ধূলোয় মোড়া রাস্তাঘাট, সবুজ গাছ গাছালি, মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি, গবাদিপশুর আনাগোনা - খুব সহজ সরল গ্রামের দৃশ্যগুলি দেখতে বড়ই ভালো লাগে। নিরিবিলিভাবে জীবন যাপন করার জন্য শেষ জীবনে আজকের দিনেও অনেকেই বেছে নেন গ্রাম্যজীবনকে। সারল্যে ভরা গ্রাম্যজীবন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যুগ যুগ ধরে অনেক চিত্রপরিচালকরাই তাদের চিন্তাভাবনাকে চিত্রায়িত করতে বেছে নিয়েছেন সিনেমাকে। সত্যজিৎ রায় এর পথের পাঁচালী তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ফুলেশ্বরী, নিমন্ত্রণ, ধন্যি মেয়ে, শ্রীমাণ পৃথ্বীরাজ, বালিকা বধূ, অতিথি, সওদাগর ইত্যাদি ফিল্মেই গ্রামের মানুষের সহজ জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করেই গল্প বোনা হয়েছে। চিত্রপরিচালকরা রূপকথার ছলেও কিন্তু গ্রামের সেই সহজ সরল জীবনযাত্রাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। গুপি গাইন বাঘা বাইন আদ্যন্ত এক রূপকথাই যেখানে গ্রামের দুই সহজ সাদাসিধে ছেলে ভূতের আশীর্বাদ বশবর্তী হয়ে কিভাবে মানুষের মন জয় করে - সত্যজিৎ রায় কিন্তু সেই গল্পই শুনিয়েছেন।
কিন্তু গ্রাম্য জীবন মানেই কি শুধু সরলতা। তা কিন্তু কখনোই না। কাহিনীকাররা বা চিত্রপরিচালকরা কিন্তু প্রায়শই এই সরল জীবনযাপনের পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারময় জীবন থেকেও কাহিনীর রসদ খুঁজে নিয়েছেন। গ্রাম মানেই অশিক্ষা, কুসংস্কার, ডাইনি, ভূত, প্রেতের আড্ডেলখানা। কোনো কোনো চিত্রপরিচালকরা এইসবকে রসদ করে হরর ফিল্ম বানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভূত প্রেত বলে আদতে কিছু নেই। পুরোটাই মিথ্। ভূতের রটনা রটিয়ে গ্রামবাসীকে বোকা বানিয়ে পেছনে অনৈতিক কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে বানানো ফিল্ম 'মকড়ি' তে বিশাল ভরদ্বাজ কিন্তু দেখিয়েছেন সায়েন্সই আসল, ভূত-প্রেত-দত্যি-দানব - পুরোটাই মিথ্যে। আবার ফারহা খানের 'জোকার' ফিল্মে অক্ষয় কুমার এক প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের জীবনে শ্রী ফিরিয়ে আনার জন্য এলিয়েনর গল্প ফেঁদেছিলেন। সেখানেও কিন্তু সহজ সরল গ্রাম্য জীবনকেই ঘুরিয়ে তুলে ধরা হয়েছিল। তাই বলে কি গ্রাম্য সহজ সরল জীবনযাত্রায় কোনো সমস্যা নেই। আছে, অনেক সমস্যা আছে।
কৃষক আত্মহত্যা দেশের অন্যতম সবথেকে একটা বড় অবহেলিত সমস্যা। গেভ্রিচা পউস, ফার্মার সুইসাইড, বাড়ি, কথিতি, কাপন, কিসান, কুন্ডাভিটি ডোঙ্গা, মহর্ষি, মায়া বাজার, রিঙ্গন, শ্রিথরম কল্যাণা, ইয়াগনম্, সামার ২০১৭, শ্রিমান্থুডু ইত্যাদি সিনেমায় ব্যাংক বা মহাজনদের কাছ থেকে টাকা শোধ করতে না পারার দরুন কৃষক আত্মহত্যাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এই সমস্যা এতটাই অবহেলিত যে, হায়দ্রাবাদের পরিচালক অংশূল সিনহা দ্বারা পরিচালিত 'মিট্টি ব্যাক টু দি রুটস' ফুল লেংথ ফিচার ফিল্ম হওয়া সত্ত্বেও কোনো ডিস্ট্রিবিউটার না পাওয়া যাওয়াতে কোথাও স্ক্রিনিং হয়নি। কিন্তু ইউটিউবে সম্প্রসারিত করতে না চাওয়া এই ফিল্ম পরবর্তীকালে ভারতের নানা আরবান সেন্টার ও প্রত্যন্ত গ্রামে সম্প্রসারিত হয় শিক্ষণীয় কর্মশালা হিসেবে।
