Image by StockSnap from Pixabay 

এক চিলতে রোদটুকু কখন নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে বুঝতে পারেননি হিমানীশ। বাইরে এখন কচি-কাঁচাদের রাজত্ব – ছোটাছুটি, হাসাহাসি , মান-অভিমান , কত কি। বড্ড ঘুমকাতুরে হয়ে গেছেন হিমানীশ গত কয়েক বছরে। বয়সের দোষ বলে পার পাবার উপায় নেই, অন্তত রণিতের কাছে তো নয়ই।

“আমি তোমাকে বলছি না অন্য কিছু করো। শুধু একটু বেরোও ঘর থেকে, লাইট ওয়াক আর কি। শরীর ভাল থাকবে, মনটাও ফ্রেশ হয়ে যাবে।“

ছেলের ঘন ঘন দেওয়া এ প্রেসক্রিপশনটায় আমল দেওয়া হয়ে ওঠেনি আজ অব্দি। চেষ্টা করেননি হিমানীশ, এমন নয়। এই তো আজও দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন, ঘুম মোটেই নয়। বিকেলে একবার বেরোতেই হবে। দুপুরের খাওয়াটা সেরে বিছানায় গা লাগানোর পর একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল ঠিকই কিন্তু গায়ে কিছু জড়াননি পাছে ঘুম এসে যায়। সাড়ে তিনটে তো বেজেই গেছে, মিনিট কুড়ি বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়া যাবে সান্ধ্যভ্রমণে।

এই সময়টাতেই অবনী, মনীশরা বেড়াতে বের হয় বলে জানিয়েছিল রণিত, কোনও রবিবারে দেখেছে হয়ত। হিমানীশেরও জানা ছিল । অবনী বার কয়েক বাড়ি এসে যেচে প্রস্তাব দিয়েছিল ওদের সঙ্গে বেরোবার জন্য। সাড়া পায়নি, এখন আর এ পথ মাড়ায়না। এক চিলতে রোদ জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকবো-ঢুকছি করছিল। একসময় ঢুকলো, জানলাটা পেরিয়ে সোজা হিমানীশের বুকে মুখটা গুঁজে দিল। বেশ আরামই লাগছিল। আজ কিন্তু নিজেকে দোষী মানতে নারাজ হিমানীশ। ওমন করে মিষ্টি রোদটা উষ্ণ ছোঁয়ায় আচ্ছন্ন না করলে ঘুম আসতো না, অবশ্যই বেরনো যেতো।

এখন রোদটা নেই, শুধু লালমতন কিছু আভা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গোটা পরিবেশ জুড়ে। একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বালিশের পাশের নির্দিষ্ট স্থান থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নেন হিমানীশ, সঙ্গে লাইটারও। বাইরে লাল আভার সামনে ভেতরে কুণ্ডলী পাকানো সিগারেটের ধোঁয়া হিমানীশকে প্রেমপর্বে, পরে অফিসপর্বে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে, অবশেষে জানালা দিয়ে বিদায় নেয় ঢেউ হয়ে। ঘরে ফেরা পাখিদের ডাক কমতে শুরু করেছে একটু একটু করে। একটা-দুটো তবু চেঁচাচ্ছে, তাদের প্রিয়জন ঘরে ফেরেনি হয়তো এখনো, যেমন রণিতও ফেরে না নির্দিষ্ট সময়ে। বলে কয়েও কাজ হয়নি, এখন আর কিছুই বলেন না হিমানীশ। পাখিগুলোর মতো চেঁচাতেও পারেন না, শুধু কিছু দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খায় মনের চারপাশে।

একটু আগে কফি দিয়ে গেছে অনিতা। একদিনের বাসি কাগজগুলো বরাদ্দ স্থানে রেখে আজকেরটা দিয়ে গেছে। কদিন থেকে কাগজওয়ালা বিকেলে দিচ্ছে কাগজ, প্লেনের সময় বদলেছে হয়ত। সত্যি, নিজের মেয়ের কাছ থেকেও বোধহয় অতটা আন্তরিকতা পেতেন না হিমানীশ যেটা অনিতা দিচ্ছে।

