Photo by Ricardo Moura on Unsplash

সব সময় ওসব কথা ভাবিস না তন্বী । একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর মা । আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি । একটু চোখটা বুজে শুয়ে থাক ! দেখ ঘুম আসবে।

সুজাতা তন্বীকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল । কিন্তু তন্বী চোখ বুজতেই পারছিল না। কিন্তু চুপ করে মরা কাঠের মত পড়েছিল সে। কদিন ধরে মায়ের কি কষ্ট যে হচ্ছে সে বুঝতে পারছে ! একে বাবা এইভাবে চলে গেছে তার শোক তার উপুড় তার নিজের এই অবস্থা ! তন্বী নিজেকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে । সুস্থ স্বাভাবিক মনে সে মনে করার চেষ্টা করছে সত্যিই তার মনের ভুল । কিন্তু সে চিন্তা মাথায় থাকছে না বেশিক্ষণ । এখন এই মুহুর্তে ও সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে মাথার থেকে এই আতংকের ভূত তাকে তাড়াবে । কিন্তু মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে সুজাতার হাত যেই একটু শিথিল হয়েছে , ওমনি তন্বী ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়ল বিছানায় ।এগারো দিন ধরে সে দিনরাত ঘুমাতে পারছে না । দুটো করে ঘুমের ওষুধ খেয়েছে । তবু চোখে ঘুম নেই । অথচ প্রচন্ড ক্লান্তি , অবসাদ তাকে উইপোকার ঢিবির মতো গিলতে গিলতে ক্রমশঃ ঢেকে ফেলছে । ভয়ে আতংকে সে চোখ বুজতেই পারছে না । বিভৎস সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা চোখের পাতায় আটকে আছে যেন । বাবার সেই ঝুলন্ত শরীর ! ফ্যানে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ল বাবা ! বিশ্বাস হয় না এখনো । অত বিচক্ষণ মানুষটা এই ভাবে চলে গেল ! একসঙ্গে তিনটে প্রাণি থাকে তারা , একই বাড়িতে এত কাছাকাছি । তবু বুঝতেই পারল না তারা ! করোনার পর থেকেই কথায় কথায় প্রায়ই বলত কোবিদ হলে যেন খবরদার নার্সিং হোমে নিয়ে যাস না মা । সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে । বাড়িতে ট্রিটমেন্ট করাই ভালো। হাসপাতালেও ভর্তি করিস না খবরদার !

কেন বাবা ! এত লোক তো সুস্থ হচ্ছে হাসপাতালে !

সে নেহাৎ যাদের পরমায়ু আছে ! হাসপাতালে যাওয়া মানে মৃত্যু নিশ্চিত । আত্মীয় পরিজন হীন নিতান্ত অনাথ আতুরের মতো মরার চেয়ে নিজের বাড়িতেই মরা ভালো । সেদিন সন্ধ্যে বেলায় এর পর ,হঠাৎ করেই কেমন গুম হয়ে গিয়েছিল বাবা !

বাবার জ্বর আসার পর তাদের ওই ঘরে ঢোকাই বন্ধ করে দিয়েছিল বাবা । সব সময় খিল দিয়ে থাকত । খাবার দাবার ওষুধ পত্র সব বাইরে দরজার কাছে রাখতে হচ্ছিল । ছয় দিন পর বাবার শরীর একদম খারাপ হয়ে গেল যখন, তন্বী জোর করে বাবার অমতেই নার্সিংহোমে ভর্তি করার ব্যবস্থা করছিল । কিন্তু তার আর দরকার হল না । বাবা সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়ল !তন্বীর চোখের পর্দায় সব সময় ঝুলছে সেই দৃশ্য ! একটা মুহূর্তও সে অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে না ! পাশের ঘরটা একেবারে তালাবন্ধ করে রাখা আছে । চব্বিশ ঘন্টা তার চোখের সামনে সেই ঝুলন্ত শরীর । যখন বডি নামিয়ে নিয়ে যায় তখন সে অজ্ঞান অবস্থায় ছিল । তারপর থেকে আর ঘুম নেই চোখে । ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম নেই চোখে! চোখ একদম বন্ধ করতে পারছে না তন্বী ! চোখ বুজলেই সেই ঝুলন্ত শরীরটা এসে দুলছে চোখের পাতায় ! ভয়ে আঁতকে উঠছে সে ! বিভৎস চিৎকার করে কেঁদে উঠছে ! থর থর করে কাঁপছে শরীরটা । প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়ছে ।

