঁছানোর নালী দ্বারা গঠিত। স্তন ফ্যাট, ফাইব্রস ও গ্ল্যান্ডুলার টিস্যু নিয়ে গঠিত। ফ্যাটি টিস্যু ব্রেস্টকে আকার ও আকৃতি (সাইজ ও শেপ্) দেয়, ফাইব্রস টিস্যু ব্রেস্ট গঠন ও তার ভার বহন করে, আর গ্ল্যান্ডুলার টিস্যু বুকে দুধ উৎপাদন ও বহন করে।

জাইগ্যানটোমাস্টিয়া অথবা ব্রেস্ট হাইপারট্রফির প্রধান উপসর্গ হল ব্রেস্ট টিস্যুর অতিরিক্ত অতিবৃদ্ধি। কখনো এটি একদিকের ব্রেস্টেও হতে পারে, আবার কখনও দুদিকের ব্রেস্টেও হতে পারে। কখনো কখনো এই অতিবৃদ্ধি প্রতি বছর একটু একটু করে বাড়তে পারে। আবার কোন কোন নারীদেহে কয়েকদিন অথবা এক দুই সপ্তাহের মধ্যেই এই অতিবৃদ্ধি বৃহদাকার নিতে পারে।

জাইগ্যানটোমাস্টিয়াকে কয়েকধরনের সাবটাইপস্ এ ভাঙ্গা যায়। এই সাবটাইপসগুলি পরবর্তীকালে জাইগ্যানটোমাস্টিয়ার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।

১)জেস্টাশনাল অথবা প্রেগনেন্সি থেকে উদ্ভূত: এটি সাধারণত প্রেগনেন্সি হরমোন দ্বারা উদ্ভূত হয় এবং প্রেগনেন্সির প্রথম তিন মাসে দেখা যায়।

২)জুভেনাইল অথবা পিউবারটির সময় উদ্ভূত: এটি সাধারণত সেক্স হরমোনের কারণে ১১ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে দেখা যায়।

৩)মেডিকেশন অথবা ড্রাগ থেকে উদ্ভূত: রিমোটরয়েড আর্থারাইটিস, উইলসনস ডিজিজ ও সিসটিনুরিয়া রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডি-পেনিসিলামাইন নামক একপ্রকারের ড্রাগ ব্যবহৃত হয়। এই ড্রাগ ব্রেস্টের অতিবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এছাড়াও বুসিলামাইন, নিওথেটাজন, সাইক্লোস্পোরাইন – এই ওষুধগুলিও এই রোগকে ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

৪)ইডিওপ্যাথিক জাইগ্যানটোমাস্টিয়া: আজ অবধি এটার কারণ পাওয়া যায়নি। এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হয়।

জাইগ্যানটোমাস্টিয়া হওয়ার কারণ:

১) বয়ঃসন্ধিকালে ইস্ট্রোজেন হরমোনের স্টিমুলেশনের কারণে ব্রেস্ট এনলার্জমেন্ট হয়। কিন্তু যদি এই ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ অতিরিক্তভাবে বেড়ে যায় তাহলে ব্রেস্টের সাইজ অতিবৃদ্ধি পায়।

২) প্রেগনেন্সির বা স্তন্যপান করানোর সময়ও হরমোনাল চেঞ্জস্ দেখা যায়। ফলস্বরূপ বৃহদাকার স্তন।

৩) কিছু অটো ইমিউন ডিজিজ্ এর ক্ষেত্রেও এই রোগ হতে দেখা যায়। যেমন-

সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস

হাশিমোটোস্ থাইরোডিটিস্

ম্যাসথেনিয়া গ্রেভিস

সোরিয়াসিস

উপসর্গ:

১) ঘাড়ে, পিঠে ব্যথা
২) ব্রেস্ট পেইন যা মাস্টালজিয়া নামেও পরিচিত
৩) স্তনের নীচে ইন্ফ্লামেশন বা চুলকানি
৪) স্কিনে ক্ষত তৈরি হয়
৫) ভারী স্তনের জন্য নার্ভের ওপর চাপজনিত কারণে নিপিলস্ অসাড় হয়ে যায়
৬) ইনফেকশন

জাইগ্যানটোমাস্টিয়ার জন্য কি কি সমস্যা দেখা দেয়:

শারীরিক সমস্যার সাথে সাথে মানসিক ও সামাজিক সমস্যা দেখা যায়। টিন এজাররা স্কুল, কলেজ এ হয়রানির শিকার হয়। ফলস্বরূপ:

অ্যাংকজাইটি, ডিপ্রেশন, শারীরিক গঠন নিয়ে সমস্যা, সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে বিরত রাখা

প্রেগনেন্ট নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা একটু বেশি দেখা দেয়।

১) ভ্রূণের কম বৃদ্ধি
২) স্বতঃস্ফূর্ত মিসক্যারেজ
৩) মাসিটিস অথবা ব্রেস্ট ইনফেকশন
৪) প্রেগনেন্সি কমপ্লিকেশন দেখা দিতে পারে
৫) বুকের দুধের যোগানে চাপ পড়ে
৬) ব্রেস্টে ব্লিস্টারস অথবা ফোস্কা দেখা দেয়

জাইগ্যানটোমাস্টিয়া থেকে কি ক্যান্সার হতে পারে?