অনিতাকে একমাত্র ছেলের বউ করে আনাটা খোদ রণিতের কাছে ভুল সিদ্ধান্ত মনে হলেও হিমানীশ তা মনে করেন না। অনিতা শুধু উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, অতি সাধারণ ঘরের সাধারণ মেয়ে, এসব অস্বীকার করার প্রশ্ন আসছে না, কথা হচ্ছে আন্তরিকতা এবং পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা যেটা অনিতার কাছে অফুরাণ। গোটা পরিবারটাকে এই ক’মাসে মেয়েটা যে ভাবে আপন করে নিয়েছে সেটা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবিদার।

ইদানীং রণিতের মতামতটাও বদলাতে শুরু করেছে একটু একটু করে, অন্তত হিমানীশের তাই ধারণা। আগের চেয়ে একটু বাড়তি মনযোগ দিতে শুরু করেছে অনিতার প্রতি। চেহারায় আহামরি সুন্দরী না হলেও একটা ব্যতিক্রমী লালিত্য আছে অনিতার মধ্যে। বলতে গেলে বছর দশেক আগে থেকেই হিমানীশ লক্ষ্য করে আসছেন তার আর রণিতের মাঝখানে ব্যবধানটা বাড়তে শুরু করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মানসিক ব্যবধান কমেনি, খুব চরমেও পৌছয়নি।

জয়িতা ঠিক উল্টো কথা বলে। রণিত নাকি বাবাকে প্রচণ্ড ভালবাসে কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করে না। আর তাতেই নাকি হিমানীশ ছেলে সম্পর্কে কিসব উল্টোপাল্টা ভেবে বসেন। জয়িতার এই পুত্রপ্রীতি নতুন নয়। রণিতও মা বলতে অজ্ঞান। অবশ্য মা-ছেলের এই নিখাদ ভালবাসা দেখে একটা অন্যধরণের আনন্দও হয় হিমানীশের মাঝেমধ্যে।

ইদানীং শারীরিক দিক দিয়ে বেশ দুর্বল হয়ে গেছেন হিমানীশ। নিয়মিত শরীরচর্চা করেছেন একসময়, বাইরেটা তাই সুঠাম রয়েছে এখনো। তবু কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠেন অল্পেতেই। গত পরশুর কথা। অনিতা সবে স্নানে গেছে, রণিতও চলে গেছে অফিসে। এমন সময় জল এলো । প্লাস্টিকের ট্যাঙ্কটা ভরে যাবার পর বালতি করে রান্নাঘরের জন্য জল আনছিলেন হিমানীশ। চার বালতি এনেছেন কোনওমতে, পঞ্চমটা আনতে গিয়েই টের পেলেন শরীরটা কেমন যেন করছে। ততক্ষণে স্নান শেষ অনিতার। হিমানীশকে জল বইতে দেখে হা হা করে তেড়ে আসে। কাজটা শেষ করে অনিতাই। এরপর বেশ কিছুসময় বুকটা ধড়ফড় করেছে হিমানীশের। একটা পুরুষের জীবনের সবচেয়ে অসহায় পর্যায় বোধহয় এই বার্ধক্যটাই।