'অনার কিলিং' - প্রশাসনের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে সমাজের অভ্যন্তরে বেড়ে ওঠা এই নারকীয় হত্যাকান্ড সূর্যের আলোর মতই জ্বলজ্বলে এক সত্যি। অনুষ্কা শর্মা পরিবেশিত এন এইচ টেন ফিল্মে বলা হয়েছিল যে, 'যেখানে গুরগাঁওয়ের সীমানা শেষ হয়ে যায় সেখানে ভারতীয় গণতন্ত্র আর সংবিধান শেষ হয়ে যায়'। খাপ পঞ্চায়েত দ্বারা বিবেচিত 'অনার কিলিং' সমাজে 'সো কলড্' সম্মান বজায় রাখার ব্যবস্থা। একই গ্রামে বসবাসকারী সব ছেলেমেয়েই ভাইবোন সুতরাং তাদের মধ্যে বিয়ে নৈব নৈব চ অথবা উচ্চ বংশের মেয়ে নীচু বংশের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না - এরূপ বিধান দেওয়া খাপ পঞ্চায়েতের মাথাদেরকেই মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অনুষ্কা শর্মা এন এইচ টেন মুভিতে। ফিল্মটি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমরা সভ্য সমাজে বসবাস করলেও সত্যি কি মন মানসিকতার দিক থেকে পেরেছি সভ্য হতে? না পারিনি। আক্রোশ, সইরাত, খাপ, ইশকজাদে, হিরোপন্তি, লাভ হোস্টেল, পুঝু - ফিল্মগুলি দেখতে দেখতে মনে হয় আদৌ কি কোনোদিনই সভ্য হতে পারবো! সেটাও একটা বড় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় আমাদের নুসরত বারুচা অভিনীত 'ছোরি' ফিল্মটি। আদতে এটি একটি ভৌতিক সিনেমা হলেও নারীগর্ভে বেড়ে ওঠা কন্যা সন্তানকে হত্যা করে সমাজের চোখে কন্যা সন্তানের স্থান সুস্পষ্ট করে দেয় এই সিনেমাটি। আচ্ছা আমরা কোনোদিনও কি ভেবেছি এই নির্বিশেষে কন্যা হত্যার ফলে একটা সময় গাঁ এর পর গাঁ উজাড় করেও যখন আর বিবাহযোগ্য মেয়ে পাওয়া যাবে না তখন এই তথাকথিত পুরুষ সমাজের কি হবে? আমি আপনি ভাবিনি। 'মাত্রুভূমি: এ নেশন উইদাউট উইমেন' এর ডিরেক্টর কিন্তু ২০০৬ সালে কল্পনা করে ফেলেছিলেন। ক্রমাগত কন্যাহত্যার ফলে যখন আশপাশের সমস্ত গাঁ খালি হয়ে গেছিলো তখন গ্রামের জমিদার নিজের ছেলেদের কিভাবে বিয়ে দেবে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সেইসময় এক মেয়ের সন্ধান পাওয়া যায় যার বাবা কিনা মেয়ের জন্মের পর থেকেই ছেলে সাজিয়ে রাখতো যাতে কারোর চোখে না পড়ে যায়। কিন্তু হায় রে গরিবী! গরিব বাবার কাছ থেকে মোটা অংকের বিনিময়ে মেয়েকে কিনে নিয়ে এসে নিজের চার ছেলের সাথে বিয়ে দিলেও ফুলশয্যার রাতে যখন নিজে শ্বশুর হয়েও অনেকেদিন নারীশরীর আস্বাদন পাওয়া হয়নি বলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়, বিশ্বাস করুন আমিও ভয়ে শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। একটা নারী শরীর শুধুই ভোগের বস্তু এটা ভাবতেই সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো। আমার হাজব্যান্ড, বন্ধুরা প্রায়ই আমার নামে কমপ্লেন করে যে, আমার নাচ, আঁকার মাধ্যমে ভীষণ নারী নির্যাতন ফুটে ওঠে। কিন্তু কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না যে, এটা ইচ্ছে করে করিনা। কাহিনীকার হিসেবে কেন জানি না নারী নির্যাতনকে তুলে ধরে বার বার নারীদেরকেই মেসেজ দিতে চাই যে, এরকম তোমার সাথেও হতে পারে। তাই অত্যাচার সহ্য না করে নিজের রক্ষা নিজেকেই করতে হবে - এরকম মানসিকতায় নিজেকে প্রস্তুত করো। যেমন - বুলবুল সিনেমায় দেখানো হয়েছিল। অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত বুলবুল নারীশক্তির এক অসামান্য প্রতিচ্ছবি। একটা গ্রামের সাদাসিধে মেয়ে যখন তার ওপর অন্যায় অবিচার এর বদলা নিতে নিজের ভাশুর , স্বামীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তখন মনে হয়, 'আমরাই নারী আমরাই পারি'। মৃত্যুদন্ড, ব্যান্ডিট কুইন, গুলাবি গ্যাং, মাদার ইন্ডিয়া, শক্তি দি পাওয়ার, মিরচ্ মসালা এইসমস্ত ফিল্মেই দেখানো হয়েছে যে, মা লক্ষ্মীও সময়বিশেষে চন্ডী রূপ ধারন করতে পারেন।