না। এই রোগ ক্যান্সারাস নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করা হলে শারীরিক বিকলাঙ্গতা দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো এটি নিজে থেকেই সেরে যায়। আবার কখনও কখনও ব্রেস্ট রিডাকশন সার্জারি বা মাসাকটমি করা হয়।

চিকিৎসা:

ব্রেস্ট হাইপারট্রফি ট্রিটমেন্ট নির্ভর করে একেকজনের একেকরকম অবস্থার ওপর। উপসর্গগুলির গভীরতা, জাইগ্যানটোমাস্টিয়ার ধরন এবং ব্রেস্ট গ্রোথ এর দ্রুততার ওপর নির্ভর করে।

প্রেগনেন্সিজনিত এই রোগ হলে সাধারণত বাচ্চা হওয়ার পর নিজে থেকেই নিরাময় হয়ে যায়। কিন্তু ব্রেস্ট রিডাকশন সার্জারি হল সবথেকে ভালো উপায় এই রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার। প্রেগনেন্ট নারীদের ক্ষেত্রে যতদিন না ব্রেস্ট ফিডিং করানো শেষ হচ্ছে এবং বয়ঃসন্ধি যাদের চলছে যতদিন না সেটা শেষ হচ্ছে ততদিন অবধি অপেক্ষা করতে হয়।

ব্রেস্ট রিডাকশন সার্জারি বা রিডাকশন ম্যামোপ্লাস্টি:

এই সার্জারির সময় প্লাস্টিক সার্জন ব্রেস্ট টিস্যুর পরিমাণ কমায়, বাড়তি স্কিনকে বাদ দেয় এবং নিপল এর প্রতিস্থাপন করে।

আরেকধরনের সার্জারি হল মাসাক্টমি। এটি বার বার জাইগ্যানটোমাস্টিয়াকে ঘুরে আসাকে আটকায়। এই সার্জারিতে ব্রেস্ট টিস্যুর পুরোটাই বাদ দিতে হয়। এই সার্জারির পরে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করানো যেতে পারে।

ওষুধ:

সার্জারির আগে বা পরে ডাক্তাররা কিছু ওষুধ দিতে পারেন ব্রেস্ট গ্রোথকে আটকানোর জন্য।

১) ট্যামোক্সিন: এটি সাধারণত ব্রেস্ট ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

২) মেড্রোক্সিপ্রোজেস্টেরন: এটি একটি ইনজেকশন। বার্থ কন্ট্রোল করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

৩) ব্রোমোক্রিপটিন: এটি সাধারণত পারকিনসন্স ডিজিজ এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

৪) ডানাজোল: এটি একটি ড্রাগ। এটি এন্ডোমেট্রিওসিস ও ফাইব্রোসিস্টিক ব্রেস্ট ডিজিজ এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

কত সময় লাগে সার্জারি থেকে সেরে উঠতে:

সার্জারির পরে হালকা ব্যথা, ফোলা ও ঘা কিছুদিন অনুভূত হয়। পেইন ও ইনফেকশন কমানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। বেশিরভাগ মহিলারাই সপ্তাহখানেক মধ্যেই হাঁটা চলা শুরু করতে পারেন। ফোলা ভাব কমে গেলেই ব্রেস্টের শেপ ও সাইজ ঠিক হয়ে যায়।

আর যদি মাসাক্টমি করা হয়, তাহলে সেরে উঠতে প্রায় একমাস মত লাগে। এটি পুরোপুরি নির্ভর করে বয়স, মেডিকেল কন্ডিশন ও অন্যান্য বিষয় এর ওপর।

সবশেষে বলি, নারীদেহ আকর্ষণীয়। তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে ঐ বক্ষযুগল। কিন্তু সেই বক্ষযুগল যখন আপনার জীবনের অশান্তির কারণ হয় দাঁড়ায়, তখন লজ্জা, ভয় না পেয়ে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এবং মুক্তি পেতে যদি কোনরকম সার্জারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, মনে কোন দ্বিধা না রেখে এগিয়ে যান। কারণ, কোনরকম আপলিফ্টিং, স্যাগিং অথবা লার্জ ব্রেস্ট অথবা উইদাউট ব্রেস্ট – কোনোটাই আপনার পরিচয় নয়। দিনের শেষে আপনি আপনার গুণ, ব্যবহারের জন্য সমাদৃত, আপনার স্তনযুগলের জন্য নয়।

.    .    .

Discus