জয়িতা মেয়ের ওখানে গেছে আজ দু’সপ্তাহ হতে চলল। গত পরশু ফোনে জানিয়ে দিয়েছে আরও দিন কয়েক থাকবে। মেয়ে আর জামাইয়ের আন্তরিকতায় সে গদগদ, তাই এই সিদ্ধান্ত। মেয়েরা বরাবরই এরকম। আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েই ওদের জীবনটা গেল। একবারও ভাবল না হিমানীশ একা, পারিপার্শ্বিকের দিক দিয়ে না হলেও মনের দিক দিয়ে। জয়িতা ভাল করেই জানে ওর জন্য তুলে রাখা নিখাদ ভালবাসাটুকু কোনও ভাবেই অন্য কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারেন না হিমানীশ। তবু কি যে করে এসব। গত দু’সপ্তাহে বারকয়েক দেখা হয়েছে দুজনের স্বপ্নে, প্রেমপর্বের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে রেস্তোরা, পার্ক, মেলায়। দিন তিনেক থেকে স্বপ্নের পুনরাবৃত্তিও ঘটছে নিয়মিত। আজ বিকেলে ওই এক চিলতে রোদটুকু যখন জাপটে ধরেছিল হিমানীশকে, জয়িতার অনুপস্থিতিটা তখন বড্ড লাগছিল মনে। এরকম উষ্ণতা জয়িতাও দিতে পারতো। অবশ্য এখন আর সেটা যখন তখন আশা করা যায় না। প্রেমিক হৃদয়টা কখনো সখনো উতলা হয়ে বেয়াদপি করতে চাইলেও জয়িতা সব কিছুতে জল ঢেলে দেয় ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি’ বলে। তবু পৌরুষ খাটিয়ে মাঝে মাঝে সেটা আদায় করে ছাড়েন হিমানীশ।

আসলে জয়িতাকে বাদ দিয়ে নিজেকে কল্পনাও করতে কষ্ট হয় হিমানীশের। হৃদপিন্ডটার পর জয়িতাই হিমানীশের জীবনের এমন একটা অংশ যাকে বাদ দিয়ে মরণ-বাঁচন এক, অন্তত আঠাশ বছর একসঙ্গে ঘর করে এটাই উপলব্ধি হিমানীশের।

প্রেম কাকে বলে জানা ছিল না হিমানীশের, উত্‍সাহও ছিল না খুব একটা। ‘গ্রন্থকীট’ বলে একটা লেবেল কপালে সেঁটে গেছিল সেই স্কুলজীবন থেকেই। কলেজে এসে দ্বিতীয় দিনেই সব হিসেব কেমন যেন উল্টোপাল্টা হয়ে গেছিল হিমানীশের জয়িতাকে দেখে। প্রথম দেখাতেই একটা টান অনুভব করেছিলেন হিমানীশ সাজগোজের চমক ছাড়া অতি সাধারণ গোছের জয়িতাকে দেখে। হ্যাঁ, বিশেষ আকর্ষণ বলতে ওর কোমর অব্দি লম্বা চুল আর অসম্ভব সুন্দর চাউনি।

জয়িতাকে দেখলে হিমানীশের হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যেত কেন? ক্লাশে সাহিত্যের অধ্যাপক জয়িতার বিশ্লেষণশক্তির প্রশংসা করলে গর্বে ফুলে উঠতো কেন হিমানীশের বুক? এরকমই আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর ছিল একটাই, প্রেম, যেটা আবিষ্কার করতে বেশ ক’মাস সময় লেগেছিল হিমানীশের। প্রথমে চোরা চাউনি, তারপর যেচে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক কথা বলার চেষ্টা, অবশেষে কলেজের একমাত্র বন্ধু কৃষ্নাংশুকে দিয়ে জয়িতার কাছে প্রেম নিবেদন, তিনদিন শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষার পর জয়িতার সদর্থক উত্তর, অতঃপর প্রেমপর্বের সূচনা। পরীক্ষা পাশ করার ছ’মাসের মাথাতেই ডাক বিভাগে চাকরি পেয়ে যান হিমানীশ মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে। এরপর দুই পরিবারের মত অনুযায়ীই জয়িতার সঙ্গে বিয়ের বাঁধনে দুই আত্মার মিলনের সূচনা গার্হস্থ্য জীবনের প্রবেশদ্বারে । ব্যস, কেমন করে যেন সব হয়ে গেল। হিমানীশ - জয়িতা দুই ছেলেমেয়ের বাবা-মা হলেন। গত তিন বছর আগে বিয়ের রজতজয়ন্তীটা পালিত হয়েছিল হিমানীশ-জয়িতার। উদ্যোক্তা মেয়ে ঊদিশা, রণিতও ছিল সঙ্গে। তখন সদ্য চাকরি পেয়েছে রণিত, ঊদিশার বিয়ের আলাপ আসছে একটা দুটো করে।