এই একবিংশ শতকেও টেকনোলজি এত উন্নত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষরা দূর্ভিক্ষ এর মতো অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। অশনি সংকেত এর মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় দূর্ভিক্ষ এর কষ্ট যেভাবে তুলে ধরেছিলেন তা অবর্ণনীয়। অকালের সন্ধানে, ধরতি কে লাল, বেঙ্গল স্যাডোশ, করভি হাওয়া, কউন কিতনে পানি মে, জল, ইরাদা - ফিল্মগুলি নির্মিত হয়েছিল জলের ঘাটতিকে কেন্দ্র করে।
তাই বলে কি সিনেমায় শুধু গ্রামের দুঃখ কষ্টের কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে? একদমই না। গ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রার পাশাপাশি সোস্যাল মেসেজ দেওয়ার জন্য চিত্রপরিচালকরা গ্রাম্য সমস্যাগুলির সাথে রূপকথা অথবা বাস্তব জগৎ অথবা ইতিহাস এর যে মিশেল ঘটিয়েছেন তা অনন্য সাধারণ সিনেমার উদাহরণ। পহেলি, কান্তারা, ইরান্ডাম উলাগাম, খানেজ, দি জাঙ্গেল বুক, ওরু ভিশেষপেট্টা বিরিয়ানি কিস্সা, দি ভিলেজ, আখিল, আনন্দভদ্রম - রূপকথা, বাস্তব, ইতিহাস এর এক অসাধারণ মেল বন্ধন। 'টুম্বাড' এর নাম আলাদা করে উল্লেখ করতে চাই যেখানে পরাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে দেব দেবী ও তাদের অভিশাপ এবং ভূত প্রেত এর মিশ্রণে নির্মিত এক কল্পকাহিনী যাতে ভারতীয় সোঁদা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। এ এক অনর্বচনীয় অভিজ্ঞতা যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এবং শুধু তাই নয় 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু' এই প্রবাদটি যেভাবে সিনেমার শেষে মেসেজ হিসেবে দেওয়া হয়েছে তাতে অনেক ভারতীয়দের মনে হয়েছিল এই সিনেমাকে অস্কারে পাঠানো উচিত ছিল। এই একই 'মেসেজ' এর ওপর নির্মিত 'পরিণতি' সিনেমাটিও কিন্তু অসাধারণ। ভূমিকা, ভেড়িয়া, চেলুভি কল্পকাহিনীরূপে প্রকৃতি ও তার ভারসাম্য রক্ষার গল্প শোনায়।
হালচাল, ভুলভুলাইয়া, চুপ চুপ কে, বন্দ রেডিও, বিল্লু বারবার, আগাডু, আমাউন মুয়ালুম, আনা আলারালোডালারাল, ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর, চেন্নাই এক্সপ্রেস ইত্যাদি কমেডি আকারেও ফিল্ম তৈরি হয়েছে। একদিকে যেমন রুদালী, কোয়লা, টু স্টেটস (তেলেগু), লাভ স্টোরি, দেবদাস, বিসর্জন - প্রেমের গল্পগুলি অসাধারণ। তেমনি অন্যদিকে করন অর্জুন, শোলে, চায়না গেট, রাবণ, গ্যাং অফ ওসিপুর, মেলা - রিভেঞ্জ স্টোরি হিসেবে অনবদ্য। 'পান সিং তোমার' এর নাম আলাদা করে উল্লেখ করতে চাই যেখানে স্বর্গীয় ইরফান খানের আর্মি থেকে রিটায়ার্ড করার পরে ডাকাতে পরিণত হওয়ার গল্পটি আপনাকে রাগিয়ে দেবে। সোনচিরিয়া, ভিরাপ্পান, থর, শূল, আর্টিকেল ১৫, উত্তরা, ভাগামতি যেমন দেশের নানা আভ্যন্তরীন অনৈতিক কার্যকলাপকে চিহ্নিত করে। কিন্তু আবার তেমনি ভিরাসাত, স্বদেশ, ১৯৯৭, লগান, ইকবাল, মন্থন - দেশের ও দশের হয়ে লড়াই করার গল্প শোনায়।
আসলে যুগ যগ ধরে বহু কাহিনীকাররা গ্রাম্যজীবন নিয়ে এত কাহিনী নির্মিত করে এসেছেন যে লিখে শেষ করা যাবে না। আগামীদিনে গ্রাম্যজীবনকে কেন্দ্র করে আরও অনেক অনেক কাহিনী বোনা হোক এই কামনা রেখে এখানেই লেখা শেষ করছি নাহলে এরপর পাঠকবন্ধুদের ধৈর্য্য চ্যূতি হবে।