Image by Naga raju from Pixabay 

ভারতের সুপ্রাচীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে মনে উদ্বেগ জাগলো সপক্ষে সাম্প্রতিক কিছু অপ্রীতিকর সম্প্রদায়িক ঘটনার উল্লেখ করতে চাইছি, আশ্বস্ত করতে চাই ভারতের সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিকড় ভারতবাসীর সহনশীলতা ও শ্রদ্ধার গভীরে গাঁথা রয়েছে । বহু ঝাঁঝাও সেই পরিলক্ষিত নিটোল গাঁথনিকে টলাতে পারেনি । এই তো সে দিনের কথা ভারতের এক মন্দিরের পুরোহিত রোজা রাখা মুসলিম পড়শীদের জন্য ইফতারের আয়োজন করেছিলেন । কর্ণাটকের এক মন্দিরে আজও রীতি মেনে কোরান পাঠ করে শুরু হয় পূজা অর্চনা । আজও মুম্ববাইয়ের কোনও তরুণী গন্ততব্যে পৌছতে দেরি হবেও যেনেও রাজি থাকেন অপেক্ষা করতে যাতে মুসলিম চালক যথাসময়ে নামাজ পড়তে পারেন ।

এই ভারতেই হনুমান জয়ন্তী বা রামনবমীর শোভাযাত্রায়ে পুষ্প বৃষ্টি করেন

প্রতিবেশী মুসলিমরা , শিবের মাথায় জল ঢালতে যাওয়া হিন্দু ভক্তদের জন্য বাড়িয়ে দেন ঠান্ডা জল, সরবতের গ্লাস । হিন্দু শবদাহে নির্দিধায়ে কাঁধ দেন পড়শী মুসলিম । আজও স্কুলের সরস্বতী পূজোয় দুই সম্প্রদায়েয়ের ছাত্রছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে স্বতষ্ফুর্ত ভাবে । সত্যাপীর ও মানিক দরগায়ে শিন্নি চড়ান হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ । দিল্লী ইউনিভার্সিটিতে পড়া কিছু ছাত্রীরা দিল্লির প্রাচীনতম মসজিদ জামা মসজিদ যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬৫৬ সালে মুঘল সম্রাট শাহজানের দ্বারা , সেখানে তারা জীন্স পরে প্রবেশ করাতেও তাদের অসম্মান বা তাদের সাথে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি তাদের সাথেও সেইরকমই আচরণ করা হয়েছে যেমন আচরণ ওখানে পড়ে আসা বুর্কা বা শাড়ী পড়ে থাকা মহিলা দের সাথে করা হয়েছে ।

অনেক হিন্দু পর্যটক দিল্লী গেলে জমা মসজিদ , দরগাহ বা আজমেড় আরও অন্যান স্থান যেখানে সুফি গাওয়া হয় সেখানে গিয়ে ভিড় জমান । সুন্দরবন এলাকায় জঙ্গলে যাবার আগে বনবিবি , দক্ষিণ রায়ের থানে মাথা ঠেকান । তালিকাটি আবহমান ও অফুরান । ভারতের জিনে সম্পৃক্ত বহুতবাদ ,সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধার নিটোল উপাদান । সর্বোপরি জীবনের মৌলিক সমস্যা , চাওয়া -পাওয়া ,সুখ দুঃখ হাসি -কান্নার সাযুজ্য সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষকে রেখেছে ‘আরও বেঁধে বেঁধে , তাদের স্বরকে করেছে একমুখী , সুরে সুর মিলিয়েছে ।