সন্ধেবাতি জ্বালিয়েছে অনিতা। চরাচরে রকমারি গন্ধ ধুপকাঠি আর ধুলোর সংমিশ্রণে। সোফায় বসেই হিমানীশ হাত দুটো জোড় করে কপালে ঠেকান। ‘সবই তোমার ইচ্ছে ঠাকুর’, এর বেশি কিছু চান না, চাওয়ার কিছু নেই। ষাটটি বসন্ত পেরনো জীবনে বলতে গেলে সব কিছুই পেয়ে গেছেন হিমানীশ। তবু মাঝে মাঝে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন তার ছোট্ট সংসারটা যেন অটুট থাকে এভাবেই।

মাঝে মাঝে একটা নৈরাশ্য পেয়ে বসে হিমানীশকে, যদি হঠাত্‍ করে মারা যান। ক’দিন আগেই পাড়ার ভট্চাজ মারা গেছে হঠাত্‍ করে। আগের দিনও দিব্যি ভাল মানুষ, পরদিন সকালে তাকে বিছানায় মৃত আবিষ্কার করেছে পরিবারের লোকজন। যদি হিমানীশকেও এভাবে মরতে হয়। রবিঠাকুরের ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর এ ভুবনে’ লাইনটার তাত্পর্য এখন নতুন করে ধরা পড়ছে তার কাছে। রবিঠাকুর কেন মরতে চাননি সেটা বিশদ জানা নেই হিমানীশের, কিন্তু তিনি এখনই মরতে চান না। আরও কয়েকটা বছর, অনিতার কোলে কাঁদার মত কেউ একজন আসুক, তারপর।

রণিত ঘরে ফেরেনি এখনও, ওঘরে অনিতার ইতস্তত পায়চারি তারই জানান দিচ্ছে। আজকালকার ছেলেরা সোজাভাবে কেন কিছুই বুঝতে চায় না সেটা মগজে ঢোকে না হিমানীশের। যেদিকে ছোটে তো ছুটছেই। রণিতের চাই শুধু টাকা আর টাকা, আরও চাই। তবে পরিশ্রমের কামাই, এটাই সান্ত্বনা। হিমানীশের এখনো মনে আছে রণিতের জন্মের আগে পর্যন্ত ওভারটাইমের লোভ প্রত্যাখ্যান করে ঠিক সাড়ে ছ’টার মধ্যে ঘরে ফিরে আসতেন জয়িতার সান্নিধ্য পেতে। পাশাপাশি বসে হা করে শুনত জয়িতা হিমানীশের মুখ থেকে সারাদিনের ঘটনাবলীর ধারাবিবরণী। অথচ বিয়ের ছ’মাসও হয়নি রণিতের, আজপর্যন্ত ক’দিন সময়মতো বাড়ি এসেছে সেটার চেয়ে ক’দিন দেরি করে এসেছে সেটার সংখ্যা ঢের বেশি।