সুজাতার তন্দ্রা ভেঙে যেতেই উঠে বসে তন্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল ! তন্বীকে আবার এরকম আতংকে গুম হয়ে যেতে দেখে এবার জোর করে তাকে বুকে আঁকড়ে নিল । এই কদিনেই তন্বীর শরীরটা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে । চোখের কোলে কালি! গলার কন্ঠা বেরিয়ে গেছে । সুজাতার খুব কষ্ট হচ্ছিল । ভয়ে শোকে যন্ত্রণায় হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার । কিন্তু সে জানে সে যদি কান্নায় ভেঙে পড়ে , তাহলে আর কিছুই থাকবে না । সমস্ত শেষ হয়ে যাবে । কাজেই শক্ত তাকে হতেই হবে ! কি করে তন্বীকে আবার সুস্থ করে তুলবে এই চিন্তায় সে নিজেও কেমন অসহায় হয়ে যাচ্ছে । কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না ! বুকের ভেতরটা তার ভয়ে আতংকে গুর গুর করছে । সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে তন্বী মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে ! সব সময় অসম্ভব একটা ভয় ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে । ওর মুখ চোখ একবারে অন্যরকম লাগছে ! কত হাসিখুশি ছিল মেয়েটা। কি করে যে ওকে স্বাভাবিক করে তুলবে ! কদিন ধরে সারারাত দু চোখের পাতা এক করছে না মেয়েটা ! সারাটা রাত বালিশে মাথাই ঠেকায় নি এই কদিন। বিছানায় উঠে বসে থাকছে গুম হয়ে। চোখে মুখে আতংকের ছায়া । আলো জ্বেলে রাখছে সারারাত। লোড শেডিং এর ভয়ে ইমারজেন্সি রেখে দিচ্ছে মাথার গোড়ায় ! আতংকে শিউরে উঠছে মাঝে মাঝে। চিন্তায় ভাবনায় সুজাতারও চোখের ঘুম চলে গেছে। কদিনে মেয়েটার যা হাল হয়েছে ! বাঁচবে তো ! ঠাকুর তুমি রক্ষা করো ! তন্বীকে ছাড়া আমি বাঁচব না । হুহু করে চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে সুজাতার ! থরথর করে কাটা ছাগলের মত কাঁপছে তার শরীরটা । গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ! একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়ে নিতে বলছে অনেকেই। কিন্তু এখনও খোঁজ পায় নি সুজাতা । এত অসহায় লাগছে । বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার ।মনে হচ্ছে দম আটকে মরে যাবে এখুনি । মানুষটা তো ফাঁকি দিয়ে চলে গেল ! এখন মেয়েটার মুখের দিকে চেয়েই তো বেঁচে থাকা ! নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে হাত থেমে যাচ্ছিল সুজাতার ! সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে আবার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল ।একসময় তন্বীর চোখের পাতা স্থির হচ্ছিল দেখে একটু ভালো লাগল সুজাতার । আস্তে আস্তে বালিশে শুইয়ে দিয়ে তন্বীর মাথায় ,সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আর নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছিল । দুচিন্তায় সেও ঘুমায় নি কতদিন । কিছুতেই বুঝতে পারছে না মানুষটা এমন ভুল কেন করল ! করোনা তো কত লোকেরই হচ্ছে । অনেকেই তো ভালোও হয়ে যাচ্ছে ! তাদের মা মেয়েকে এই ভাবে জলে ফেলে রেখে চলে গেল !