তবে এটির আরও একটি অন্য দিক রয়েছে সেটা অস্বীকার করলে চলে না । ভারত জুড়ে যে সব সংঘাত ও নিপীড়ন চলছে , তার কারণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক । গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চল মিলিয়ে ৫০ কোটি মানুষের জন্য বুনিয়াদী অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারা আরো ৩০ কোটি মানুষকে এমন চরম দরিদ্র ও অধিকারহীনতায় রেখে দেওয়া যে ,অনন্ত শ্রম এমনকি শিশুশ্রম দিয়েও দু বেলা পেট ভরানো সম্ভব হয় না- এটা শুধু কোনো একক সরকারে ব্যর্থতা নয় ,এটা বিগত কয়েক দশকধরে একের পর এক সরকারের ব্যর্থতা-সেই সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার দায়িত্ব যারা অর্থনৈতিক কাঠামো বদলের শর্ত দিয়ে এসেছে বেসরকারি মালিকানা বাড়ানো তাগিদ দিয়ে এসেছে অপরদিকে মেক ইন ইন্ডিয়া -র মতো বিভিন্ন অভিযান (আসহিষ্ণু অচরণকে) জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমের নামান্তর হিসেবে এক ধরনের বৈধতা দিয়েছে।এই সরকার সর্বগ্রাসী ভাবনার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলছে- উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা রজনীশ সিংহের মনে হয়েছে তাজমহলের বাইশ টি বন্ধ ঘরেই লুকোনো আছে তার ‘আসল ইতিহাস’। তা কেমন? তার মতে ওই ঘরগুলো খুললেই নাকি বেরিয়ে আসবে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ,আর তাতেই বোঝা যাবে ‘তেজো মহালয়’(তাজ মহল নয় ) আদতে ছিল শিব মন্দির। এলাহাবাদ হাই কোর্টে আপাতত এই দাবী খারিজ হয়ে গেলেও তাকে স্রেফ হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না , তাতে এক ভয়ংকর বিপদের ইঙ্গিত কে অগ্রাহ্য করা হয় । ইতিহাস বলবে ১৯৮৯ সালে থেকেই ধারাবাহিক ভাবে এই মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গিয়েছে নানা হিন্দুত্ববাদি সংগঠন । এখন সেই বক্তব্য আরও জোরদার হচ্ছে ,এবং তার সঙ্গে শোনা যাচ্ছে কুতুব মিনারকে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ করার দাবি কখনও দেখা যাচ্ছে কাশ্মীরের পুরতাত্বিক সৌধ মার্তন্ড সূর্য মন্দিরে ঢুকে পড়ে পূজঅর্চনার দৃশ্য। অযোধ্যা সূচনা মাত্র ,কাশি -মথুরা বাকি আছে -এই স্লোগানে যথার্থ এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে । বোঝা যায় যে সব শক্তি এত দিন সমাজে প্রান্তিক হিসাবে পরিগনিত হতো ,তারা ক্রমশ এক সুত্রে গ্রন্থিত হচ্ছে আশঙ্কা এখানেই । এর পিছনে সুপশট রাজনীতি আছে -সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতি । তা বলে সমস্ত ইতিহাসের উপর নিজের একশৈলিক দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দেশের বহুত্বপূর্ণ অতীত কে মুছে দেওয়ার উদ্যোগ টি করা সহজতর হয় আর শাসক দলের আশীর্বাদ যদি মাথার উপর থাকে ,তা হলে এই আখ্যানকে জোটবদ্ধ ও জোরদার করার কাজটিও তুলনায় বাধাহীন ভাবে হতে পারে । এখানে রাষ্টের ভূমিকায় উদ্যেগ প্রকাশ করতেই হয় এই সরকার গুরুতপূর্ণ অভিজ্ঞান হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপগুলিকে রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে পরিণত করতে চায় । ঐতিহাসিক সৌধ নিয়ে টানা টানি চলে ,অথবা কেউ সেখানে সরাসরি তাতে ঢুকে পড়ে অধিকার কায়েম করতে চান । ভাষা ,সংস্কৃতি খাদ্য ,পোশাক থেকে ধর্ম -সবতেই সেই ‘একীকরণ’ ছাপ ‘ভারত’ এর কল্পনাটি এই রকম ছিল না -সেই বহুতত্ববাদী ভারতকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন নিতেই হবে ।ভারতের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এইরকম অসহনশীলতা আগেও ছিল ,এখনো আছে । অযোধ্যার রামজন্মভূমির ওপরে বাবরি মসজিদ নির্মাণ হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে তার ধংস কিংবা দেশভাগের সময় সম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, শিখ ধর্মের অপমানের বদলা নিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা ,১৯৯৩ সালে মুম্বাই দাঙ্গা , ,২০০১ সালে গুজরাটে গোধরা গণহত্যা অতি সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে গোমাংস নিয়ে গণপিটুনিতে মৃত্যু ,যুক্তিবাদী লেখক কালবুর্গির খুন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে, যে দলই সরকারে থাকুক না কেন, তবে হ্যাঁ ! দেশে বিদেশে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা পরিচয়কে সেইজন্য কাঠগোড়ায় দাড়াতে হয়েছে । ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে দাবা খেলা বন্ধ করতে হবে । এই সব কিছুর মাঝে আমাদের মনে রাখতে হবে সহিষ্ণুতাই আমাদের শক্তি । বাঁচো এবং বাঁচতে দাও,'সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ'এই ভাবনার সমৃদ্ধ হিন্দু চিন্তায় সম্পৃক্ত ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছর ধরে অজেয় শক্তি ও সমৃদ্ধ জীবন যাপন করার সত্ত্বেও শুধু নিজের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক জীবনাদর্শের তত্ত্বকেই সারাবিশ্বে ছড়িয়েছে। সুদূর অতীত ও মধ্যযুগে ভারত থেকে যাওয়া সন্তগন ও বিদ্বানরা যে জ্ঞানের আলো প্রচার করেছেন তার প্রমাণ জাপান, চীন ,মঙ্গোলিয়া সাইবেরিয়া , মালয়, সুমাত্রা, জাভা ইত্যাদি দেশে আজও পাওয়া যায়। তথ্যগতভাবে হিন্দু জীবনদর্শনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অর্থ ,সামাজিক, রাজনৈতিক মতাদর্শের স্বৈরাচার শোষণ, নিপীড়ন ও চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদর এসবের কোন স্থান নেই। আবার ব্যবহারিক দিক থেকেও হিন্দু সমাজ মজ্জাগত ভাবে উদার ও সহিষ্ণু। এখানে হিন্দু বলতে কোন সম্প্রদায় কে নয় ভারতের জনসাধারণকে বোঝানো হয়েছে। হিন্দু জীবন দর্শন মানুষকে তার ভাব জগতে একাকী বিচরণ করতে দেওয়ার পক্ষপাতী । হস্তক্ষেপ না করার এই প্রবণতা হিন্দুকে যে কোনও ধরণের স্বৈরাচারী বা একনায়ক হতে নিরুৎসাহ করে। সেই দিক থকে একজন সাধারন হিন্দু গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত বা আস্থাশীল। সব দিক বিচার করলে হিন্দুত্ব হচ্ছে সর্ব সমাবেশক, বহুত্ববাদী একটি ভাবনা যা প্রকৃতপক্ষে দেশ কাল ভেদে সকলের জন্য সমান উপযোগী। তাই তা শাশ্বত ও সনাতন। বিদেশীরাই আমাদের হিন্দু বলে সম্মোধন করেছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৬০ বছর ধরে মেকলে পন্থী মডারেটদের সেকুলার শাসন আসলে ঔপনিবেশিক ব্রিটশ শাসনেরই প্রলম্বিত রূপ মাত্র বাস্তবে সেকুলারিজম নিজেই একটা সম্প্রদায় পরিণত হয়েছে । দার্শনিক leibniz এই মারাত্মক ধর্মহীন নব্য সম্প্রদায় সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন- a secular religion ....would almost by definition have to be tyranny and suppress the freedom of the individual . এ ধর্মহীন সেকুলার সম্প্রদায় স্বাধীনতার ভারতের এতদিন ধরে নিজেদের মতকেই একমাত্র সত্য মনে করে । হিন্দু চিন্তন ও জীবন দর্শন, যা প্রকৃতপক্ষে ভারতের আত্মা তাকে অবহেলা ও চূড়ান্তভাবে সমূলে উৎপাটিত করতে চেয়েছে। গণতন্ত্র ,সহিষ্ণুতা ও হিন্দু চিন্তা সমার্থক হওয়া গণতন্ত্রের সামান্যতম বিপদ না থাকলেও মডারেট সেকুলার কমিনিউস্টরা এতদিনের সত্বা হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত ও বিপন্ন। তাই এত অসহিষ্ণুতার হাল্লা বোল। এখন যারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দেশ-বিদেশে ভারতের এবং হিন্দুত্বের এই নব উত্থানের নিন্দা করছেন তারা বরং অগণতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতা সংঘর্ষ ও সাম্রাজ্যবাদী ভাবনা দূর করার চেষ্টা করুক । তাহলে তাদের মঙ্গল গণতন্ত্রের মঙ্গল । ও সর্বোপরি দেশের মঙ্গল । আমরা সহমত হতে পারি নাও হতে পারি । কিন্তু চিন্তার বিবিধতাকে বাধা দিতে পরি না । সহিষ্ণুতা ,বহুতবাদ ,বহুভাষা -এগুলকেই আমাদের দেশের অন্তরাত্মা মন্তব্য করেছিলেন -প্রণব মুখার্জী আমরা -ওরা ‘র বেড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে আসুক আমাদের সকলের ভারত । ভারতীয় সমাজ সভ্যতার স্বরূপ উন্মোচনার প্রয়ােস ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন বৈচিতের মধ্যে ঐক্য (unity in diversity )ভারতীয় স্বদেশিকতার কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে এই বক্তব্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে । আমার মতে ভারত সভ্যতা ঐতিহ্যগতভাবে সহনশীল । বিভিন্ন এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী জাতিগোষ্ঠীরাও এই পুন্যভূমিতে শান্তিতে সহবস্থান করছে । যেখানে কোনো সামাজিক গোষ্ঠী নিজেদের বঞ্চিত মনে করবে না আত্মাপরিচয়ের সমস্যায় ভুগবে না । ঐক্য এবং বৈচিত্র্যের পারস্পরিক ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠতে পারে এক শক্তিশালী অখণ্ড ভারত । কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার গানের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা সত্যিই যথার্থ-

হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে
জাগো রে ধীরে -
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে ।

.   .   .

Discus