হিমানীশ ওভারটাইম একেবারেই যে করেননি টা নয়। রণিতের জন্মের পর সংসারটাকে আরেকটু ভালভাবে চালাতে প্রতিমাসেই কিছুসময় ওভারটাইম করেছেন, তবে রণিতের মতো নয়। সহকর্মী চারজন একসঙ্গে ছুটি নেবার দরুণ একবার বাধ্য হয়ে আটচল্লিশ ঘণ্টা ওভারটাইম করে তিনশো চুরাশি টাকা পেয়েছিলেন হিমানীশ, এটাই তার সর্বোচ্চ। বড় ঘরের সিলিং ফ্যানটা আজও তার সাক্ষ্য় বহন করছে। কিন্তু রণিতের কাছে তিরিশ-চল্লিশ ঘণ্টা ওভারটাইম কোনও ব্যাপারই নয়, আরও চাই। হিমানীশ আপত্তি করলেই হয়েছে। ঠান্ডা লড়াই। ফলাফল, কয়েকদিন স্বাভাবিকের চেয়েও কম বাক্যালাপ, পরে জয়িতা বা অনিতার পরোক্ষ মধ্যস্থতায় পরিস্থিতির স্বাভাবিক হয়ে আসা।

হিমানীশের বড় কষ্ট হয় একেক সময় পরিশ্রমে নুয়ে পড়া রণিতের দিকে তাকালে। ছেলের শরীরের বিনিময়ে ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক ওভেন ওসব ছাইপাশ চাইনা হিমানীশের, অথচ রণিত সে লক্ষ্যেই ছুটে চলেছে। ওসব না কিনলেই যদি না হয় তাহলে কিস্তিতে নিলেই হয়। ঘরের টিভি, ফ্রিজ সবই কিস্তির। রণিত আবার কিস্তি-ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী, এতে নাকি দোকানির কাছে হেয় হয়ে যাওয়া। এই ক’দিন থেকে ওভারটাইমের ভূত চেপেছে ওর মাথায়। হিমানীশ কিছু বলতে ভরসা পাচ্ছেন না। জয়িতা কাছে নেই, সন্ধির ব্যাপারে অনিতা এখনো নবিশ। যদি ব্যবধানটা বেড়ে যায় বাবা-ছেলের মাঝখানে। তবে অনিতা ছাড়েনি, মৃদু আপত্তি জানিয়েছে রণিতের কাজের। আশ্চর্য, প্রতিবাদ কানে আসেনি হিমানীশের। আসলে বশ করাটা বোধহয় মেয়েদের স্বভাবসিদ্ধ কলা।

কোনও বাজে নেশা নেই হিমানীশের সিগারেট ছাড়া। খুব বেশি চলে না সেটাও। দিনে তিনটে, বড়জোর চারটে। হ্যাঁ, দুটো জিনিসের জন্য বরাবরই পাগল হিমানীশ – বই আর ক্যাসেট। ফ্যানটম, ম্যানড্রেক, কাকাবাবু, ফেলুদাকে গিলে খেয়েছেন মাধ্যমিক দেবার আগেই। কলেজে পা দেবার পর থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরত্‍চন্দ্র, বিভূতি, মানিকরা একটু একটু করে জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন হিমানীশের মননে ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে। একসময় বিমল কর, সমরেশ বসু, সুনীল গাঙ্গুলি বাড়তি ভালবাসা পেয়ে যান তাদের ছোটগল্পের দৌলতে।

একই ভাবে ক্যাসেটের ব্যক্তগত সংগ্রহে লতা, কিশোরের পাশাপাশি জায়গা পেয়ে গেছেন যেশুদাস, জগজিত্‍ সিং, সুচিত্রা মিত্র, অজয় চক্রবর্তীরা। জয়িতার অনুপস্থিতিতে বই পড়া বা গান শোনা কোনওটাই ভাল লাগছে না হিমানীশের। ওগুলো ব্যবহার করতে গেলেই জয়িতার বিরহটা যেন উথলে ওঠে। শেষের দিকের বই আর ক্যাসেটগুলোর বেশিরভাগই জয়িতার দেওয়া জন্মদিনে, বিবাহবার্ষিকীতে, কোনও বিশেষ দিন ছাড়াও দিয়েছে কিছু। জয়িতার অবর্তমানে নিজেকে তারাশংকরের নিঃসঙ্গ ‘কবিয়াল’ ছাড়া আর কোনও চরিত্রে মেলাতে পারছেন না হিমানীশ। কিসের গান আর কিসের বই। একটানা এতদিন জয়িতাকে ছাড়া আগে কখনো থাকেননি হিমানীশ।