সেই ভয়ংকর দৃশ্য তারই চোখের পাতা থেকে একটা মুহূর্তও সরছে না । সব সময় দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছে । তারপর থেকে খিদে তেষ্টা ঘুম নিদ্রা কিছু নেই শরীরে । অদ্ভূত এক হাড়হিম করা সময় ।প্রতিটা মুহূর্ত যেন করাতের মতো কাটতে কাটতে বেরিয়ে যাচ্ছে । রক্তাক্ত শরীর মন নিয়ে ধুঁকছে তারা ! সতেরো বছরের দাম্পত্য জীবন ! কত মধুর স্মৃতি কত বিচিত্র মুহূর্ত যে জমা হয়ে আছে মনের মধ্যে ! সে সব হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তকে ডুবুরির মত বুকের গহন হ্রদ থেকে তুলে এনে একবার যে নাড়াচাড়া করবে , তাও পারছে না সুজাতা । ভীষণ অসহায় লাগছিল তার ।লকডাউনের সময় , করোনার দাপাদাপিতে কেউ কারুর বাড়িতে যাতায়াত করতে পারছে না। কারুর সঙ্গে যে একটু আলোচনা করবে , পরামর্শ নেবে তাও তো পারছে না । কতদিন পর কাটবে এই দুঃসময় তাও অনিশ্চিত ! ততদিনে কি যে হবে ! এই দুশ্চিন্তার মধ্যে থেকেও,একটু ঘুমিয়ে গেল সুজাতা । সারা পাড়া তখন নিশুতি । কেউ জেগে নেই । বাবুর বাগানের দিকটায় বরাবরই গাছপালা প্রচুর । রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া নেই !দোকান বাজার বন্ধ । মানুষ জন নেই । থাকার মধ্যে আছে কটা পথের কুকুর । এই রকম থম থমে পরিবেশে তারাও কেমন নির্বাক হয়ে গেছে !রাত্রি বেশ গভীর ! তন্বী ও একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল । হঠাৎ সে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল ,এই দৃশ্য ভুল নয়। সত্যি সত্যিই চোখের পাতা মুড়লেই যেন প্রবল ভয়ংকর একটা হিজিবিজি স্রোত তার দিকে ধেয়ে আসছে । চোখ বুঝতে প্রচন্ড ভয় করছে তার । একটা ভুতুড়ে অবয়ব ছমছম করে নুপুর পায়ে এসে , মাথার চার পাশে ঘুরছে ! হুমড়ি খেয়ে বসছে দুচোখের পাতায় ! ভয়ে সারা শরীর চিন চিন করছে তার । দপ দপ করছে বুকের ভেতরটা । সারা ঘরে তখন বিপুল অন্ধকার । চারিদিকে ঝুলছে অসংখ্য বডি । সিলিং ফ্যান স্থির ! কিন্তু সমস্ত বডি দুলছে । তন্বী সেই ঝুলন্ত মৃত দেহের স্তূপ দেখে চিৎকার করে উঠল যেই ! ঘুম ভেঙে যেতেই বিছনা থেকে নেবে ঘরের দরজা খুলে ছুটতে শুরু করল । উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে তন্বী । তার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ঝুলন্ত বডিও ছুটছে । চলন্ত গাড়ির সামনে যে ছোটো ছোটো পুতুল ঝোলানো থাকে । গাড়ি চলে আর সেই সুন্দর পুতুলগুলোও দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে । ঠিক তেমনি করেই চলমান ঝুলন্ত দেহ ! তার সামনে পিছনে সর্বত্র তাকে ঘিরে তারাও ছুটছে । অপরিসীম আতংকে সমস্ত শরীর তার বেঁকে দুমড়ে যাচ্ছিল ! তবু সে থামতে পারছে না । কিন্তু একসময় সমস্ত পথ অবরোধ করে দাঁড়াল দপসেই দেহরা । তার সামনে পিছনে কোনো দিকে আর ছুটতে পারছে না আর । চারিদিকে অসংখ্য ঝুলন্ত দেহের ব্যারিকেড ! তন্বী চোখ বুজে ভয়ংকর চিৎকার করে মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায় । নির্জন রাত্রির অপরিসীম নৈশব্দের মধ্যে পড়ে গোঙাচ্ছিল তন্বী ! আস্তে আস্তে গভীর অচেতন একটা স্তরে পাড়ি দিচ্ছিল সে ! হঠাৎ সে শুনতে পেল সেই গাড়ির মধ্যে ঝুলতে থাকা পুতুল যেন আস্তে আস্তে কাচের ভেতর থেকে তাকে ডাকছে । হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকে। তন্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল , গাড়ির মধ্যে থাকা ডল পুতুল তার বাবা । ফিস ফিস করে বলছে ওঠ তনু ! ভয় পাস না । আয় আমার হাতটা ধর -

.    .    .

Discus