সন্ধে সাতটা। অনিতা এসে কোনও বাক্যালাপ না করে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে যায়। বাংলা খবরটা কখনো বাদ দেন না হিমানীশ, অনিতা সেটা বিলক্ষণ জানে। হিমানীশের লক্ষ্য ছিল না সময়ের দিকে। দিনকয়েক থেকে এরকমই হচ্ছে। জয়িতার অনুপস্থিতি, ভট্চাজের মৃত্যু, রণিতের হাবভাব সব কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে হিমানীশের মস্তিষ্কে। প্রথম খবরটা বলল, ভারত তিনটে পরমাণু বোমার সফল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। মেরুদণ্ড টান হয়ে যায় হিমানীশের, কিছুটা গর্বও হয়। আমেরিকার চোখ রাঙানি আর চলবে না বেশিদিন। জন্মগত বেইমান পাকিস্তান এবার হয়তো ছাড়বে অবাঞ্ছিত হঠকারিটতা। বাকি খবরগুলো অন্যদিনের মতই – হত্যা, সন্ত্রাসবাদ, অপহরণ, ধর্ণা, খেলা ইত্যাদি। শুধু স্থান, কাল, পাত্র পরিবর্তিত।

একটু অস্বস্তিতে ভুগছেন হিমানীশ। সকালে দরজা বন্ধ করে অনিতাকে কিসব যেন বলেছে রণিত। রণিত অফিস চলে গেছে, তারপর থেকে অনিতাও চুপ। অন্যদিন এরকম করে না মেয়েটা। আজ যতবারই চোখাচোখি হয়েছে সন্দিগ্ধ চাউনিতে বিদ্ধ করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সকালে রণিতের সঙ্গে কি তাহলে ঝগড়া হলো অনিতার? রণিতের মুখ দেখে তা মনে হয়নি একদমই। অনিতা কিছু লুকোচ্ছে?

“ক্যা – আ – চ।”

হিমানীশের চিন্তাসূত্র ছিড়ে যায় দরজা খোলার শব্দে। রণিত এসেছে, অন্যদিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়িই। খটকা লাগে হিমানীশের। হাতে একটা প্যাকেট। সোজা এদিকেই রণিতকে আসতে দেখে কিছুটা শঙ্কিত হন হিমানীশ। ওদিকে দরজার সামনে মুখ লাগিয়ে অনিতা তাকিয়ে। ঝগড়া হবে না তো? ইশ্ যদি জয়িতা কাছে থাকতো।

“হ্যাপি বার্থ ডে বাপি, এটা তোমার জন্য।”

 রণিত প্যাকেটটা এগিয়ে দিতে দিতে বলে, অনিতার মুখে মুচকি হাসি। হিমানীশ বাক্যহারা। দিন কয়েক থেকে নৈরাশ্যের চাপে নিজের জন্মদিনটা পর্যন্ত ভুলে গেছেন। রণিত ভোলেনি, জয়িতাও ভোলেনা। অস্বাভাবিক আবেগে ছেলেকে বুকে চেপে ধরেন হিমানীশ। উঃ , এত উষ্ণ ছোঁয়া পেলে কি কেউ মরার কথা কল্পনা করতে পারে। চোখের জল বাঁধ মানে না হিমানীশের। রণিত অতি যত্নে তা মুছিয়ে দেয় হিমানীশ যেমনটা দিতেন রণিতের ছেলেবেলায়। অনিতা এসে প্যাকেটটা খোলে। সুনীল গাঙ্গুলির সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘প্রথম আলো’র গন্ধে বাতাসটা ভুর ভুর করে ওঠে।

.     .      .

Discus